দক্ষ মানবসম্পদ ও বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার-এরশাদ আহমেদ

ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক প্রেসিডেন্ট সৈয়দ এরশাদ আহমেদ। দেশের অর্থনীতি, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন আজকের বাজারের সঙ্গে। আলোচনার মূল অংশ তারই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি
শিল্প জগতের মানুষ হিসেবে আমি সবচেয়ে গুরুত্ব দিই দেশের অর্থনীতিকে। দেশের অর্থনীতি সচল না থাকলে ওই দেশের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সুতরাং এই মুহূর্তে বিনিয়োগ বাড়ানোটা বেশি জরুরি। এই জায়গাটায় আমরা বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছি। যেভাবে বিনিয়োগ হওয়ার কথা সেভাবে হচ্ছে না।

এ ছাড়া আমাদের যুবসমাজ তৈরি হচ্ছে। তাদের জন্য চাকরির বাজার তৈরি করতে হবে। এত মানুষের দেশ অথচ আমরা যদি এদের কাজে লাগাতে না পারি; কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে না পারি তবে দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগোবে না। এ কারণে হলেও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এখন  গ্লোবাল মার্কেটের যুগ। ফলে সারা পৃথিবীতে ব্যবসা করার সুযোগ আছে। আমরা যদি উৎপাদন বাড়াতে না পারি তবে  রপ্তানিও বাড়াতে পারব না। আর রপ্তানি বাড়াতে না পারলে আয়ও বাড়বে না।

ওয়ানস্টপ সার্ভিস
আমাদের দেশে একটি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন- নতুন একটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায় আসতে হলে, জয়েন্ট- স্টক কোম্পানিতে যেতে হবে, সিটি কর্পোরেশনে যেতে হবে, এরপর পরিবেশ দফতর, এনবিআরসহ আরও অনেক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আছে যারা নানাভাবে নতুন প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এত নিয়ন্ত্রক সংস্থার চাপে পড়ে নতুন প্রতিষ্ঠানটিকে অনেকটা হেনস্তা হতে হয়।

অবকাঠামো সুবিধা নিতে হলে, গ্যাস লাইন, ইলেকট্রিসটি, ওয়াসা; এসব ক্ষেত্রেও আলাদা আলাদা কর্তৃপক্ষের কাছে যেতে হয়। এখন তিতাস গ্যাস বা ওয়াসা যদি সিটি কর্পোরেশনের অধীনে হতো তাহলে এক সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্সেই সব হয়ে যেত। সেটাও কিন্তু এক ধরনের ওয়ানস্টপ সার্ভিস। ওয়ানস্টপ সার্ভিস বলতে আমরা বুঝি,  নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো ঠিক রাখতে যে সময় নষ্ট হচ্ছে তা কমিয়ে আনতে হবে। এতে ব্যবসায়ীরা একটা ঝামেলামুক্ত পরিবেশ পাবেন। যা কিনা আবার বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করবে।

ভোকেশনাল ও  ট্রেনিং সেন্টার প্রয়োজন
আমাদের দেশ ১৬ কোটি মানুষের দেশ। এই জনসংখ্যা আমাদের শক্তি। এই শক্তিকে কাজে লাগাতে হলে দক্ষ মানবশক্তি তৈরি করতে হবে। সেদিকে শুরু থেকেই নজর দেওয়া উচিত। আমাদের বর্তমান স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থায় ভালোভাবে ভিত্তি তৈরি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। এদিকটায় বেশি করে নজর দেওয়া উচিত। বাচ্চাদের মধ্যে সৃজনশীলতা তৈরি করতে হবে। এরপর উচ্চ পর্যায়েও নজর দিতে হবে।

লেখা-পড়ায় রেজাল্ট বিষয় না। অনেকে লেখা-পাড়ায় ভালো করে না; কিন্তু টেকনিক্যাল দক্ষতা ভাল থাকে। তাকে ওইভাবেই গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে হিউম্যান রিসোর্স গড়ে  তোলার কাজ করতে হবে।

গণমাধ্যমের কথাই যদি বলি- বর্তমানে ৩০টির  বেশি টেলিভিশন চ্যানেল আছে, ১০০ এর বেশি পত্রিকা ঢাকা থেকেই বের হচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় দক্ষ সাংবাদিক পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি যথাযথ সাংবাদিকতা শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিত। তাহলে কিন্তু এ সমস্যা হতো না।

কৃষি শিক্ষায় আমরা এখনও পর্যন্ত কিছুটা সফল। তবে এই সেক্টরেওূ এখনো অনেক কিছু করার আছে। এগ্রিকালচার ডিপ্লোমা একটি বিকল্প হতে পারে। সবাই হয়তো হায়ার ডিপ্লোমা নিতে পারবে না। এজন্য বিভিন্ন ক্যাটাগরির ডিপ্লোমা চালু করতে হবে। এতে আমাদের দেশে আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।

দেখা যায়, অনেকে বিবিএ, এমবিএ শেষ করে মার্কেটিংয়ে চাকরি করছে অথবা ডেস্ক জব করছে। এটা তো হওয়ার ছিল না। এক্ষেত্রে যারা গ্রোসারি সপ চালাবে তাদের জন্য আলাদা ডিপ্লোমার ব্যবস্থা করা যেতে পারতো। সেখান  থেকে প্রতিষ্ঠানও দক্ষ কর্মী পেতো। কর্মীরাও পর্যাপ্ত বেতন পেতো। এটি না থাকায় দেশের বাইরে থেকে লোক নিয়ে আসা হচ্ছে। এটা অবশ্যই দুঃখজনক। যেখানে আমাদের দেশে এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, এত লোকবল রয়েছে, সেখানে কেন দক্ষ লোক থাকবে না?

হিউম্যান রিসোর্স মিনিস্ট্রি সময়ের দাবি
সরকারও কিন্তু হিউম্যান রিসোর্স মিনিস্ট্রি তৈরি করতে পারে। সেই মিনিস্ট্রি ঠিকমত মনিটরিং করলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের চাকুরেরা ধীরে ধীরে দক্ষ হয়ে উঠবে। প্রতিটি বিষয়ই একটির সঙ্গে আরেকটি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

আসলে সবার আগে ইচ্ছা শক্তির প্রয়োজন। যদি  জাতীয় নেতৃত্ব থেকে বা সরকারের উচ্চ মহল থেকে সংশ্লিষ্টরা এগিয়ে না আসেন কিংবা শিক্ষাবিদ, শিল্প উদ্যোক্তারা এগিয়ে না আসেন তাহলে দক্ষতা উন্নয়ন সম্ভব নয়।

সিএসআরের মাধ্যমে শিল্প উদ্যোক্তারা যদি ভালো ইনস্টিটিউট তৈরি করেন সেটা বেশ ভালো কাজে দিতে পারে। বড় বড় ব্যাংকগুলো সিএসআর ডিল করছে। তারাও পারে একটি করে  প্রফেশনাল ইনস্টিটিউট তৈরি করতে।

বিদেশি বিনিয়োগে চ্যালেঞ্জ
চ্যালেঞ্জের কথা বলতে হলে প্রথমেই এনার্জির কথা বলতে হবে। আমাদের এখন এনার্জির অভাব। এরপর আমাদের জমির অভাব। আর তৃতীয়ত, আমাদের আইনি কাঠামো একটু ক্রিটিক্যাল। এতে ইনভেস্টররা হয়রানি হচ্ছেন। এর ফলে একটা ভুল বার্তা বাইরে চলে যাচ্ছে। বিদেশি  বিনিয়োগকারীদের  তো একটু স্বস্তিতে  রাখতে হবে। তাহলে এরাই ব্যবসা-দূত হিসেবে কাজ করবেন। ফলে বিনিয়োগ আরও বাড়বে।

এ ছাড়া পোর্ট সুবিধা বাড়াতে হবে। আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরের সার্ভিস এখন বেশ ভালো। এটা আরো ভালো করতে হবে। আমাদের কাস্টমস সার্ভিস আরো উন্নত করতে হবে। আজ ঢাকা এয়ারপোর্ট দেখা যাচ্ছে আমদানি করা পণ্য বাইরে পড়ে রয়েছে। এসব দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত। না হলে ভুল বার্তা বাইরে চলে যাচ্ছে।  আর এর প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগে গিয়ে।

বাজেট প্রত্যাশা
হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টের জন্য বাজেটে একটা বিশেষ বরাদ্দ  থাকা দরকার। কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো উচিত।

বাজেটে আমার প্রত্যাশার কথা ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছি। হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টের জন্য বাজেটে একটা বিশেষ বরাদ্দ  থাকা দরকার। এ ছাড়া টেকনিক্যাল সাপোর্ট দরকার।

বাজেটে বেশি প্রত্যাশা করবোই বা কীভাবে? আমাদের ১৬ কোটি মানুষের দেশে ২৭ লক্ষ মানুষ কর দেয়; এটা নিয়ে আমরা খুব গর্ব করি। কিন্তু আমি এখানে শঙ্কায় আছি। ন্যূনতম কোটি লোকের ট্যাক্স দেওয়ার কথা ছিল। অল্প সংখ্যক মানুষ কর দেওয়ায়;  তাদের ওপর চাপ পড়ে যাচ্ছে। এজন্য করের পরিমাণ না বাড়িয়ে করদাতার পরিমাণ বাড়ানো উচিত।
আর কর্পোরেট ট্যাক্সেও একটু নজর দেওয়া উচিত। বর্তমানে কর্পোরেট ট্যাক্স আছে সাড়ে ৩৭ থেকে ৪০ শতাংশ। এটাকে কমিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে নিতে পারলে ভালো হবে। এটা ডিপেন্ড করবে অরগানাইজেশনের ওপর। কেউ ৩০, কেউ ৩২, কেউ ৩৫ শতাংশ। এভাবে।

এরপর ব্যাক্তিগত ট্যাক্সের  বেলায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। বর্তমানে টাকার মান কমেছে। মূল্যস্ফীতি রয়েছে। সুতরাং এখানে টাকার পরিমাণ বাড়ানো উচিত।  সাড়ে ৩ লাখ বা ৩ লাখ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তিগত আয়সীমায় কর থাকা উচিত না।  বিষয়গুলো বাজেটের সময় ভাবা উচিত। এগুলোর একটা সুষ্ঠু  ব্যবস্থপানা করের অনুপাত বাড়াতে সাহায্য করবে। বাজেটের আকার যে দিন দিন বাড়ছে, এটা কিন্তু একটা ইতিবাচক দিক। বাজেটের আকার না বাড়লে তো উন্নয়ন হবে না। উন্নয়নের জন্য বাজেটের আকার বাড়াতে হবে। তবে বাজেটে করদাতার উপস্থিতিও বাড়াতে হবে। না হলে যে ২৭ লাখ মানুষ  কর দেয় তাদের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। আমি মনে করি বাংলাদেশে ২ কোটি মানুষ কর দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।  করজালের মধ্যে আনতে হবে তাদের।

আজকের বাজার:সৈয়দ আতিয়ার রহমান/ আরআর/এলকে ১৬ মে ২০১৭