চার হাজার চালানে লোপাট সাড়ে ৮শ’ কোটি টাকা

জালিয়াতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সাড়ে ৮শ’ কোটি টাকার চার হাজার চালান খালাস করে নিয়ে গেছে একটি চক্র। কাস্টমসের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তার ‘ইউজার আইডি’ ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটির গোপনীয় সফটওয়্যারে ঢুকে এ জালিয়াতি করা হয়। শুধু তাই নয়, আরেক কর্মকর্তার আইডি ব্যবহার করেও সফটওয়্যারটিতে ঢোকার তথ্য পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।

এরপর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্তে জালিয়াতির ঘটনায় সাত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আট কাস্টমস কর্মকর্তার যোগসাজশ পায় দুদক। গত বুধবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, জালিয়াতির ঘটনার সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তবে অন্যায় যারা করেছে, তাদের শাস্তি পেতে হবে। আবার নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, দেশের প্রধান রাজস্ব আদায়কারী এ প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদের সংখ্যা এক হাজার ২৪৮টি। কিন্তু এর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ৬৪৭ জন। যা প্রয়োজনের প্রায় অর্ধেক। জনবলের এ সংকটকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে জালিয়াত চক্র।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম যুগ্ম সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, কোন কনটেইনারে কী আমদানি করা হয়েছে তা সবার আগে জানেন আমদানিকারক। সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র তাদের প্রতিনিধি হিসেবে পণ্য খালাসের কাজ করে। খালাসে আমদানিকারকের অনুমতি লাগে। আর খালাসের ছাড়পত্র দেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। তাই এ ঘটনায় সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানকে এককভাবে দায়ী করার কোনো সুযোগ নেই।

দুদকের মুখোমুখি কাস্টমসের আট কর্মকর্তা

জালিয়াতির ঘটনায় দুদকের উপ-পরিচালক মো. নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল কাস্টমসের আট কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদের শিকার কর্মকর্তারা হলেন- রাজস্ব কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইফুন নাহার জনি, মির্জা সাইদ হাসান ফরমান, মো. মাহমুদুল হাসান মুন্সী, মো. ওমর ফারুক, সাইফুল ইসলাম, মো. মাহবুবর রহমান ও মাহমুদা আক্তার লিপি।

সাত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশ

জালিয়াতিতে যোগসাজশ পাওয়া সাত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছয় প্রতিষ্ঠানই পাঁচ বছরে খালাস করেছে তিন হাজার ৬৫১টি চালান। ৮৫০ কোটি টাকা মূল্যের অন্তত চার হাজার চালান তারা খালাস করেছে বলে ধারণা শুল্ক গোয়েন্দার। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- মেসার্স লাইলা ট্রেডিং কোম্পানি, এমঅ্যান্ডকে ট্রেডিং কর্পোরেশন, এমআর ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, চাকলাদার সার্ভিস, মজুমদার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, স্মরণিকা শিপিং কাইজেন লি. ও লাবনী এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড। এরই মধ্যে কাস্টমস থেকে তাদের লাইসেন্সের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছে দুদক।

‘ইউজার আইডি’ জালিয়াত চক্রের হাতে

২০১৮ সালের ২৪ জুন ঢাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জারা এন্টারপ্রাইজের একটি সন্দেহভাজন চালান (বি/ই নং: সি-৯২০৯২৮) খালাস না করতে চট্টগ্রাম কাস্টমসকে অনুরোধ জানায় শুল্ক গোয়েন্দা। একই সঙ্গে পণ্য চালানের বিএল লক করা হয়। এরপর ২৫ সেপ্টেম্বর চালানটি কায়িক পরীক্ষার জন্য আমদানিকারক ও তার সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকতে বলা হলেও সেদিন উপস্থিত হননি কেউ।

পরে খোঁজ নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা জানতে পারে, অনুরোধ সত্ত্বেও ওইদিনই চালানটির বিল অব এন্ট্রি গ্রহণ, শুল্কায়ন ও শুল্ক আদায় করে কাস্টমস। সব শেষে খালাসও সম্পন্ন হয়।

এরপরই অনুসন্ধান করতে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত কাস্টমস কর্মকর্তা ডিএএম মুহিবুল ইসলামের ইউজার আইডি ব্যবহার করে বিএল লক অবমুক্ত করার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। ২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টমসে কর্মরত ছিলেন মুহিবুল ইসলাম। সে সময় পণ্য খালাস করার জন্য কাস্টমসের গোপনীয় সফটওয়্যার ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম’-এ ব্যবহার করতে একটি ইউজার আইডি পান তিনি। পরে অন্য দফতরে বদলি হয়ে ২০১৫ সালে অবসরে যান মুহিবুল ইসলাম।

এদিকে, মুহিবুল ইসলাম কর্মরত না থাকলেও তার আইডি ব্যবহার করে খালাস হতে থাকে একের পর এক চালান। ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১৬ বার সেই আইডিতে ঢোকে জালিয়াত চক্র। এর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ফজলুল হকের আইডি ব্যবহার করেও অনেক চালান খালাস করে চক্রটি। ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সেই আইডিতে ঢোকার সংখ্যা তিন হাজার ৬৮১। সেই সময়টিতে ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেটে কর্মরত ছিলেন ফজলুল হক।

সার্ভার থেকে তথ্য গায়েব, বেকায়দায় দুদক

তিন বছর আগে ২০১৮ সালে এ জালিয়াতি ধরা পড়লেও তথ্যের ঘাটতির ফলে এখন পর্যন্ত জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি দুদক। নিজেদের রক্ষা করতে সার্ভার থেকে অনেক তথ্য সরিয়ে ফেলে চক্রটি। এছাড়া অনুসন্ধানে যাদের যোগসাজশ খুঁজে পেয়েছে দুদক, জিজ্ঞাসাবাদে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে এটিকে ‘সিস্টেমের ত্রুটি’ বলছেন তারা। ফলে সব মিলিয়ে তদন্ত শেষ করতে পারছে না দুদক। তথ্য-ডেইলি বাংলাদেশ

আজকের বাজার/আখনূর রহমান