গ্রিড লাইন বেসরকারিকরণ ও এলপিজি পরিবহনে নদী ড্রেজিং জরুরি

নানা সংকট ও সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের শিল্প খাত। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্যাসের সমস্যাকেই শিল্প খাতের প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখছেন শিল্প বিশ্লেষকেরা। এই সংকট অতিক্রম করে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায় এবং কীভাবে শিল্প খাতকে উন্নয়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেসব বিষয়ে দৈনিক আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন-এবিটিভি’র সঙ্গে আলাপ করেছেন ইয়োথ গ্রুপ, শাহজিবাজার পাওয়ার ও প্যাট্রোম্যাক্স এলপিজির চেয়ারম্যান রেজাকুল হায়দার মনজু। আলোচনার চুম্বক অংশ তাঁরই জবানিতে প্রকাশ করা হলো।

ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই স্বীকার করতে হবে যে গত বছরের চেয়ে এ বছর ভালো যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর অন্যতম কারণ দেশের জ্বালানি সংকট, বিদ্যুতের সংকট ও গ্যাসের সংকট। এই তিন ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি হয়নি। বরং কোনো ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। যেমন গত বছর পর্যন্ত সরকারের সরবরাহকৃত গ্যাস দিয়েই চলেছে। কিন্তু এ বছর এলপিজি গ্যাস ব্যবহার করতে হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে এলপিজি ব্যবহার করতে হলে খরচ অনেক বেড়ে যায়। সুতরাং বলা যায়, এ বছর ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন সংকট তৈরি হলো।

এ ছাড়া জাতীয় সংকটও কিন্তু ব্যবসায় প্রভাব ফেলে। সম্প্রতি দেশে উগ্রবাদীদের যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তা দ্রুত দমন করতে না পারলে ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক বড় ধাক্কা খেতে হবে। বিদেশিরা ব্যবসা করতে আগ্রহী হবেন না। বিদেশি বায়াররা আসবেন না। আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যবসা-ই এক্সপোর্ট নির্ভরশীল। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ অতি জরুরি। এ জন্য জনগণকেও সতর্ক হতে হবে। তবেই এই সংকট ও সমস্যা দূর করা সম্ভব। তাহলে ব্যবসা ক্ষেত্রের সংকটও দূর হবে।

এ ছাড়া যে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকট রয়েছে, সেগুলো সমাধানেও সরকারের পদক্ষেপ নিতে হবে। যদিও বর্তমানে বিদ্যুৎ বেশ উৎপাদন হচ্ছে। এখন প্রয়োজন সঞ্চালন লাইন। এই লাইনে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছি। সরকর যদি বিদ্যুৎ খাতের মতো এই সঞ্চালন লাইনের দায়িত্বও প্রাইভেট সেক্টরে দিয়ে দেয়, তবে এ থেকে উত্তরণ সম্ভব।

গ্যাসের সংকটই মূল সমস্যা
এখন আমাদের দেশে যতটুকু বিদ্যুৎই উৎপন্ন হোক না কেন, তা যদি গ্রাম পর্যন্ত সঞ্চালন পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়, তবে বিদ্যুতের সমস্যা ৯০ শতাংশ কমে যাবে। কিন্তু গ্যাস সমস্যার সমাধানের এখনো কার্যত কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। ইন্ডাস্ট্রিতে বিদ্যুতের চেয়ে গ্যাসের প্রয়োজন বেশি। যদি গ্যাস দিয়ে জেনারেটর চালানো যায়, তবে উৎপাদন খরচ অনেকাংশে কমে যাবে। কিন্তু বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ নেই।

গ্যাস-সংকটের আপাতত সমাধান এলপিজি
প্রতিটি ইন্ডাস্ট্রিতে বয়লার চালাতে হয় গ্যাস দিয়ে। এখন গ্যাসের সংকটের কারণে যদি বিদ্যুৎ দিয়ে চালাতে হয়, তবে যে খরচ আসবে তাতে ব্যবসায়ীদের জন্য অতিরিক্ত চাপ হয়ে যাবে। বিদেশিদেরও টিকে থাকা সম্ভব নয়। এখন আপাতত বিকল্প হিসেবে এলপিজি গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে যদিও খরচ বাড়বে। তবে ধীরে ধীরে বায়ারদের থেকে বা পণ্যের ওপর থেকে অ্যাডজাস্ট করে নেওয়া যাবে। এলপিজি গ্যাস তরল আকারে বিদেশ থেকে ইমপোর্ট করা হয়। এখন সাতটি কোম্পানি বোতলজাত করে ব্যবসা করছে। এ রকমভাবে আমরাও বোতলজাত করার চিন্তা করছি। হয়তো ১ বছরের মধ্যে আমরাও এলপিজি গ্যাস দিতে পারব। এই প্রোজেক্টটা করা হবে মোংলা পোর্টের কাছে। এগুলো নদীর পাড়ে করলে সুবিধা হয়; তাই মোংলাতে করার সীদ্ধান্ত। জাহাজে করে এলপিজিগুলো ইমপোর্ট করতে হয়।

এলপিজিগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া থেকে ইমপোর্ট করা হয়। এরপর বোতল এ দেশেই তৈরি করা হয়। কারণ, বোতল ইমপোর্ট করতে হলে কস্ট অনেক বেশি পড়ে যায়।

বর্তমানে তিতাস যে গ্যাস সার্ভিস দিচ্ছে, তার সাথে এলপিজি অনেকটা সাপোর্ট দিতে পারবে। যদিও খরচ একটু বেশি হবে। যেমন একটি পরিবারের পুরো মাসে ২ হাজার টাকার গ্যাস লাগবে। তিতাসের গ্যাস এক বার্নার বা ২ বার্নার অনুযায়ী ফিক্সড করে দেওয়ার কারণে গ্যাসের অনেক অপচয় হচ্ছে। কিন্তু যখন কিনে ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহার অনুযায়ী মাস শেষে টাকা গুনতে হবে, তখন কিন্তু সতর্কতার সাথেই ব্যবহার করবে। প্রয়োজনমতোই চুলা অফ-অন করবে।

এলপিজি গ্যাস সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। দুর্ঘটনার যে ঝুঁকি রয়েছে, সে বিষয়েও এখন সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। তাই এলপিজি গ্যাস বিস্তারের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। আশা করা যায় আগামী দুই বছরের মধ্যে মানুষ পুরোপুরি এলপিজি-নির্ভর হয়ে পড়বে। এমনকি সরকারের দেওয়া গ্যাস পুরোপুরি বন্ধ করেও দেওয়া হতে পারে।

এলপিজি ইমপোর্টে সরকারের সহায়তা কাম্য
এলপিজি ইমপোর্টের জন্য সরকার যদি ইমপোর্ট রুটগুলো, অর্থাৎ নদীগুলো ড্রেজার করে, তবে এককালীন অনেক গ্যাস ইমপোর্ট করা যাবে। তাহলে খরচও কমে যাবে। গ্রাহককেও কম মূল্যে সরবরাহ করা যাবে।

আসলে জ্বালানি নিরাপত্তা হচ্ছে প্রকৃতির দেওয়া বিভিন্ন জ্বালানি উৎস যথা জীবাশ্ম তেল, গ্যাস, কয়লা এছাড়াও বিকল্প উৎস যথা বায়ু, পানি প্রবাহ এবং র্সূয রশ্মি হতে সম্ভবশ্রেষ্ঠ খরচে জ্বালানি উৎপাদন এবং সরবরাহ নিশ্চিত করা। বর্তমানে আমাদের জ্বালানি চাহিদার সিংহ ভাগ গ্যাস ও তেলের উপর নির্ভরশীল। নিরপাত্তা নিশ্চিত করার লক্ষে অবিলম্বে আমাদের জ্বালানি পোর্টফলিওতে বিকল্প জ্বালানির ব্যাবহার নিশ্চিত করতে হবে।

গৃহস্থলির কাজে এলপিজি ব্যবহার করা যেতে পারে:

প্রাকৃতিক গ্যাস অর্থাৎ এর বিকল্প হিসেবে এল পি জি অর্থাৎ (লিকুইফাইড পেট্রলিয়াম গ্যাস) গৃহস্থলি রান্না-বান্নার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। শিল্প কারখানার চাহিদা মেটানোর  জন্যে এলএনজির (লিকুইফাইড নেচারাল গ্যাস) ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। সরকারের অনুমোদন নিয়ে  আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক ভাবে এল পি জি আমদানি, বতলজাতকরণ ও বিপনণ শুরু করেছে। এল এন জি আমদানির লক্ষে সরকার ইতিমধ্যে এল এন জি টার্মিনাল নির্মানের নিমিত্তে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এছাড়াও এল এন জির বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত কল্পে পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে।

এল পি জি আমদানি হতে শুরু করে বিতরণ পর্যন্ত যতগুলো খরচ হয় তার মধ্যে সবচে বড় খাত হচ্ছে জাহাজ ভাড়া। সাধারণত ২০০০-২৫০০ ম্যাট্রিক টন কেপাসিটির লাইটার জাহাকে এল পি জি সরবরাহ করা হয়ে থাকে এবং প্রতি ম্যাট্রিক টনে ৯০-১০০ মার্কিন ডলার খরচ পড়ে যায়। অন্যথায় ৪০০০০-৫০০০০ ম্যাট্রিক টন কেপাসিটির ভিএলজিসি বা বড় জাহাজে সরবরাহ ও আমদানি করা গেলে জাহাজ ভাড়া প্রতি মেট্রিক টন বাবদ ২০-২৫ মার্কিন ডলারে নেমে আসবে। যার প্রকৃত সুবিধা ভোক্তারা পেতো। এ সকল জাহাজের ড্রাফট বা নাভ্যতা ১২-১২ মিটার বা তারও অধিক হয়ে থাকে। আমাদের দেশের আভ্যন্তরীণ নদী পথের নাভ্যতা সঙ্কটের কারণে এসকল জাহাজ চলতে পারে না। বাণিজ্যিক ভাবে এল পি জি আরও সাশ্রয়ী করতে হলে আভ্যন্তরীণ নদী পথের নাভ্যতা নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই।

এলপিজি প্রকল্প বাস্তবায়নের সমস্যাগুলোর সমাধান হয়েছে:

প্রথমত আমাদের একটি পুর্নাঙ্গ এল পি জি অপারেশন ও লাইসেন্সিং নীতিমালার প্রয়োজন ছিল যা আমরা এ বছর হাতে পেয়েছি। জ্বালানি ও খনিজ সম্পমন্ত্রণালয় জানুয়ারি ২৯, ২০১৭ সরকারী প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নীতিমালাটি গেজেট করা হয়। নীতিমালাটি যথেষ্ট সময়োপযোগী এবং এল পি জি প্রকল্প বাস্তবায়নের যে সকল সমস্যা গুলো ছিল সেগুলো মোটামুটি ভাবে সমাধান হয়েছে। এই মুহূর্তে  এল পি জি খাতে কোন ট্যাক্স হলিডে সুবিধা পাচ্ছি না।
এলপিজি সরকারের একটি বিশেষায়িত খাত। এল পি জির ব্যবহার আরও জনপ্রিয় করতে হলে সবচে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয়মূল্য কমানো যার একটি উল্ল্যেখ যোগ্য উপাদান হচ্ছে ভ্যাট। ভ্যাট শতকরা কত ভাগ হওয়া উচিৎ এই ব্যপারে আমি মন্তব্য করবো না তবে আমি মনি করি সরকারের এ ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া উচিৎ।
মূলত ট্যাক্স হলিডে এবং অন্যান্য প্রণোদনা মূলক সিদ্ধন্ত গুলো অবিলম্বে কার্যকরী করা গেলে এলপিজি খাত দ্রুত সম্প্রসারণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বাজারে প্রচলিত অন্যান্য এল পি জি কোম্পানি গুলোর মতই পেট্রোম্যাক্স এল পি জি একটি বোতলজাতকরণ ও বিপনন কোম্পানি। বছরে প্রায় ১ লক্ষ টন এল পি জি গ্যাস বিতরণ ক্ষমতা সম্পন্ন পেট্রোম্যাক্স এল পি জি মংলা, বাগেরহাট জেলায় এল পি জি টার্মিনাল এর কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়াও ঘণ্টায় ২২০ পিস এল পি জি গ্যাস সিলিন্ডার উৎপাদন কল্পে পেট্রোম্যাক্স সিলিন্ডারর নামে আরেকটি প্রকল্প একই সাথে কাজ শুরু করেছে। ২০১৮ সালের মাঝের দিকে পেট্রোম্যাক্স এল পি জি বাণিজ্যিক ভাবে বাজারে আসবে বলে আশা করছি। শাহাজিবাজার পাওয়ার এর সাথে এল পি জি প্রকল্পের কোন আইনগত সম্পর্ক নেই। জ্বালানি খাতের উন্নয়নের জন্য এই মুহূর্তে সবযে জরুরী কাজ হচ্ছে নতুন জ্বালানি উৎস খুজে বে র করা। বাপেক্স কে আরও শক্তিশালী করতে হবে। অফ শোর এবং অন শোর অনুসন্ধানে আরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ খাতে দক্ষ মানব সম্পদ বেস অপ্রতুল। দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করতে হবে। সরকার ইতিমধ্যে এল এন জি টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। এলএনজি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে মহেশখালীতে পাইপ লাইন নির্মাণ কাজ আমার জানামতে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। এটি জ্বালানি খাতে একটি যুগান্তকারী  পরিবর্তন আনবে।

বিদ্যুৎ খাতে সরকারের এখন সবচে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বেস লোড পাওয়ার প্ল্যান্ট গুলকে অপারেশনে আনা। কয়লা ভিত্তিক ও পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোর প্রকল্প পরিচালন ব্যয় আরও কমিয়ে আনার মাধ্যমে বিদ্যুদের দাম নিয়ন্ত্রন করতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাত কে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। এ ব্যাপারে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল ও বার্মার সাথে বসে আঞ্চলিক সহযোগিতার বিভিন্ন উপায়গুলো খুঁজে বের করতে হবে। এনার্জি রেগুলেটনি কমিশন কে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

 রেজাকুল হায়দার মনজু

চেয়ারম্যান, ইয়োথ গ্রুপ,

শাহজিবাজার পাওয়ার ও প্যাট্রোম্যাক্স এলপিজি লিমিটেড