গ্রামীণ নারীদের স্বচ্ছলতা, সচেতনতা ও উদ্যোক্তা তৈরিতে অবদান রাখছে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প

বাংলাদেশ মূলত একটি গ্রাম প্রধান দেশ। দেশের ৬৮ হজার গ্রামের উন্নয়নের ওপরই মূলত নির্ভর করছে দেশের উন্নয়ন। সুতরাং গ্রামের উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন একেবারেই অসম্ভব। দেশের সর্বত্রই এখন উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। তবে তারপরও গ্রামে এখনো দরিদ্র লোকের বাস বেশি। দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য সরকার গ্রামের পাশাপাশি সেখানকার নারী সমাজের ওপড় জোড় দিয়েছে বেশি। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য এ প্রকল্প হলেও গ্রামের দরিদ্র, অস্বচ্ছল নারী সমাজকে স্বচ্ছল করে তুলে ক্ষমতায়নের প্রতি বেশি জোড় দিয়েছে সরকার। মূলত এ প্রকল্পে গ্রামের অস্বচ্ছল, দরিদ্র নারীরাই বেশি লাভবান হচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষ করে গ্রামের অস্বচ্ছল, দরিদ্র নারীদের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতেই সরকারের এ মেগা প্রকল্প। ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প আজ শক্ত ভিতের ওপড় দাঁড়িয়ে। জানান দিচ্ছে সমৃদ্ধির। উপকারভোগী নারীদের আর্থিক বুনিয়াদ সুসংহত হয়েছে। তাদের বাড়িতে যেন দুধে-ভাতে বাঙালী আর মাছে-ভাতে বাঙালী’র পরিবেশ। প্রকল্প কার্যক্রমে দুই-তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অগ্রগামী হয়েছেন নারীরা। এ প্রকল্পের মূল কথা ‘সমবায়’।
ভিশন-২০২১, ভিশন-২০৪১ এবং স্বপ্ন সোপান এই তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ নামে ব্র্যান্ডিং করা দশটি উদ্যোগের মধ্যে সবার শীর্ষে ‘আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প’। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য-অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তহবিল গঠন ও পারিবারিক খামারের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই উন্নয়ন। আর এই লক্ষ্য অর্জনের কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর অবস্থান।
এই প্রকল্পে গঠিত গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতির প্রত্যেক সদস্য মাসে দুইশত টাকা সঞ্চয় জমা দিলে এর বিপরীতে সরকার সমপরিমান বোনাস দেন এবং একই সাথে সরকার বাৎসরিক দেড় লাখ টাকার আবর্তক তহবিল প্রদান করে। এভাবে দুই বছরে সমিতির তহবিল প্রায় নয় লাখ টাকায় উন্নীত হয় এবং তহবিলের মালিকানা স্থায়ীভাবে সমিতির সদস্যদের। সদস্যরা সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে আয় বর্ধক কর্মকান্ডে বিনিয়োগ করেন। নিয়মিত উঠান বৈঠক করে সাপ্তাহিক কিস্তিতে নয় বরং সুবিধাজনক সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন সদস্যরা। বেশী পরিমান অর্থ প্রয়োজন হলে সমিতি থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত মাত্র পাঁচ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ঋণ নেয়া যায়। ইউনিয়নের ওয়ার্ড বা গ্রাম পর্যায়ে ৪০ জন মহিলা এবং ২০ জন পুরুষকে নিয়ে এই সমিতি গঠন করা হয়।
‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প নাটোর জেলা সমন্বয়কারীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত জেলায় মোট ৯৬৫টি সমিতি গঠন করা হয়েছে। এসব সমিতির ৩৭ হাজার ৭৮৪ জন সদস্য প্রায় ১১ কোটির অধিক টাকা জমা করেছেন। এই জমার বিপরীতে সরকার সদস্য পর্যায়ে প্রায় প্রায় সাড়ে দশ কোটি এবং সমিতি পর্যায়ে প্রায় ২০ কোটি ২৪ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। সমিতির সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে প্রায় অর্ধ শত কোটি টাকা।
সমিতির নারী সদস্যবৃন্দের আর্থিক বুনিয়াদ আরো সুসংহত করতে চলছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কার্যক্রম। প্রকল্পের উপজেলা সমন্বয়কারীর কার্যালয় ব্যাংকের কার্যালয় হিসেবে কাজ করছে। সমিতির মোট তহবিল দুই বছরে নয় লাখ টাকা হলে ঐ তহবিল স্থানান্তরিত হয় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে। একজন সদস্য সমিতি থেকে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। সমিতি ঋণের সার্ভিস চার্জ আট শতাংশ হলেও ব্যাংক ঋণের সার্ভিস চার্জ মাত্র পাঁচ শতাংশ। বলাই বাহুল্য ঋণের বেশীরভাগ পাচ্ছেন বিভিন্ন সমিতির নারী সদস্যবৃন্দ।
নাটোর সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের গোয়ালদিঘী-কৃষ্ণপুর গ্রাম উন্নয়ন সমিতির একজন সফল উদ্যোক্তা আমেনা খাতুন। সমিতি থেকে প্রায় সাত বছর আগে দশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু করেছিলেন মুড়ি ভাজা ব্যবসায়। জেলার বৃহত্তম ডালসড়ক মুড়ির হাটের প্রতিদিনের বিক্রেতা আমেনা খাতুনের ঋণ এখন পঞ্চাশ হাজার টাকা। আর তার মূল মুড়ি ব্যবসায়ের পরিধি বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়িতে হাঁস মুরগী ছাগলের খামার করেছেন। বিয়ে দিয়েছেন চার মেয়ের। আমেনা খাতুন বলেন, সমিতি করতে যেয়ে সংসারে শুধু সচ্ছলতাই আসেনি, সচেতনতাও এসেছে। এখন স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করি, বিশুদ্ধ পানি পান করি এবং অন্যদেরও সচেতন করি।’
একই এলাকার মোবারক হোসেনের ঋণও পঞ্চাশ হাজার টাকা। তিনি বলেন, এই গ্রাম এখন পরিচিতি পেয়েছে মুড়ির গ্রাম হিসেবে।
ভেষজ সবুজ বিপ্লব ঘটেছে দেশের একমাত্র ভেষজ গ্রাম লক্ষিèপুর-খোলাবাড়িয়া ইউনিয়ন জুড়ে। এই ভেষজ গ্রামে এ্যালোভেরাসহ বিভিন্ন ভেষজের বাৎসরিক উৎপাদন প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় ‘আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের’ সমিতিভূক্ত হয়ে অসংখ্য উদ্যোক্তা সাফল্যগাঁথা তৈরী করে চলেছেন। পিছিয়ে নেই নারী উদ্যোক্তারা। খোলাবাড়িয়া গ্রাম উন্নয়ন সমিতির ফালানী বেওয়া তাদের মধ্যে অন্যতম।
গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর এলাকার দুদুগাড়ি গ্রাম মৃৎশিল্পে সমৃদ্ধ। গ্রামের অন্তত ৫০ ঘরে রয়েছেন মৃৎশিল্পের কারিগর। এই এলাকার ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পভূক্ত সমিতির সদস্য স্বরসতি রাণী পাল ও লক্ষিèরাণী পাল জানান, বংশপরম্পরায় আমরা হাড়ি-পাতিল, দইয়ের পাত্রসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরী করছি। আমাদের এই কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প। সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে উৎপাদনের পরিধি বাড়াতে পেরেছি।
চলনবিলে মাছ ধরতে খোলসুনের ব্যাপক চল রয়েছে। গুরুদাসপুর উপজেলার সোনাবাজু পূর্বপাড়া আর যোগেন্দ্রনগর উত্তরপাড়া গ্রাম যেন খোলসুন তৈরির গ্রাম। এই দু’টি গ্রামে একাধিক সমিতি গঠন করে খোলসুন তৈরীতে অগ্রগামী নারীদের ঋণ দেওয়া হয়েছে। সোনাবাজু পূর্বপাড়া গ্রামের রানী বেগম বলেন, তিন বছর থেকে সমিতি থেকে ঋন নিচ্ছি। ঋণ নেওয়াতে বেশি করে খোলসুন তৈরীর কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারছি। এখন সপ্তাহে অন্তত ২০টি খোলসুন হাটে বিক্রি করা যায়। দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। একই কথা জানালেন যোগেন্দ্রনগর পূর্বপাড়ার আছিয়া বেগম।
আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের গুরুদাসপুর উপজেলা কার্যালয়ের সমন্বয়কারী মোছাঃ লুৎফুন নাহার বলেন, প্রচলিত বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি উপজেলার দুদপাড়া এলাকায় মৃৎশিল্প এবং সোনাবাজু ও যোগেন্দ্রপুর এলাকায় মাছ ধরার খোলসুন তৈরীতে এগিয়ে গেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার সমিতিগুলোর নারী সদস্যবৃন্দ।
আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প নাটোর সদর উপজেলার সমন্বয়কারী মোঃ মাজেদুর রহমান জানান, বিদ্যমান সমিতিগুলোর মনিটরিংসহ প্রকল্পের পরিধি বাড়াতে কাজ করছি আমরা। কিছু কিছু এলাকায় সমিতির নারী উদ্যোক্তাবৃন্দ এতটাই সফল হয়েছেন যে, ঐসব এলাকায় তাদেরকে অনুসরণ করে একই ধরণের উদ্যোগের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।
আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের জেলা সমন্বয়কারী মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, এই প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দরিদ্র্য জনগোষ্ঠির পারিবারিক পর্যায়ের দারিদ্র্যতা নির্মূল হবে। আর এই পারিবারিক দারিদ্র্যতা জয়ের লক্ষ্যে প্রকল্পের মাধ্যমে অগ্রগামী হয়েছেন নারীরা। নারীদের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের দারিদ্রতা দূর হলে বাংলাদেশ খুব সহজেই পৌঁছে যাবে সমৃদ্ধির সোপানে।