এখনকার পুঁজিবাজারে ধসের আশঙ্কা নেই

মো. রকিবুর রহমান:

আমাদের পুঁজিবাজার সম্পর্কে, আমাদের অর্থনীতি সম্পর্কে আমি বলব যে, বর্তমান অবস্থা বশ ভালো। অনেকেই বলবেন ভালো নয়। আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি, আমাদের বাজার বেশ ভালো।

আজকে দেশের অর্থনৈতিক যে অবস্থা, অর্থনৈতিক সূূচকগুলো যদি আপনি ল্য করেন, সবগুলা ইনডিকেটর পজিটিভ। আর এটা যে শুধু আজকেই তা নয়। এটা কয়েক বছর ধরেই, গত আট-দশ বছর ধরেই আমরা ভালো করছি। আমাদের জিডিপি ৬-এর ওপরে ছিল। আজকে দেশের যে উন্নয়নের গতি, তা কি খারাপ বলা যায়? এখন তো ওয়ার্ল্ড ব্যাংকসহ সবাই বলছে প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের বেশি, ৭ দশমিক ২ এরও বেশি হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যেখানে সব ইন্ডিকেটর অত্যন্ত ভালো, আমি মনে করি সেই অনুসারে আমাদের যে বাজারটা যতটা ভাল হওয়া উচিত ছিল, ততটা ভাল হয়নি বা সেই বাজার এখনও আমারা পায়নি।

গত কয়েক বছর যদি আপনি বাজারকে পর্যবেণ করেন দেখবেন, কোনো সময় এক হাজার কোটি টাকা, দেড় হাজার কোটি টাকা টার্নওভার হয়। আবার কোনো সময় তিনশ কোটি টাকায় চলে আসে। এটা বাজারের স্থিতিশিলতার লণ না, এটা বাজারে ভালো লণ নয়। আমার কথা হলো, আজকে বাজারে যদি আমরা ব্যাংকের দিকে তাকাই, ব্যাংকের ইন্টারেস্ট অনেক কম। যদিও সঞ্চয়পত্রের রেট একটু বেশি তাই অনেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছে। তাছাড়া বিনিয়োগের আর জায়গা কোথায় শেয়ার বাজার ছাড়া?

বাজারে আশঙ্কার প্রশ্নে আমি মনে করি, এই বাজারে যদি দুই হাজার কোটি বা আড়াই হাজার কোটি টাকা টার্নওভার হয়, তাহলেও ভয়ের কিছু নেই। এটা বাবল এন্ড বাস্ট হওয়ার মত কিছু নয়। ২০০৯-১০ সালে বাজার কেন বাবল হয়েছিল, কেন বাস্ট হয়েছিল সেটা বুঝতে হবে। নয় দশে ব্যাংকের বড় ধরণের একটা বিনিয়োগ ছিল। ব্যাংক ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেছিল পুঁজিবাজারে। এবং মার্জিন লোনের বড় ধরণের অপব্যবহার হয়েছে। কেউ এক লাখ টাকা জমা দিয়েছে, তাকে পাঁচ লাখ টাকাও মার্জিন লোন দিয়েছে। এবং পারচেজ পাওয়ার বলে একটা কথা ছিল সে সময়। একজন লাখ টাকা দিয়েছে, তাকে ওয়ান ইসটু ওয়ান রেশিওতে আরো এক লাখ টাকা মার্জিন লোন দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে দুই লাখ টাকার শেয়ার কেনা হলো, শেয়ারের দাম বেড়ে গেল আর পারচেজ পাওয়ারও বেড়ে পাচ লাখ টাকা হলো। আর এভাবে পারচেজ পাওয়ারের উপর লোন দিতে দিতে তাকে পাচ লাখ টাকা লোন দিয়ে দিল ব্যাংক। তাতে দেখা গেছে ওই বিনিয়োগকারীর ইকুইটি জিরো হয়ে গেছে। আর সে কারণে যেটা হওয়ার সেটাই হয়েছে।

কিন্তু আজকে যদি সেই পোপটের সাথে তুলনা করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন আগের সেই সিস্টেমে মার্জিন লোনও নেই। আর ব্যাংকগুলো ইচ্ছা করলেও তার লোনের সীমার বাইরে যেতে পারবে না। কারন এগুলো একেবারে সেট করে দেয়া হয়েছে। আপনারা জানেন, এখন ব্যাংকগুলো তার পেইড-আপ ক্যাপিটালের ২৫% এর বেশি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে না, তার ডিপোজিটের ২৫% নয়। আগে যদি এক হাজার কোটি বিনিয়োগ করতে পারতো, এখন সেখানে আড়াইশ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারে শেয়ারবাজারে। অনেকে বিনিয়োগ করে আছেন, ইচ্ছা করলেও তার বিনিয়োগটাকে সীমার বাইরে নিতে পারছেন না। কারণ এটাকে ভালভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। মার্জিন লোনকে ভালভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। এটাকে ব্যাত্যয় ঘটানোর সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত আমি মনে করি সবাই আগের চেয়ে সচেতন। দেখবেন একটি শেয়ারের দাম ক্রমাগত বাড়ে না। এখন একটু দাম বাড়লে অনেকে বিক্রি করে দেয়। আগে বিশেষ করে নয়-দশে শেয়ারের দর বাড়লেও বিক্রি করতো না, ধরে রাখতো। একশো টাকার শেয়ার পাঁচশ টাকা হয়েছে তবুও বেচতে চাইনা, ধরে রাখে। উনি পাচ হাজার টাকা পর্যন্ত অপো করেছেন। তাতে শেয়ার সংখ্যা কমে গিয়েছিল। ডিম্যান্ড এবং সাপাইয়ের মধ্যে বড় ধরণের গ্যাপ হয়েছিল। কিন্তু এখন তা নেই বললেই চলে। এজন্য এখনকার বাজারে বাবল বা বাস্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

শেয়ারবাজারকে যদি আপনি ভাল করতে চান, বাড়াতে চান বা সম্প্রসারিত করতে চান, তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগের জন্য যে ফান্ডটা দরকার সেটা আপনাকে বাজার থেকে নিতে হবে। এবং শুধু প্রাইভেট সেক্টর না, সরকারকেও টাকা সংগ্রহ করতে হবে পুঁজিবাজার থেকে। আমি মনে করি, সরকারকেও গুরুত্ব দিতে হবে পুঁজিাবাজকে। সরকারের হাতে অনেকগুলি প্রজেক্ট আছে। অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্যাস বিদ্যুত পাওয়ারের অনেকগুলো প্রজেক্ট, পদ্মা যমুনা সেত যেখান থেকে টোল পাওয়া যায়, অনেক সঞ্চালন লাইন আছে। এগুলোকে করপোরেটাইজ করে, কোম্পানি করে জনগনের হাতে শেয়ার ছেড়ে দিতে পারেন। তাতে করে যে টাকাটা হবে, তা দিয়ে আবার ওই কোম্পানিগুলোর আরো সম্প্রসারন করা যেতে পারে। সরকারের হাতে যে শেয়ারগুলি আছে, আমি মনে করি এ শেয়ারগুলি ধরে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আবার এটাও বলা হচ্ছে না যে, সরকার শতভাগ শেয়ার ছেড়ে দিক। সরকার ইচ্ছা করলে ২০ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত শেয়ার ছেড়ে দিতে পারে। এতে করে জবাবদিহিতা বড়বে বলে আমি মনে করি। কারণ একটি প্রাইভেট কোম্পানির চেয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানির জবাবদিহিতা অনেক বেশি। লিস্টেড কোম্পানিকে আইন-কানুন মেনে তার বুকস্ অব অ্যাকাউন্টস তৈরি করতে হয়। প্রাইভেট কোম্পানিতে আপনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। কিন্তু লিস্টেড কোম্পানিতে যা-ই দেয় না কেন, যা প্রকাশ করুক না কেন তার একটা যৌক্তিকতা থাকতে হবে। কোম্পানির প্রত্যেকের জবাবদিহিতা আছে। আপনিতো জানেন, ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট হয়েছে এবং অল্প কিছুদিন আগে কাউন্সিলও গঠিত হয়েছে। অতএব প্রত্যেকটা অডিটর, যারা ব্যালান্সসিট তৈরি করবে তাদেরকেও জবাবদিহি করতে হবে। কাজেই সবদিক থেকেই লিস্টেড কোম্পানির জবাবদিহিতা বা অ্যাকাউন্টেবিলিটি অনেক বেশি।

ভালো কোম্পানিগুলো পুঁিজবাজারে আসতে চাইবে কেন? তাদেরতো লুক্রেটিভ কিছু দিতে হবে। তাদেরকে ভাল সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তাদেরকে বাজারে আনার জন্য ছাড় দিতে হবে। ছাড় দিতে গেলে সরকার মনে করে হয়তো ট্যাক্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আসলে তো বিষয়টা ঠিক না। সাময়িকভাবে হয়তো কিছুটা কম হবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সরকার লাভবান হবে। আপনি যদি মোবাইল ফোন কোম্পানি রবি কিংবা এয়ারটেলকে পুঁজিবাজারে আনতে চান, তাহলে তাদেরকে ভাল কিছু অফার করতে হবে। এতে তারা আকৃষ্ট হবে, তারপর বাজারে আসবে। আর যদি তারা বোঝে ওখানে গিয়ে আমার তেমন কোনো লাভ নেই, তাহলে তারা আসবে কেন, আসবে না। দেশের কোম্পানি যারা অনেক ভাল করছে, তাদের টাকার দরকার হলে তারা দেশের বাইরে থেকে খুবই কম ইন্টারেস্টে, অনেক সময় চার শতাংশেরও নিচে সুদহারে লোন নিচ্ছে। অথচ পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে আগ্রহী হচ্ছে না। আর পুঁজিবাজারে আসলে জাবাবদিহিতা বাড়াতে হয়, সেকারণেও অনেকে আসতে চায় না। আবার এটাও ঠিক, পুঁজিাবাজারে আসার কারণেই কোম্পানিগুলোর এক্সপানসান হয়েছে। তারা ভালও করে। তাদের মধ্যে গুড গভার্ন্যান্স বৃদ্ধি পায়। তাদের মধ্যে একটা করপোরেট কালচার গড়ে ওঠে, যেটা খুবই দরকার। আপনি ভারতের দিকে তাকান। ভারতে এ টু জেড, যে কোম্পানিরই অর্থ দরকার, তারাই বাজার থেকে সংগ্রহ করে। ভারতে হাজারো মিউচুয়্যাল ফান্ড গড়ে উঠেছে। বাজারকে স্থিতিশীল করতে মিউচুয়্যাল ফান্ড খুবই গুরুত্বপূর্ন। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, ভাল পোর্টফোলিও ম্যানেজারদের নিয়ে অনেক মিউচুয়্যাল ফান্ড গড়ে উঠেছে, যারা ওদের বাজারকে ভিষনভাবে স্থিতিশীল করেছে। আমেরিকাতেও একই রকম। ইউরোপেও একই রকমভাবে মিউচুয়্যাল ফান্ড ব্যাপক ভুমিকা রাখছে। আমাদের এখানে প্রথম দিকে মিউচুয়্যাল ফান্ডগুলো যেভাবে অব্যবস্থাপনা হয়েছে, তার কারণে মিউচুয়্যাল ফান্ড-এর ওপর আস্থা কমে গেছে। এখন একটু একটু করে সেসব বাধা কাটিয়ে কিছু মিউচুয়্যাল ফান্ড বাজারে আসছে। আমি মনে করি, সততার সাথে, দতার সাথে, স্বচ্ছতার সাথে, পেশাদারিত্বের সাথে যারা বিনিয়োগকারির স্বার্থ বিবেচনা করে যেসব মিউচুয়্যাল ফান্ড পরিচালন করবে এবং বাজারে আনবে ততই বাজারের জন্য ভাল হবে। যেসব ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, যেসব ইন্সটিটিউট পোর্টফলিও করে, তারা যতবেশি সফল হবে বাজার ততবেশি উজ্জিবিত হবে।

আমাদের সেভিংস রেট প্রায় ত্রিশ। আমাদের বুঝতে হবে অনেকের হাতে টাকা আছে। তারা বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে না। নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশিদের হাতে প্রচুর টাকা আছে। তারাও সুযোগ পাচ্ছে না। এগুলোকে আপনি কাজে লাগাতে পারেন বা বিনিয়োগ করতে পারেন একমাত্র ক্যাপিটাল মার্কেটে। আমি মনে করি আমাদের এই পুঁজিবাজারে মাত্র একটি আইটেম, ইকুইটি বা শেয়ার। আপনার তো অপশন থাকতে হবে। বন্ড থাকতে হবে, এস এমই থাকতে হবে। ছোট ছোট কোম্পানি বাজারে থাকতে হবে। ওটিসি মার্কেটকে স্ট্রং করতে হবে। ছোট ছোট কোম্পানি ওটিসিতে আসবে বা এসএমইতে আসবে তারপর মূল মার্কেটে যাবে। এ ধরণের সুযোগ সুবিধা থাকতে হবে। আমার মন চাইল আমি ইকুইটি মার্কেটে থাকবো না, আমি বন্ড মার্কেকে যাব। আবার চাইলে আমি এসএমই মার্কেটে যাব। এ ধরণের নানান অপশন থাকতে হবে। আমাদের মার্কেটে তা নেই। আমার এখানে পোশালো না আমি মিউচুয়্যাল ফান্ড-এ বিনিয়োগ করলাম। মিউচুয়্যাল ফান্ড-এ বিনিয়োগ মানে ঘুরে ফিরে পুঁজিবাজারেই বিনিয়োগ করা। কেননা মিউচুয়্যাল ফান্ড বেশিরভাগ ফান্ডই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে। তাদের মূল ফোকাস পুঁজিবাজারে। একেবারেই পুরাটা যে তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে তা কিন্তু না। তবে বেশিরভাগ সময়ই তারা বাজারে বিনিযোগ করে। এসব মার্কেট উন্নয়ন করতে হলে দরকার কোঅর্ডিনেশন, সমন্ময় দরকার।

বন্ড মার্কেটটার উন্নয়ন করতে হলে স্টক এক্সচেঞ্জ, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ একটা কমিটি লাগবে। একটা আগ্রহ লাগবে, উদ্যোগ লাগবে, ইনিশিয়েটিভ লাগবে। যত ভালো ইনিশিয়েটিভ আপনি নিতে পারবেন, তত ভালো কাজ হবে। কিন্তু আমাদের এখানে একটা মিটিং হলে আর মিটিং হয় না। একটা কাজ এগিয়ে গেলে আর বাকি কাজগুলো এগোয় না। এখন আমাদের ফাইন্ড আউট করতে হবে, কেন সরকারি শেয়ার আসে না? কেন মাল্টিন্যাশনাল শেয়ারগুলো ইন্টারেস্টেড হচ্ছে না? সরকার যে কাজগুলো করছে, পাওয়ার প্রোজেক্ট করছে, ইনফ্রাস্ট্রাকচার করছে, বড় বড় ব্রিজ করছে, জ্বালানি খাতে বড় বড় প্রোজেক্ট করছে, ভালো ভালো প্রোজেক্ট করছে, সেগুলো সরকার কেন উৎসাহ বোধ করছে না বাজারে নিয়ে আসার জন্য? ডিবেটটা কোথায়? তারপর অন্যান্য কাজগুলোও কেন ত্বরান্বিত হচ্ছে না? একটু দেখতে হবে, অ্যানালাইসিস করে বের করতে হবে, আমাদের দুর্বলতা কোথায়? কোথায় আমরা পারছি না? কেন পারছি না? এগুলো বের করতে হবে।

আমি মনে করি, মাননীয় অর্থমন্ত্রীও চান, সচিব মহোদয়রাও চান, হয়তো অতটুকু উদ্যোগ নিতে চান না। অতটা উদ্যোগী হয়ে কাজটা করতে চান না। তো, উদ্যোগী হয়ে কাজটা করার জন্য যে টিমটা দরকার ঐ ধরণের একটা টিম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ছোট ছোট পেইড আপ কোম্পানিগুলোকে আমরা এসএমই বোর্ডে নিয়ে যাবো। কারণ এটার রিস্ক আপনারা তো দেখেনই। ছোট ছোট কোম্পানি একটু টান মারলেই তো শেয়ারের দাম বেড়ে যায়। এগুলোকে আমরা এসএমই বোর্ডে নিয়ে যাবো। ওখানে আবার রেস্ট্রিকশন আছে। এসএমইতে যারা ট্রেড করবে, তারা ইন্ডিভিজ্যুয়াল ট্রেড করতে পারবে না। করতে পারবে পোর্টফোলিও যারা করে, করতে পারবে মিউচুয়াল ফান্ড, করতে পারবে ডিলাররা। সাধারণ বিনিয়োগকারী করতে পারবে না, বিনিয়োগকারীর যদি করতে হয়, তাকে পোর্টফোলিওর মাধ্যমে করতে হবে। বিনিয়োগকারীর যদি করতে হয়, তাকে আরেকজনের মাধ্যমে করতে হবে। কারণ অনেক রিস্ক, ছোট কোম্পানি তো, টানা-হ্যাঁচড়া করলেই অনেক উঠে যায়। তাই এখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীর কোনও সুযোগ নেই।

আমরা চাচ্ছি যে, যার টাকা থাকবে, সে-ই শেয়ার কিনতে পারবে, যার শেয়ার থাকবে, সে-ই শেয়ার বিক্রি করতে পারবে। আপনার শেয়ার নাই, কিন্তু বিক্রি করে দিলেন, পরে কিনলেন না।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের যে ৬০% শেয়ার সরকারের হাতে রিজার্ভ করা আছে, এটা থেকে আমরা ২৫% স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারের কাছে বিক্রি করবো। স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হলো তারাই, যারা এসে আপনার গ্রোথটাকে বাড়াবে। এমন একটা পার্টনার আসলো, এমন একটা বিদেশের এক্সচেঞ্জ আসলো, যার কারণে আপনার ইমেজ বেড়ে গেল। অনেক বেশি তারা আপনাকে রেজাল্ট দিতে পারে, অনেক বেশি তারা আপনাকে সাহায্য করতে পারলো।

স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হতে পারে বাইরের একটা এক্সচেঞ্জ অথবা বাইরের একটা বড় আইটি কোম্পানি বা বাইরের একটা বড় ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি। বড় বড় কোম্পানি, যারা আসলে স্টক এক্সচেঞ্জের ইমেজ বাড়বে এবং অনেক প্রোডাক্ট তারা নিয়ে আসবে, তারা আমাদের অনেক সহযোগিতা করবে। তাদের কারণে আমাদের এক্সচেঞ্জ একটা ইন্টারন্যাশনাল আঙ্গিনায় প্রবেশ করবে। সেই হিসেবে আমরা চেষ্টা করছি এবং আমরাও আবার আমাদের ফিউচারকে যদি দেখাতে না পারি যে, মার্কেট আজকে এই অবস্থায় আছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ; আগামী পাঁচ বছরে এটা কোথায় যাবে। সেটাও যদি আমরা ফোকাস করতে না পারি, ভালো ভাবে দেখাতে না পারি, তাহলে তো কোনও স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারও আসবে না। তারা তো এখানে ইনভেস্ট করবে। তারাও তো চাইবে, আমরা যে এখানে ইনভেস্ট করছি, আমরা যে এখানে ব্রেন দেবো, আমরা যে এখানে ফান্ড দেবো, আমরা যে এখানে ঢুকবো তো আমাদের ভবিষ্যতটা কি? আমরা এখান থেকে কি পাবো? তো তারা যদি দেখে যে, না এটা তো খুব ভালো যে, বাংলাদেশের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ইজ গোয়িং। এটা তো দেখা যাচ্ছে যে, আগামী পাঁচ বছরে বিশাল একটা ব্যাপার দাঁড়াবে। একটা বড় কিছু হবে, অনেক প্রশস্ত হবে, অনেক বড় হবে। অনেক কিছু হবে, অনেক প্রোডাক্ট বাড়বে, অনেক আয় বাড়বে। তখন তারা এখানে আসলে আমাদেরও লাভ হলো, তাদেরও লাভ হলো। সে ধরণের পরিস্থিতি আমাদের সৃষ্টি করতে হবে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার পাওয়া আমাদের জন্য ডিফিকাল্ট হবে।

মনে করেন, আজকে একটা ব্যাংক স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে ৫% শেয়ার কিনে নিলো। ২৫% তো দরকার নাই, ২৫% প্রভিশন করা আছে, কিন্তু ৫% ই নিলো। তো ওই ব্যাংকটা আমার গ্রোথে কি সাহায্য করবে? ওই ব্যাংকের কি অভিজ্ঞতা আছে? ওই ব্যাংকের স্টক মার্কেট সম্বন্ধে কি অভিজ্ঞতা আছে? ও আসলে আমার ইমেজ কি বাড়বে? আজকে মালয়েশিয়ান এক্সচেঞ্জ যদি আমাদের সাথে আসে, সাংহাই এক্সচেঞ্জ যদি আমাদের সাথে আসে, আজকে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (বোম্বে) যদি আমাদের সাথে আসে, তো আমাদের ইমেজ বাড়লো না? কারণ তাদের অভিজ্ঞতা, তারা তো অনেক বড়। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড অনেক বড় বড় এক্সচেঞ্জ, তো তারা সাথে থাকলে আমার ইমেজ বাড়লো না? আমি অনেক ছোট, বড় শক্তিশালী একটা মানুষ যদি আমার পার্টনার হয়, তাহলে আমার ইমেজ অনেক বেড়ে গেল না? সেটাই করতে হবে। সেটা পাওয়ার জন্য আমাদের কাজ করতে হবে, ওই কাজগুলো কমপ্লিট হলেই আমি মনে করি, আমরা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার পাবো। ঠিক তার আগে সাকসেসফুল হওয়া ডিফিকাল্ট। তারাও বলে, আপনারা আপনাদের কাজগুলো তাড়াতাড়ি এগিয়ে নেন, যাতে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার আপনাদের প্রতি অ্যাট্রাক্টিভ হয় যে, আপনাদের ফিউচার অনেক ভালো। তারাও আমাদের বলে, তাড়াতাড়ি কাজগুলো করার জন্য তারা আমাদের বলছে।

আমার কথা হলো যে, প্রথমে আমাদের এক্সচেঞ্জকে আরও অপশন মার্কেটে যেতে হবে। এক্সচেঞ্জকে শুধু ইক্যুইটি মার্কেটে থাকলে হবে না। এক্সচেঞ্জকে তার বন্ড মার্কেট চালু করতে হবে। তার এসএমই চালু করতে হবে। কিয়ারিং কোম্পানি চালু করতে হবে। তার ওটিসি মার্কেটকে খুব স্ট্রং করতে হবে। তারপর আরও বেশি ফিউচার মার্কেট তৈরি করতে হবে। তারপর ডে সেটেলমেন্ট চালু করতে হবে। এগুলো তাকে করতে হবে। তারপর চেষ্টা করতে হবে যে, আরও ভালো ভালো প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসা। বিশেষ করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে নিয়ে আসা এবং সরকারের অনেকগুলো ভালো ভালো প্রোজেক্ট আছে, লুক্রেটিভ প্রোজেক্ট আছে, সেই প্রোজেক্টের একটি অংশের টাকা জনগণ থেকে নিয়ে এই ক্যাপিটাল মার্কেটকে শক্তিশালী করা, এই কাজগুলো আমাদের করতে হবে।

বিনিয়োগকারীদের প্রতি সবসময়ই আমি বলি, আপনি দেখে এবং বুঝে বিনিয়োগটা করবেন। আপনি ইমোশনালি কোনও বিনিয়োগ করবেন না। আর আপনি যদি বিনিয়োগ অ্যানালাইসিস করতে না পারেন, আপনি পোর্টফোলিওতে যান। অনেক ভালো ভালো ইন্সটিটিউশন পোর্টফোলিও করে, তাদের অনেক অভিজ্ঞ লোক আছে। তারা অনেক অ্যানালাইসিস করে এবং তারা অনেক সাকসেসফুল। আমার মনে হয় আপনি মাথা না ঘামিয়ে, যেটা আপনি পারবেন না সেটা আমি অনুরোধ করবো, পোর্টফোলিও যারা করে, টাকা আপনি তাদেরকে দেন। তাদেরকে আপনি পোর্টফোলিও তৈরি করতে বলেন। আপনি নিজে মাথা ঘামাবেন না, ইমোশন দ্বারা আপনি পরিচালিত হবেন না।
আমাদের তরুণ প্রজন্ম, আইটি কোম্পানি বা অনেক ছোট ছোট কোম্পানি গঠন করে কাজ করার চেষ্টা করছে, তাদের ফান্ড প্রয়োজন। এসএমই বা স্মল ক্যাপ বোর্ডটা যদি এরই মধ্যে হয়ে যায়, তাহলে আমি মনে করি, এই বোর্ডের মাধ্যমে এসকল ছোট ছোট কোম্পানী তাদের ফান্ড রেইজ করতে সুবিধা হবে। একটা আইটি কোম্পানি করলো, ৫-১০ কোটি টাকা, এটা নিয়ে তো সে এখানে আসতে পারবে না। এসএমই বোর্ড থেকে ফান্ড ক্রিয়েট করে তখন সে এগিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু লেনদেন বা ট্রেডিং করাটা তার মূল ব্যবসা হতে পারে না। বরং এই তরুণরা একত্রিত হয়ে যখন একটা কোম্পানি ফর্ম করে, তখন এই টাকাটা সে কোথাও থেকে পায় না। তখন তার জন্য এই পুঁজিবাজার অত্যন্ত ভালো। সততার সাথে, সেখানে যেন কোনও ধরণের ম্যানিপুলেশন না হয়, সেখানে যাতে কোনওটা বাড়িয়ে বলা না হয় বা কোনওটা কমিয়ে বলা না হয়। সঠিক তথ্যটা এবং সবসময় একটা পজিটিভ ধারণা নিয়ে এই ব্যাপারটায় যেন একটা পজিটিভনেস থাকে। আমরা তো সমালোচনা করতে পছন্দ করি অনেক বেশি। আমি মনে করি, সমালোচনা না করে দুর্বল দিকটা তুলে ধরে যদি সমস্যার সমাধান দিতে পারেন, তাহলে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারবো।

মো. রকিবুর রহমান
পরিচালক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড