আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পে মেছের আলীসহ অনেকের ভাগ্য পরিবর্তন

জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার লতিবপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের মৃত আব্দুল করিমের পুত্র মেছের আলীসহ অনেকে দারিদ্রতাকে জয় করে স্বাবলম্বী হয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। তাদের এ ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে আমার বাড়ি আমার প্রকল্প। ৩/৪ বছর আগেও মেছের আলী দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত ছিল। দারিদ্রতার দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন প্রতিনিয়ত। উপরন্তু গ্রামীণ ব্যাংক ও দু’একটি এনজিওর ঋণের সাপ্তাহিক কিস্তির জ্বালায় দিশেহারা ছিল। সে সময়ে তার জীবনে বিরাট অবলম্বন হয়ে এসেছিল আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প।

আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প থেকে নামমাত্র সুদে জামানতবিহীন পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পাঁচশত ব্রয়লার মুরগী দিয়ে একাট ছোট্ট মুরগীর খামার গড়ে তোলেন। এরপর থেকেই ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে মেছের আলীর। ওই প্রকল্প থেকে তিনি ৩ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পরবর্তীতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ বাবদ সত্তর হাজার টাকার ঋণ দিয়ে দ্বিতীয় দফায় লেয়ার মুরগীর খামার গড়ে তোলে। বর্তমানে এ খামারে প্রায় ১২০০ লেয়ার মুরগী রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১০০ ডিম উৎপাদন হয় সেখানে। প্রতিমাসের খামারের খরচ মিটিয়ে আয় করে পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে আরও বেশি।

কিছুদিন আগেও যার দুই ছেলের লেখাপড়ার খরচ মেটানো দুঃসাধ্য ছিল। বর্তমানে তিনি সন্তানের লেখাপড়ার খরচ ভালোভাবে চালিয়েও স্বচ্ছল জীবনযাপন করছেন। ওই প্রকল্প থেকে ঋণ গ্রহণ করলেও কখনও কিস্তি খেলাপ করেনি, সমিতির সচেতন সদস্য হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন তিনি। প্রথম পর্যায়ে মাত্র পাঁচ হাজার টাকার ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসার কাজে লাগিয়ে ছিলেন, পর্যায়ক্রমে দশ হাজার, পরে সতের হাজার ঋণ গ্রহণ করলেও কখনও ঋণ খেলাপী হয়নি। ফলে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প তাকে একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে বেছে নিয়েছে । এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মেছের আলী বলেন,“আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প আমার জীবনে অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। মূলধনের অভাবে ব্যবসা শুরু করতে পারিনি, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে দুর্বিসহ জীবন যাপন করেছি। প্রকল্প থেকে নামমাত্র সুদে আমাকে জামানতবিহীন পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করে। অথচ কোন ব্যাংক বা এনজিও থেকে জামানতবিহীন এরকম ঋণ কখনও কল্পনাও করা যায়নি। এরপর প্রকল্প থেকে সত্তর হাজার, নিজে ত্রিশ হাজার টাকা বিনিয়োগে লেয়ার মুরগীর খামার গড়ে তুলি। বর্তমানে খামার থেকে লাভের মুখ দেখছি। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখে আছি। মজার কথা হল দারিদ্র দূর হওয়ার পাশাপাশি আমার সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

এভাবে একই গ্রামের প্রতিবেশী নুরবানু ও গোলাপী বেগম এ প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছে। নুরবানু জানান, প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে আমি সংসারে স্বামীর পাশাপাশি নিজেও বাড়তি আয় করতে পারছি। পাশের পাইকান গ্রামের মোক্তার মিয়া ও রাজিয়া সুলতানা আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প থেকে তাদের পছন্দমত বিষয়ে ৩ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, পরে তারা পঞ্চাশ হাজার টাকা করে ঋণ গ্রহণ করেন। পাইকান সমিতির সদস্য মোক্তার মিয়া জানান, প্রকল্প থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার ঋণ নিয়ে স্থানীয় বাজারে ওষুধের ব্যবসা শুরু করি, বর্তমানে সংসারের খরচ এবং ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছি। এছাড়াও বাতাসন দুর্গাপুর গ্রামের শফিউল ইসলাম ও সান্তনা বেগম তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের গল্প শুনিয়েছেন সানন্দেই।

শফিউল ইসলাম জানান, একসময় সামান্য কিছু টাকা ধার চাইলেও কেউ দিতে চাইতো না, অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটাতে হতো আমাদের, কোন এনজিও আমাদের ঋণ দিতে সাহস পায়নি, তখন আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প আমাদের জন্য আশির্বাদ হয়ে এসেছে। আমরা এ প্রকল্প থেকে কম সুদে ঋণ পেয়ে বাঁচার একটা অবলম্বন খুঁজে পেয়েছি। বালুচর কাশিনাথ পুর গ্রামের গোলাম মোস্তফা, জয়গুন নাহার, খোশাল পুর গ্রামের কামরুজ্জামান, শেফালী, আব্দুল্লাহপুর গ্রামের তাজনুর বেগম, সাইফুন্নাহারসহ মিঠাপুকুর উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নের হাজারও ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে এ প্রকল্পের সহায়তায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প অন্যতম।

প্রকল্পের মিঠাপুকুর উপজেলা সমন্বয়কারী ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক, মুনতাসীর আলভী জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে একটি দারিদ্র ও শোষণমুক্ত দেশ গঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্র বিমোচনের মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করার প্রত্যয় নিয়ে ২০০৯ সালে সৃষ্টি করেছিলেন একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নিজেই প্রকল্পটির নাম পরিবর্তন করে ‘আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প’ নামকরণ করেন। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে মিঠাপুকুর উপজেলায় প্রকল্প চালু হওয়ার পর ১৭টি ইউনিয়নে প্রথম পর্যায়ে দরিদ্র পরিবার চিহ্নিত করে ৮৯৪১ জন সদস্যকে ১৫৩টি সমিতিভুক্তির মাধ্যমে চালু করা হয়।

প্রত্যেক সদস্যের কাছে মাসিক ২০০টাকা হারে সঞ্চয় নিয়ে ২ বছরে ৪৮০০টাকা, প্রকল্পের দেয়া কল্যাণ অনুদান বাবদ জনপ্রতি ৪৮০০ টাকা এবং সরকার প্রদত্ত ঘূর্ণায়মান ঋণ তহবিল মিলে উপজলায় সর্বমোট ৫ কোটি ২৮ লক্ষ টাকার বিশাল মূলধন নিয়ে প্রকল্পের কার্যক্রম পুরোদমে অব্যাহত থাকে। যাত্রা শুরুর পর গত কয়েক বছরে ১৫৩টি সমিতির পর, ৩য় সংশোধিত প্রকল্পে আরো ২৭০টি সমিতিতে এখন সদস্য সংখ্যা সর্বমোট ১৯,৯০৮ জন এবং উপজেলায় সর্বমোট মূলধন ২৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এসব সদস্যের সাথে লেনদেন পরিচালনার জন্য মিঠাপুকুর উপজলায় প্রকল্পের জনবল বৃদ্ধি পেয়ে ৩৭ জনে দাঁড়িয়েছে। তারা মাসিক কিস্তিতে প্রদত্ত ঋণের টাকা আদায় করেন এবং মানুষকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করেন।

মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুন ভুুঁইয়া জানান, প্রদত্ত ঋণের টাকা আয়বর্ধনমুলক কর্মকান্ডে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে প্রতিটি বাড়িতে এক একটি ক্ষুদ্র খামার স্থাপনে প্রধানমন্ত্রীর দর্শন বাস্তবায়নে নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এ উপজেলায়। স্থানীয় সাংসদ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এইচ এন আশিকুর রহমান এমপি জানান, এ প্রকল্পের মাধ্যমে উপজেলার অবশিষ্ট দরিদ্র সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দারিদ্র শূণ্য বাংলাদেশের রোডম্যাপ বাস্তবায়ণে এবং ২০৪১ সালের একটি উন্নত দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ণে প্রকল্পটি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করবে। তথ্য-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান