টেকনো ড্রাগস্ রক্ষা করা জরুরি

দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার ওষুধ উৎপাদনকারী ও তৃতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান

‘কারখানায় পৃথক ও ডেডিকেটেড ব্যবস্থায় এন্টি ক্যান্সার জাতীয় পদ উৎপাদনের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক ভবনে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে বিধায়, এন্টিক্যান্সার জাতীয় পদের উপর আরোপকৃত উৎপাদন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হলো। মেসার্স টেকনো ড্রাগস্ লি: (ইউনিট-১) এর লাইসেন্সকৃত ৩টি পদ [হরমোন জাতীয় ১টি ইঞ্জেকশন প্রোভেরা, হরমোন জাতীয় ১টি ট্যাবলেট নরজেস্ট এবং টি-ফেরন নামীয় ১টি ট্যাবলেট ফেবাস ফিমারেট] নরসিংদী, বিসিক শিল্প এলাকায় অবস্থিত মেসার্স টেকনো ড্রাগস্ লি: (ইউনিট-৩) এর কারখানায় চুক্তি/টোল ভিত্তিক উৎপাদনের অনুমতি প্রদানের সুপারিশ করা হলো’।

আজকের বাজার বিশ্লেষণ
একটি সফলতার গল্প যেমন আমাদের আপ্লুত করে, তেমনি একটি প্রতিহিংসামূলক সংবাদও আমাদের ব্যথিত করে। এ দেশের সফলতার অনেক গল্পের মধ্যে, আমাদের দেশীয় ওষুধ শিল্পের বিপ্লব অন্যতম। একের পর এক প্রাপ্তি এসেছে ওষুধ শিল্পে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্ব বাজারেও জায়গা করে নিয়ছে আমাদের ওষুধ শিল্প। সম্ভাবনাময় এ শিল্প একদিনে সফলতা পায়নি। হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির মহতী উদ্যোগে ও পরিশ্রমে বিশ্ব জয়ের পথে আমাদের ওষুধ শিল্প। ওষুধ নিয়ে বিদেশিদের বাংলাদেশে ভিড় করার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এতসব অর্জনে যে ওষুধ কোম্পানিগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে তারমধ্যে অন্যতম টেকনো ড্রাগস্ লিমিটেড। দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারের একাধিক ওষুধ প্রথম এদেশের বাজারে এনে, জন্মনিরোধক ইনজেকশনসহ একাধিক হরমোন ড্রাগ উৎপাদন করে চমকে দেয়া কোম্পানি টেকনো ড্রাগস্। অল্পদিনেই স্থান করে নিয়েছে দেশের তৃতীয় বৃহৎ রপ্তানিমুখী ওষুধ কোম্পানি হিসেবে। এ সংবাদগুলো আমাদের আশাবাদী করে। স্বপ্ন দেখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু থমকে যাই, যখন এমন একটি সম্ভাবনাময় ও উদীয়মান প্রতিষ্ঠান রোষানলের শিকার হতে দেখি। উদ্যেশ্যমূলকভাবে এটিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টার খবর ব্যথিত করে আমাদের। ফিকে হয়ে আসে স্বপ্ন।

টেকনো ড্রাগস্ নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয় মূলত ২০১৪ সালে। প্রতি যার ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে এসে কোম্পানিটির কিছু নির্দিষ্ট জনগুরুত্বপূর্ণ ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়।

টেকনো ড্রাগসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ জালাল উদ্দিন আহমেদ জানান, সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনকারী কতিপয় কোম্পানির নামের সঙ্গে টেকনো ড্রাগস্-এর নামও জুড়ে দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিষয়টি সরেজমিন তদন্ত করতে ২০১৪ সালের ২০ আগস্ট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কর্তৃক ৫ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা হয়। ওই কমিটির আহবায়ক ছিলেন অধ্যাপক আ.ব.ম ফারুক। কমিটির অন্য ৪ সদস্যের অনুপস্থিতিতেই আহবায়ক অধ্যাপক আ.ব.ম ফারুক ২০১৫ সালের ২৭ মে, টেকনো ড্রাগস্রে ইউনিট-১ পরিদর্শন করেন এবং একই বছর ১১ আগস্ট ইউনিট-২ ও ইউনিট-৩ ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করেন। পরে তাঁর একার অনুসাক্ষরে তিনি পরিদর্শন প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর টেকনো ড্রাগস্-এর তিনটি ইউনিটের কিছু নির্দিষ্ট জনগুরুত্বপূর্ণ ওষুধ উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দেয়।

টেকনো ড্রাগস, ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, ওই প্রতিবেদনকে চ্যালেঞ্জ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিকে পুনঃতদন্ত করার আবদেন জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে একই বছর ২৭ নভেম্বর, সংসদ সদস্য আ.ফ.ম রুহুল হককে আহ্বায়ক করে, ৯ সদস্যের ২ নং সাব কমিটি গঠন করা হয়। তারা একই বছর ১০ ডিসেম্বর টেকনো ড্রাগস্রে ফ্যাক্টরি সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দাখিল করলে, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর চলতি বছর, ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি টেকনো ড্রাগস্-এর ১, ২ ও ৩ নং ইউনিটের পেনিসিলিন সেফালোস্পরিন জাতীয় পদ ছাড়া অন্যান্য সকল উৎপাদনের অনুমতি দেন।

কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এতেও থামেনি একটি মহল। এই অনুমোদনের বিষয়টি আড়াল করে, ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের অকার্যকর প্রতিবেদনকে ভিত্তি করে, হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামক সংগঠনের পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোর্শেদ টেকনো ড্রাগসের নাম জুড়ে দিয়ে মামলা দাখিল করেন। আর হাইকোর্ট ডিভিশনও অজানা কারণে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের দেওয়া অনুমতি আমলে না নিয়ে, এন্টি ক্যান্সার, হরমোন, পেনিসিলিন ও সেফালোস্পরিন জাতীয় ওষুধ উৎপাদন বন্ধের আদেশ দেন। একইসঙ্গে ঢাকাস্থ ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন-হু’-এর একজন প্রতিনিধিসহ ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে টেকনো ড্রাগস্সহ বন্ধকৃত সকল কোম্পানি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন। ওই আদেশের প্রতি সম্মান রেখে, হাইকোর্টের আদেশে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বারা চলতি বছরের ২১ জুন, টেকনো ড্রাগসের ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করানো হয়। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক গোলাম কিবরিয়া। কিন্তু ৮ জুন ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন তাদের প্রতিনিধি দিতে অপারগতা জানিয়ে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে। ফলে বাকী ৪ সদস্যের কমিটি পরিদর্শন প্রতিবেদন জমা দেন। এ প্রতিবেদনও আমলে না নিয়ে হাইকোর্ট আবারও ৭ দিন সময় দিয়ে ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনকে প্রতিনিধি প্রেরণের অনুরোধ করতে নির্দেশ দেন। এবং ২৬ জুলাই মামলার রায়ের দিন ধার্য করেন। এবারও অপরাগতা জানিয়ে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এ অপারগতার বিষয় পত্রের মাধ্যমে অবহিত করেছে ‘হু’। ৪ সদস্য বিশেষজ্ঞ কমিটি যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তাতে উল্লেখ রয়েছে, ‘কারখানায় পৃথক ও ডেডিকেটেড ব্যবস্থায় এন্টি ক্যান্সার জাতীয় পদ উৎপাদনের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক ভবনে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে বিধায়, এন্টিক্যান্সার জাতীয় পদের উপর আরোপকৃত উৎপাদন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হলো। মেসার্স টেকনো ড্রাগস্ লি: (ইউনিট-১) এর লাইসেন্সকৃত ৩টি পদ [হরমোন জাতীয় ১টি ইঞ্জেকশন প্রোভেরা, হরমোন জাতীয় ১টি ট্যাবলেট নরজেস্ট এবং টি-ফেরন নামীয় ১টি ট্যাবলেট ফেবাস ফিমারেট] নরসিংদী, বিসিক শিল্প এলাকায় অবস্থিত মেসার্স টেকনো ড্রাগস্ লি: (ইউনিট-৩) এর কারখানায় চুক্তি/টোল ভিত্তিক উৎপাদনের অনুমতি প্রদানের সুপারিশ করা হলো’। এত সব ইতিবাচক প্রতিবেদনের পরও আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বাধা দিয়ে আসছেন। এবং তাঁর আবেদনে একের পর এক তারিখ ধার্য হয়ে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, পরপর দুইবার দিন ধার্য করার পরও মনজিল মোরশেদ ‘হু’ প্রতিনিধিদের দোহাই দিয়ে রায় বিলম্বিত করছেন। বিধি সম্মতভাবে ‘হু’ এর প্রতিনিধির কোনো প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশে ২৬৬টি ওষুধ কোম্পানি পরিচালনায়, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরিদর্শন প্রতিবেদনই যথেষ্ঠ হয়। এই নিয়ম বাংলাদেশে ওষুধ প্রশাসন দপ্তর সৃষ্টির শুরু থেকে এ পর্যন্ত চলে আসছে। ‘হু’ এর প্রতিনিধির মতামতের প্রয়োজন হয়নি। এমনকি আমাদের দেশের প্রচলিত ওষুধ নীতিতেও তাদের প্রতিনিধির মতামতের কোনো বিধান নেই। ‘হু’ তাদের চিঠিতে বলেছে, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে কমিটিতে তাদের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তির সুযোগ নেই। তাহলে কি বলা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র প্রতিনিধির দোহাই দিয়ে, একটি সম্ভাবনাময় ওষুধ কোম্পানির ক্ষতি করার চেষ্টা চলছে?

সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বোঝা যাচ্ছে, যেকোনোভাবে হোক কেউ টেকনো ড্রাগসের ক্ষতি চাইছে। ওষুধ কোম্পানিটি এ অবস্থায় সুপ্রীম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনে ‘সিভিল পিটিশন অব লিভ টু আপীল’ করে মামলার নিষ্পত্তি চায়। আমরাও চাই। দেশের ওষুধ শিল্প ও সাধারণ মানুষের স্বার্থে এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। আমরা জানি, এন্টিক্যান্সার জাতীয় ওষুধ দেশে খুব কমই উৎপাদন হয়। কোম্পানিটির ওষুধ নিশ্চয়ই, এ দেশের দরিদ্র ক্যান্সার রোগীদের কাজে লাগে।

আজকের বাজার: আরআর/ ১৬ আগস্ট ২০১৭