উত্তরাঞ্চলে করোনাকালে বাল্যবিবাহের কারণে ঝড়ে পড়েছে অনেক ছাত্রী

বৈশ্বিক মহামারি করোনার থাবা পড়েছে সর্বত্র। যে থাবায় সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছেন দেশের অস্বচ্ছল পরিবারগুলোই সবচেয়ে বেশি। দেশের শিক্ষা হারেও পড়েছে এর প্রভাব। করোনাকালে অনেক পরিবার অল্প বয়সেই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এ হারটা দেশের উত্তরাঞ্চলে একটু বেশি।

দেশের উত্তর জনপদ কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের ধরলা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন সরডোব উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেনীর ছাত্রী আছমা আক্তার (ছদ্মনাম)। করোনার ছুটির পর স্কুল খুলেছে- কিন্তু শ্রেণী কক্ষে এখন সে একা মেয়ে। ছেলে সহপাঠীদের সঙ্গেই ক্লাস করছে। কারণ এই একই শ্রেণীতে ৯ জন ছাত্রীর মধ্যে বাকি ৮ জনের বিয়ে হয়ে গেছে।

করোনা মহামারির কারণে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গতবছর সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। স্কুল খোলার পর শ্রেণী কক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সস্তোষজনক না হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে বাল্যবিবাহ ও ঝড়ে যাওয়ার চিত্র।

শিক্ষক,অভিভাবকও সচেতন মহল বলছেন, দারিদ্র্য,সচেতনতার অভাব, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, বন্যা-নদী ভাঙ্গনসহ নানা প্রতিকুলতার কারণে বাল্যবিবাহ ও ঝড়ে পড়ার হার বেড়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একই অবস্থা বিদ্যালয়টির দশম শ্রেণীতেও। এখানে চারজন ছাত্রীর মধ্যে জেসমনি ছাড়া বাকি তিনজনের বিয়ে হয়ে গেছে। এছাড়া ষষ্ঠ শ্রেণীর একজন, সপ্তম শ্রেণীর তিনজন, অষ্টম শ্রেণীর চারজনকে পরিবার থেকে গোপনে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে।

জেসমিন বলেন, ‘আমার ৮ বান্ধবীর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ক্লাসে এলেই মন খারাপ হয়ে যায়। কারো সঙ্গে কিছু শেয়ার করতে পারিনা। আমি বাবা-মাকে বলেছি- আমি পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। তারপর বিয়ে এর আগে নয়।’

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল মজিদ চৌধুরী বলেন, তাদের স্কুলে নবম শ্রেণীতে ৩৬জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ৯জন ছাত্রী। তিনি বলেন,‘ স্কুল খোলার পর বাল্যবিবাহের বিষয়টি প্রকাশ পেয়ছে, যা খুবই দুঃখজনক। প্রতিবছর বন্যা ও ধরলা নদীর ভাঙ্গনে বিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকে। যারা মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন, তারা গোপনে অন্যত্র নিয়ে বিয়ের আয়োজন করেন। এ জন্য আমাদের কাছে সংবাদ আসেনা।’

স্কুল খোলার পর অন্তত ১৫ দিন বিভিন্ন স্কুলে খবর নিয়ে জানা যায়, একই এলাকার উত্তর হলোখান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দর রাজ্জাক জানান, তার বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ৪২ জন ছাত্রীর মধ্যে দুইজন, সপ্তম শ্রেণীতে ৪৩ জন ছাত্রীর মধ্যে দুইজন এবং অস্টম শ্রেণীতে ৩৩ জন ছাত্রীর মধ্যে পাঁচজন ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে।

হলোখানা এমদাদীয়া দাখিল মাদ্রাসায় ৮৪জন শিকষার্থী অনুপুন্থিত। বাল্যবিবাহের কারণে অনেকে দাখিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ফর্ম পুরন করেনি। দাখিল মাধ্যমিক শাখায় ১১ জন ছাত্রীর মধ্যে ৯ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবু বকর সিদ্দিক বলেন, চরাঞ্চলে নিরাপত্তার অভাব, দরিদ্র ও অসচেতন অভিভাবকেরা কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। আর ছেলেরা যায় কাজ করতে।

জেলা শিক্ষা অফিস জানায়, সদর উপজেলায় পাঁচটি বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ৬১ জন ছাত্রী করোনাকালে বিয়ের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম বালিকা বিদ্যালয়ের ৩০ জন, ঘোগাদহ মালেকা বেগম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৫, মধ্য কোমরপুরে ১৬, কাঁঠালবাড়ি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ১৪ ও বারউল্লাহ বালিকা বিদ্যালয়ের ৬ জন।

বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী জানুয়ারি ২০১৮ থেকে আগস্ট ২০২১ পর্যন্ত জেলার ৯টি উপজেলায় বাল্যবিবাহ সংঘটিত হয়েছে ৩ হাজার ১৯টি। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ হয়েছে ১ হাজার ১৩৬টি।

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শামসুল আলম জানান, এ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কর্মকর্তাদের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় শতকরা ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। ঝরে পড়া কন্যাশিশুদের অধিকাংশই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। প্রকৃত তথ্য নিতে উপজেলাগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তথা সার্বিক উন্নয়নে সরকার নারী-পুরুষ সম অধিকারের কথা বলে আসছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সরকার বাল্যবিবাহের সম্পুর্ণ বিরোধী। সরকারের উন্নয়নকে সঠিক পথে রাখতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও অংশগ্রহণ জরুরী। করোনা মহামারি প্রায় চলে গেছে। তাই শুধু সরকার নয়, সমাজের সকলকে এগিয়ে এসে কন্যা শিশুদের শিক্ষাঙ্গনে পাঠাতে সচেতন হতে হবে। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান