অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে পুঁজিবাজারের সামঞ্জস্য থাকতে হবে

আপনারা অনেকেই শেয়ার বাজারের উত্থান-পতন বলছেন, আমি একটু ভিন্নভাবে বলতে চাই। বর্তমানে শেয়ার মার্কেটের উঠা-নামাটা বাজারের স্বাভাবিক আচরন। শেয়ার মার্কেট মাঝে মাঝে কারেকসন হচ্ছে। যখন ইন্ডেক্স বেশি মাত্রায় উঠানামা করছে, সেই মুহূর্তে ছোটখাটো কারেকশন হচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা দুবার শেয়ার মার্কেটের ধস দেখেছি। প্রথমবার ১৯৯৬ সালে আমাদের শেয়ার মার্কেটে স্পেকুলেটিভ বাবল্ সৃষ্টি হয়েছিল। দ্বিতীয়বার ২০১০ সালে শেয়ার ওভার প্রাইসিং হয়েছে ৫০০-৭০০ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে শেয়ার মার্কেটে স্পেকুলেটিভ বাবল্ তৈরি হয়েছে। তখন ইন্ডেক্স ৮৯১৮ পর্যন্ত গিয়েছিল। বর্তমানে আমরা এখন যে ইন্ডেক্স দেখছি, এটা মার্কেটের স্বাভাবিক আচরন। এটা কারেকসন, এই কারেকসনের মাধ্যমেই বাজারে উঠানামা হচ্ছে।

বাংলাদেশের ইকনোমি এবং শেয়ার মার্কেট:
বাংলাদেশের ইকনোমি নিয়ে যদি বলতে হয় স্বাধীনতার পরে আমরা ৫০ বছর পার করলাম। এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের ইকনোমি টোটাল জিডিপি ৬ বিলিয়ন ডলার থেকে বর্তমানে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। আমাদের পার ক্যাপিটা ইনকাম ৯০ ডলার থেকে বর্তমানে প্রায় ২২০০ ডলার প্লাস হয়েছে। আশার কথা হল, আমরা ২০২০ সালে ভারতের পার ক্যাপিটা ইনকাম এবং পার ক্যাপিটা জিডিপি ক্রস করেছি। বিশ্ব ব্যাংক আমাদের ইকোনমি সম্পর্কে মন্তব্য করেছে, দ্রুততম উন্নয়নশীল ইকোনমির দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এইচএসবিসি ব্যাংক তাদের রেটিংয়েও একই কথা বলেছে। পিডব্লিউসি বলেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৮তম বৃহৎ ইকনোমির দেশ হবে বাংলাদেশ। আমাদের জিডিপি গ্রোথ এভারেজ ৬.৯ পার্সেন্ট। এই করোনার সময় সারা বিশ্ব থেমে গিয়েছিল। অথচ করোনার সময় আমাদের জিডিপি পজিটিভ ছিল ৩.৫% গ্রোথ। যেখানে ভারতের নেগেটিভ জিডিপি -৭.৩%। এই সবই আমাদের ইকোনমিক গ্রোথের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বড় কোম্পানি পঁজিবাজারে না আসার কারণ:
আমাদের ইকোনমিক ইন্ডিকেটর সব সবকিছু পজিটিভ থাকার পরেও শেয়ার মার্কেট পজিটিভ না। আজকে যদি আমি ব্যাংক থেকে ফাইনান্স নেই আমাকে ৭- ৯ শতাংশ ইন্টারেস্ট দিতে হয়। অন্যদিকে আমি যদি শেয়ার মার্কেট থেকে টাকা সংগ্রহ করি, আমাকে মিনিমাম ১০ শতাংশ ডিভিডেন্ড নিশ্চিত করতে হবে। বড় বড় কর্পোরেট হাউজ যেগুলো আছে তারা সহজেই ব্যাংক থেকে ফাইনান্স সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু স্টক মার্কেট থেকে যখন টাকা নিতে যায়, তখন অনেক প্রসিডিউর, কমপ্লায়েন্স, লিস্টিং, ব্যুরোক্রেসি এগুলোকে ফেইস করতে হয়। তাই বড় বড় কর্পোরেট হাউসগুলো সহজ উপায়ে ফাইন্যান্স সংগ্রহের জন্য ব্যাংকের কাছে যায়।

এছাড়াও আছে প্রাইভেট ইনফর্মেশন। আপনি যখন শেয়ার মার্কেটে লিস্টিংয়ে যাবেন, তখন আপনার কোম্পানির সব কিছু পাবলিকলি শেয়ার করতে হয়। আমি যদি ব্যাংক থেকে টাকা নেই আমাকে এই প্রাইভেট ইনফরমেশন পাবলিকলি শেয়ার করতে হয় না। এই প্রাইভেট ইনফরমেশন পাবলিকলি বা মিডিয়ার কাছে শেয়ার করা, এই জায়গায় আমাদের যারা স্পন্সার বা এন্টারপ্রেনার আছেন, তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। আরেকটি ব্যাপার আছে, সেটা হল কমপ্লায়েন্স কস্ট। একটি কোম্পানি যখন লিস্টিংয়ে যায়, তখন সেই কোম্পানিকে প্রচুর পরিমাণ কমপ্লায়েন্স কস্ট বেয়ার করতে হয়। ব্যাংক থেকে টাকা নিতে গেলে এই কমপ্লায়েন্স খরচ হয় না। এর বাইরে আছে মিডিয়া ফোবিয়া। পাবলিকলি মিডিয়ার মুখোমুখি হতে হয়। এজিএম করতে হয়। পাবলিককে ফেইস করতে হয়। এটা একটা কারণ স্টক মার্কেটে লিস্টিং না হওয়ার। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে আরো একটিভ হতে হবে।

কর্পোরেট গভর্নেন্স:
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কর্পোরেট গভর্নেন্স গাইডলাইন প্রকাশ করেছে। এখানে একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর কিভাবে অ্যাপোয়েন্টেড হবে। বোর্ড এর সাইজ কি হবে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডাইরেক্টর কে হবে। অডিট কমিটির চেয়ারম্যান কে হতে পারবে। এইসব কিছুই গাইডলাইনে দেয়া আছে। প্রত্যেকটা লিস্টেড কোম্পানি চেষ্টা করে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর তাদের কাছের কেউ বা আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কাউকে যদি দেয়া যায়। তাহলে সত্যিকার অর্থে এখানে ইন্ডিপেন্ডেন্স থাকে না। আমি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কে সাধুবাদ জানাই, তারা অনেকগুলো ইনিশিয়েটিভ নিয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন প্রফেশনাল ইনস্টিটিউশন থেকে প্রফেশনালদেরকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগের জন্য কমিশন চেষ্টা করছে। এই উদ্যোগ আমাদের ফিউচার কর্পোরেট গভর্নেন্স ইমপ্রুভমেন্টের ভালো ইঙ্গিত দিচ্ছে। একটু সময় লাগবে। এই সময়ের মধ্যে কর্পোরেট গভর্নেন্স গ্রাজুয়েলি ইমপ্রুভ করবে বলে আমি মনে করি।

পুঁজিবাজারের চ্যালেঞ্জ:
কস্ট অফ ফান্ড, এক্সেস ফান্ড, কমপ্লায়েন্স কস্ট এই চ্যালেঞ্জগুলো যদি ওভার কাম করতে হয়, তাহলে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে লিস্টিং প্রসিডিউর আরও সহজ করে দিতে হবে। এখন লিস্টিং প্রসিডিউরটা অনেক সময়সাপেক্ষ। আইপিওর নিয়মটাকে আরও সহজ করতে হবে। ভালো কোম্পানির শেয়ারগুলোকে আনতে হবে। ট্যাক্স-ভ্যাট আরো অ্যাট্রাক্টিভ করতে হবে। যাতে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো, বড় কর্পোরেট হাউজগুলো মার্কেটে চলে আসে। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে আরও একটিভ হতে হবে। মিডিয়াকে আরো ব্যবসা বান্ধব হতে হবে। একইসাথে আমরদের প্রাইভেট ইনফর্মেশন অবশ্যই ততটুকু শেয়ার করতে হবে, যে পর্যন্ত না বিজনেস সিক্রেসি চলে যায়। এই চ্যালেঞ্জগুলো যদি মোকাবেলা করা যায়, আমার মনে হয় স্টক মার্কেট অনেক ভালো হবে। বর্তমান সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আপনারা জানেন অনেকগুলো রোড শো করেছে। সেই রোড শোতে ‘দ্য রাইজ অফ বেঙ্গল টাইগার’ স্লোগান নিয়ে কমিশন লন্ডন, ইউএসএ, সুজারল্যান্ড, দুবাই এইসব দেশে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করেছে। এর ফলে হিউজ ইনভেস্টমেন্ট অপরচুনিটি ক্রিয়েট হয়েছে। বাংলাদেশের ইকনোমিক গ্রোথ, বাংলাদেশের ইকোনমিক প্রসপেক্টাস, বাংলাদেশ ফিউচার ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রি, এটা মধ্যম আয়ের দেশ। এসব কিছু নিয়ে আমাদের দেশের একটা সফল ব্র্যান্ডিং এরই মধ্যে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন করতে সক্ষম হয়েছে।

শেয়ার মার্কেট উন্নয়নে আইসিএমএবি’র ভূমিকা:
কেন শেয়ার মার্কেটের এই উত্থান-পতন? আপনি দেখেন ইপিএস ভালো। এনএভি ভালো। ডিভিডেন্ড ঠিকমত দিচ্ছে। তারপরও শেয়ারহোল্ডারদের ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টের উপরে আস্থা নেই। আপনি একটা ফিনান্সিয়াল রিপোর্ট যদি দেখেন, এখানে কস্ট অফ গুডসোল বলে একটি অংশ আছে যেটার আশি ভাগ কম্পোনেন্ট ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্টের। এই কস্ট অফ গুডসোল, কষ্ট ম্যানেজমেন্ট একাউন্ট্যান্টকে দিয়ে সার্টিফাই করানো হয় না। এই জন্য অনুমান ভিত্তিক গ্রস প্রফিট বা জিপি ক্যালকুলেশন করে ট্যাক্স অ্যাসেসমেন্ট করে ফেলে। এর ফলে ইনকাম ট্যাক্স অথরিটির (এনবিআর) সাথে ব্যবসায়িক সমাজের দূরত্ব বেড়ে যায়। অনুমান ভিত্তিক জিপি ক্যালকুলেশনের ভিত্তিতে ব্যবসায়িক সমাজ লাভবান হয়। কিন্তু এনবিআরের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। কস্ট অফ গুডসোল যদি কষ্ট ম্যানেজমেন্ট একাউন্ট্যান্টকে দিয়ে সার্টিফাই করানো হয়, তাহলে এই ফাইনান্সিয়াল স্টেটমেন্টের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাবে। চেক অ্যান্ড ব্যলান্স হবে। একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্ট সার্টিফাই করছে। পাশাপাশি যদি একজন কস্ট ম্যানেজমেন্ট একাউন্ট্যান্ট এই মেনুফেকচারিং অরগানাইজেশনের কস্ট অফ গুডসোল স্টেটমেন্ট সার্টিফাই করে, তাহলে চেক অ্যান্ড ব্যলান্স হবে। শেয়ারহোল্ডার এবং জনগণের এই অডিটেড ফাইনান্সিয়াল স্টেটমেন্টের উপর আস্থা থাকবে। এনএভি, ইপিএস আমরা দেখাচ্ছি এটার উপরে ভিত্তি করে।

যেগুলো ফান্ডামেন্টাল শেয়ার, সেখানে ইনভেস্ট করতে হবে। বর্তমানে ফান্ডামেন্টাল শেয়ারে ইনভেস্টমেন্টের সংখ্যা কম। কারণ স্পেকুলেটিভ যে শেয়ারগুলো আছে, যেগুলোকে আমরা গ্যামলিং শেয়ার বলি, সেখানে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারণ ওই ফাইনান্সিয়াল স্টেটমেন্ট সঠিক পিকচার দিতে পারছে না। ইপিএস ভালো, এনএভি ভালো, তারপরও শেয়ার রাইজ করছে না। রাইজ করছে জেড ক্যাটাগরির শেয়ার। এটার কারণ ল্যাক অফ ট্রাস্ট অন ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্ট। এখানে কস্ট ম্যানেজমেন্ট একাউন্টেন্ট সত্যিকার অর্থে ভূমিকা রাখতে পারে। আর যদি কষ্ট অফ গুডসোল স্টেটমেন্ট কস্ট ম্যানেজমেন্ট একাউন্টেন্ট দিয়ে সার্টিফাই করানো হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীদের বিশ্বস্থতা আরোও বাড়বে।

ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল ফর্ম হয়েছে সেখানে একজন কস্ট ম্যানেজমেন্ট একাউন্টেন্ট এবং চার্টার্ড একাউন্টেন্ট দুজনের সমান মর্যাদা। এখানে যদি ফাইনান্সিয়াল অডিটের পাশাপাশি কস্ট অডিট সকল মেনুফেকচারিং অর্গানাইজেশনের জন্য ম্যান্ডেটরি করে দেয়া যায়, তাহলে ফাইন্যান্সিয়াল একাউন্টিং এর ট্রান্সপারেন্সি বাড়বে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, আরেকটি অডিটের ফলে এক্সট্রা বার্ডেন আসবে কিনা, এক্সট্রা কস্ট ইনভলভমেন্ট হবে কিনা। আপনাদের অবগতির জন্য বলছি, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্টেন্টরা কস্ট মিনিমাইজেশন, ওয়েস্টেজ মিনিমাইজেশনে এক্সপার্ট। কস্ট ওয়েস্টেজ যদি মিনিমিজেশন করা যায়, কষ্ট যদি রিডিউস করা যায়, তাহলে প্রফিট ম্যাক্সিমাইজ হবে।

ধরুন, ১০০কোটি টাকার ১টি কোম্পানির ৮০ ভাগ কষ্ট অফ গুডসোল। এই ৮০ পার্সেন্ট (৮০ কোটি) টাকার আমি যদি এক পার্সেন্ট আপনাকে বাজেটারি কন্ট্রোল, প্রসেস কস্টিং, ওয়েস্টজ ম্যানেজমেন্ট সেট করে দিতে পারি, তাহলে আপনার ৮০ লক্ষ টাকা সেভ হবে। কিন্তু আপনিতো অডিট ফি দিবেন সামান্য টাকা। অথচ বলা হয়, এতে অডিট ফি বেড়ে যাবে, বিজনেস হ্যাসেল বাড়বে। এই অজুহাতে কষ্ট অডিট বাস্তবায়ন করা হয় না। আমি মনে করি, আমরা বোকার স্বর্গে আছি।

কষ্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্টেন্ট আমার প্রফেশন। আমি কষ্ট ম্যানেজ করতে পারি, প্রফিট ম্যাক্সিমাইজ করতে পারি। যেটা শেয়ার হোল্ডারদের ও ব্যাবসায়ীদের নেটওয়ার্ক বাড়াবে। ব্যাবসাকে এক্সপান্ড করার সুযোগ করে দিবে। অন্যান্য দেশগুলোতে দেখেন, কস্ট অডিট ম্যান্ডেটরি। কষ্ট অডিটের মাধ্যমে আপনারা প্রচুর লাভবান হবেন। একজন কষ্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্টেন্ট, ম্যানেজমেন্ট রিপোর্টের মাধ্যমে ম্যানেজমেন্টকে বা শেয়ারহোল্ডারকে গাইড করতে পারে যে, কিভাবে তারা প্রফিট বাড়াতে পারবে, বা কিভাবে খরচ কমাতে পারে।

মো. মামুনুর রশিদ এফসিএমএ
প্রেসিডেন্ট
দ্যা ইনস্টিটিউট অফ কস্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ