ইদানিং মেয়েগুলো কেন আত্মহত্যা করছে?

বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক সমাজ ব্যবস্থায় কখনো নিজের ভাল ফলাফল, কখনো ক্যারিয়ারের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করা কোনো মেয়ে কিন্তু মন থেকে অনেক কিছু চাই না। তবুও বাবা মায়ের মান সম্মান রক্ষার্থে, শিক্ষকদের চোখ রাঙানীর ভয়ে, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে নিতান্ত অনিচ্ছায় একটা গাধার গাড়ির মতো নিজেকে প্রতিনিয়ত ঠেলতে থাকে। চেষ্টা করে আপনাদের আকাঙ্ক্ষার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছাতে। কখনো মাঝপথেই ক্লান্ত হয়ে যায়, কখনো বা চূড়ায় পৌঁছানোর আগেই পা পিছলে পিছিয়ে যায় জীবন দৌড়ে। আপনারা তার চেষ্টা দেখেন না, তার শ্রম দেখেন না। দেখেন তার ব্যর্থতা। আপনাদের অবজ্ঞার দৃষ্টি জীবনের কাছে হেরে যায়।

ছোটোবেলা থেকে সাতসমুদ্র তেরো নদীর ওপাড় থেকে আসা রাজপুত্রের গল্প শুনতে শুনতে বড় হওয়া মেয়েটির জীবনে আসলেই একদিন রাজপুত্র আসে। সমাজ, পরিবার সবকিছুর বিরুদ্ধে হলেও সেই রাজপুত্রকে সব উজাড় করে দিয়েই মেয়েটি ভালোবাসে। নতুন নতুন স্বপ্ন, ছোট ছোট অমুল্য ইচ্ছে দিয়ে রাজপুত্রকে নিয়ে নিজের আলাদা একটা জগত সৃষ্টি করে। খুব বড় কিছু না, খুব সামান্যই হয় চাওয়াগুলো। কিন্তু সেই সামান্য ইচ্ছে পূরণের সময়ও নেই রাজপুত্রের হাতে। ভালোবাসাগুলোকে তার কাছে মনে হয় ন্যাকামি, অভিমানগুলোকে মনে হয় একগুঁয়েমি, কষ্টগুলো মনে হয় বিরক্তিকর। গল্পের রাজপুত্রের কুৎসিত চেহারা বাস্তবে দেখার সাহস অনেক বোকা মেয়েরই থাকে না এতো অবহেলা, অপমান এর চাইতে একসময় মৃত্যুটাই সহজ মনে হয়।

বাবা-মায়ের পুতুল এর মতো দেখতে মেয়েটার একসময় পুতুল বিয়ের মতো করেই বিয়ে হয়ে যায়। নতুন সংসার, নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, নতুন সম্পর্কগুলোতে সুখের জোয়ার থাকার কথা। কিন্তু সেই সুখও সবার কপালে সয় না। নতুন মানুষগুলোর নিত্য নতুন মানসিক, শারিরীক অত্যাচারে জীবনটাই একসময় অসহ্য মনে হয়।

সম্প্রতি রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল এন্ড কলেজের একটি মেয়ে আত্মহত্যা করলো, সরাসরি তাকে না চিনলেও অনেক ফেসবুক বন্ধুর লিস্টে থাকায় তার মৃত্যু সংবাদটি বারবারই চোখের সামনে উঠে আসে। সুন্দর কিশোরী একটা মেয়ে। টাইমলাইন ঘুরে দেখলাম,অনেক দিন ধরেই হতাশামূলক সব পোস্ট দিচ্ছিলো। পোস্ট দেখেই মনে হলো প্রেমঘটিত হতাশা/ কষ্টে ভুগছিলো। কিছু স্ক্রিনশট ছিল যেখানে মেয়েটির আইডি হ্যাক করে তার কিছু ছবি পর্নসাইটে দেয়া হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়।

বোঝাই যায়, হতাশা তাকে চারদিক থেকেই ঘিরেছিল। আরো অবাক হয়ে দেখলাম তার এই সব পোস্টেও হাসাহাসি, ব্যঙ্গ করার মতো তার অনেক বন্ধু-বান্ধবই ছিল। যাকে উদ্দেশ্য করে পোস্টগুলো দেয়া হয়েছিল ধরেই নিয়েছি সে মেয়েটার সাথে কোনো বোঝাপড়ায় আসতে পারেনি। একটু ভালোবাসা, যত্ন বা মনোযোগে মেয়েটির হয়তো হতাশা কেটে যেত, কিন্তু তা না, তার বন্ধুরাও তাকে নিয়ে মজা করতে ছাড়েনি।

হাজারো মৃত্যুফাঁদ তৈরি করে রাখছি আমরা তাদের জন্য। কখনো বাবা-মা হয়ে নিজেদের আকাশ্চুম্বি আকাক্ষা তাদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে, কখনো প্রেমিক হয়ে প্রতিদিনের অবহেলা, মান অভিমানের মধ্যে দিয়ে, কখনো রাস্তার সেই নরপশু হয়ে যার লোভী দৃষ্টির কাছে জীবনটাকে তুচ্ছ মনে হয়, কখনো তার আত্নীয়, বন্ধু, কলিগ হয়ে বিভিন্নভাবে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করে।

যেই মেয়েটা সামান্য তেলোপোকায় ভয় পায়, সামান্য বটির আঘাতে যে পুরো বাসা মাথায় তুলে, রাম্নাঘরে এক ফোঁটা তেলের ছিটায় যে দশফোঁটা গল্প বানায়, ঠিক কতোটা অসহায় হলে সেই মেয়ে আত্মহত্যা করার সাহস পায়? কতদিনের চাপা কষ্ট পেলে পুষে মানসিক ভারাসসাম্য হারায়, বলেন তো?

এই আপনারা যারা আত্মহত্যাকারীর জন্য এতো সহমর্মিতা দেখাচ্ছেন কিংবা তার এই কাপুরুষজনোচিত আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, তারাই বলুন তো, আপনার কন্যা, প্রেমিকা, স্ত্রী, মা, বান্ধবীর প্রতি ঠিক কতটা আপনি উদার, যত্নশীল? আপনাদের প্রতি তাদের কোনো ক্ষোভ নেই তো? আপনারা পড়তে পারছেন তো তাদের মন?

আত্মহত্যা নিশ্চয়ই কোনো সমাধান না। আত্মহত্যাকারীর প্রতি মায়া, ক্ষোভ, ব্যঙ্গ করার চাইতেও আমি তাদের প্রতি বেশি ঘৃণা প্রকাশ করছি যারা একটা মানুষকে প্রতিনিয়ত আত্মহত্যার মুখে ঠেলে দেয়।