এটুআই আইল্যাব তরুণদের উদ্ভাবনী ধারণা বাস্তবায়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখছে

রাজশাহীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের ইলেকট্রিশিয়ান মো. আনোয়ার হোসেন (৩৮)। একটি সিলিন্ডার ব্যবহার করে একযোগে একাধিক রোগিকে সেবা প্রদানের জন্য ‘সেন্ট্রালাইজড নেবুলাইজার সিস্টেম’ তৈরি করেছেন, যা নিঃসন্দেহে একটি অসাধারণ কাজ। এই সিস্টেমের অধীনে হাসপাতালের বিভিন্ন বিছানার সাথে ৩০টি পর্যন্ত নেবুলাইজিং পাইপ থাকতে পারে। প্রতিটি নেবুলাইজারের এবং ডোজগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে এই ডিভাইস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

এই নেবুলাইজার বেশ কয়েকজন রোগিকে একযোগে চিকিৎসা দিতে পারে। একারণে গুরুতব রোগিকে চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। এটি হাসপাতালগুলোতে বিশেষ করে জরুরী স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে একটি সাশ্রয়ী এবং কার্যকর পদ্ধতি। নেবুলাইজেশন সিস্টেমের মাধ্যমে গুরুতর শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সময়ের অপচয় রোধ করতে এই পদ্ধতিটি চালু করা হয়েছে।

আনোয়ার হোসেন বলেন ‘আমি রাজশাহী শহরের ডিঙ্গাডোবাতে আমার বাসায় ইলেক্ট্রো-মেডিকেল কোর্সে ডিপ্লোমা স্তরের শিক্ষার্থীদের পড়াতাম। ২০১৪ সালে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আমার দুই ছাত্রের থিসিসে কাজ করার সময় আমি সেন্ট্রালাইজড নেবুলাইজার সিস্টেম তৈরির ধারণা পেয়েছিলাম। পরে ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে রাজশাহীর একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে কর্মরত অবস্থায় চিকিৎসা সরঞ্জাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করি।

তিনি বলেন,“আমি হাসপাতালে নেবুলাইজেশনের জন্য শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় আক্রান্ত রোগিদের দীর্ঘ সারি দেখেছি। এই দৃষ্টিকোন থেকেই যদি একটি যন্ত্রের সাহায্যে একাধিক রোগিকে সেবা দেয়ার বিষয়টি মাথায় আসে। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় আক্রান্ত রোগিদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে এটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ মনে করেই কাজটি শুরু করি।”

আনোয়ার তার দুই শিক্ষার্থী-রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দীপক কুমার শীল এবং সোহেল রানাকে নিয়ে এই নেবুলাইজার সিস্টেম তৈরির ধারণাকে পরিপূর্ণ রূপ দেন। তিন সদস্যের দলটি তাদের এই ধারনা এটুআই আয়োজিত বার্ষিক ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা-২০১৪ তে উপস্থাপন করে। জেলা পর্যায়ে এবং পরে জাতীয় পর্যায়ে ১শ’টিরও বেশি উদ্ভাবনী ধারণার মধ্য থেকে এ ধারণা নির্বাচিত হয়েছিল।

আনোয়ার বলেন, “আমরা এটুআই ইনোভেশন ল্যাব থেকে সমর্থন পেয়েছি। তাদের সমর্থন এবং সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া আমরা আমাদের ধারণাটিকে বাস্তবে রূপ দিতে পারতাম না। এটুআই এর ইনোভেশন ল্যাব থেকে আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করে আমরা ২০১৪ সালে ঢাকায় এসেছিলাম এবং আমাদের কাজটি সুসম্পন্ন করতে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রযুক্তিগত পরামর্শ পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে এটুআই এর আর্থিক সহায়তায় আমরা কাজটি সম্পন্ন করি।”

এটুআই ইনোভেশন ল্যাব প্রযুক্তিগত, বিশেষ করে ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল ডিভাইস, ইন্টারনেট এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে সমাজের বড় সমস্যাগুলো মোকাবেলায় উদ্ভাবনী ধারণাগুলোকে খুঁজে বের করে সেগুলোর বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধরণের সহযোগিতা প্রদান করে। উন্নয়নমূলক চ্যালেঞ্জগুলোর জন্য অভিনব সমাধান এবং সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশী নাগরিকদের আকৃষ্ট ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে আইল্যাব ২০১৬ সাল থেকে কাজ শুরু করে।

সেন্ট্রালাইজড নেবুলাইজার সিস্টেম সম্পর্কে সাথে আলাপকালে এটুআই’র ডিভাইস উদ্ভাবন বিশেষজ্ঞ তৌফিকুর রহমান বলেন, বর্তমানে হাসপাতালগুলো একটি নেবুলাইজার ডিভাইস ব্যবহার করে একজন রোগিকে চিকিৎসা দিতে পারে। এ কারণে রোগিদের দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হয়। তিনি বলেন, সেন্ট্রালাইজড নেবুলাইজেশন সিস্টেম এক সাথে ৩০ জন রোগিকে সেবা দিতে সক্ষম। এই পদ্ধতিতে একটি ডিভাইস থেকে ৬টি নোড ব্যবহার করা যায় এবং প্রত্যেক নোড থেকে বেশ কয়েকজন রোগিকে সেবা দেয়া যায়।

তিনি বলেন, ‘আমরা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সফলভাবে এই পদ্ধতি ব্যবহারের পাইলটিং সম্পন্ন করেছি। গাজীপুরের চারটি হাসপাতালেও করা হয়েছে। হৃদরোগ ইনস্টিটিউট এবং বেশ কয়েকটি হাসপাতাল বর্তমানে এই সিস্টেমটি চালু করছে।’ তিনি বলেন, এই সিস্টেম গত কয়েক বছরে ২,৪৬,০০০ এরও বেশি রোগিকে সেবা দিয়েছে এবং এটি এখনও ন্যূনতম রক্ষণাবেক্ষণ খরচসহ সুচারুভাবে চলছে।

তৌফিকুর রহমান বলেন, সম্প্রতি তারা স্থানীয় প্রশাসন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং বেসরকারি খাতের যৌথ সহযোগিতায় নওগাঁ সদর হাসপাতালে সেন্ট্রাল নেবুলাইজার সিস্টেম সফলভাবে চালু করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা স্থানীয় সরকারের প্রশাসনিক নির্দেশনা এবং বেসরকারি খাতের সহায়তার অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এই উদ্ভাবনের জন্য দেশব্যাপী বাস্তবায়ন পরিকল্পনা চালু করেছি।’

তিনি বলেন ‘নওগাঁ সদর হাসপাতালে আমাদের উদ্ভাবিত নেবুলাইজার সিস্টেম একসাথে ৩০ জন রোগিকে এবং দিনে একাধিকবার নেবুলাইজ করতে পারে। এটি তুলনামূলকভাবে সস্তা। ব্যবহার করা ও সহজ এবং প্রায় রক্ষনাবেক্ষনমুক্ত পদ্ধতি।’ তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক করোনা রোগিকে পৃথকভাবে নেবুলাইজার দেয়ার জন্য এই নেবুলাইজার একটি ভাল বিকল্প এবং এটি একটি হাসপাতালে একাধিক রোগিকে একযোগে নেবুলাইজার সেবা দিতে পারে।’

রহমান বলেন, আইল্যাব মূলতঃ উদ্ভাবন এবং চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্বতন্ত্র উদ্ভাবক। শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছায় এবং সম্ভবনাময় উদ্ভাবকরা একটি উদ্ভাবন তহবিল থেকে ‘সিড ফান্ডিং’ পান। আইল্যাব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি মেকার ল্যাব ব্যবহারের সুযোগ পান এবং শিল্প বিশেষজ্ঞ এবং শিক্ষাবিদদের পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ পান। তিনি বলেন, ইনকিউবেশন প্রক্রিয়াটি তরুণ উদ্ভাবকদের একটি প্রোটোটাইপকে ব্যবহারিক এবং কার্যকর সমাধানে পরিণত করার দিক নির্দেশনা দেয়। তথ‌্য-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান