দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্বন্দ্বে খেসারত দিচ্ছে দেশের পুঁজিবাজার

দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্বন্দ্বের খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে। পুঁজিবাজারেব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগসীমা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এর ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশনা ও ব্যাখার কারণে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের মাসুল গুনতে হচ্ছে স্পর্শকাতর এই বাজারকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৬ এর (ক) ধারা বলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য শেয়ারবাজারে বিনিয়োগসীমা নির্ধারণ করার ক্ষমতা তাদের। এই আইনের ৪৫ ধারা অনুযায়ী এ সংক্রান্ত যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। আবার ১২১ ধারা অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে যে কোনো প্রজ্ঞাপন জারী বা বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

অন্যদিকে,১৯৬৯ সালে দ্য সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্সের ২ এর (সি) ধারা বলে বিএসইসিরও তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য সব ধরনের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রয়েছে। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রনের থাকলেও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বিএসইসির রয়েছে সব ধরনের নিয়ন্ত্রন আরোপের ক্ষমতা।

কিন্তু শেয়ারবাজারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগসীমা নির্ধারণের ক্ষমতা বাংলাদেশে ব্যাংকের। একারণেই তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও বিএসইসির আইন মেনে চলার ক্ষমতা ব্যাংক ‍ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নেই। আর বিনিয়োগ সীমা বেধে দেওয়ার ক্ষমতাও এককভাবে বিএসইসির হাতে নেই। সমস্যাটা এখানে। তবে শেয়ারবাজারের যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিএসইসির সঙ্গে পরামর্শ করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে ২০১২ সালের নভেম্বরে অর্থ মন্ত্রনালয় যে নির্দেশনা জারী করেছিলো তা আর মানছে না বাংলাদেশে ব্যাংক। তারা ব্যাংক কোম্পানী আইনের আওতায় তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে চলেছেন।

বিএসইসি বারবার বলে আসছে শেয়ারবাজারকে অস্থিরতা হতে থেকে বাঁচাতে শেয়ারের প্রতিদিনকার বাজার মূল্য নয় বরং ক্রয় মূল্য ধরে বিনিয়োগসীমা নির্ধারণ করা হোক। সারা পৃথিবীতে এখন বিনিয়োগসীমার স্টান্ডার্ড হচ্ছে শেয়ারের ক্রয় মূল্য। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগসীমা নিয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বন্দ্বটা মূলত এখানেই।

বিনিয়োগসীমা নিয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকগুলো প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। শেয়ারবাজার অস্থির হয়ে উঠলে ২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগসীমা থেকে বাদ দেওয়া হয় এরকম এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন,এখনো যখন এরকম অবস্থা তখন বিনিয়োগসীমার নিয়ম বদলাতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

২০১০ সালের ১৫ জুন জারি করা এক সার্কুলারে বলা হয় পুজিবাজারে কোনো ব্যাংক বা কোম্পানির এক্সপোজার বা বিনিয়োগসীমা ওই ব্যাংক বা কোম্পানির মোট দায়ের ১০ শতাংশের বেশী হবে না। দায় বলতে এখানে আমানতের পরিমাণ বোঝানো হয়েছে। তবে বর্তমানে,আমানতের ১০ শতাংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার যে সুযোগ ছিল তা সংকুচিত হয়েছে।

২০১০ সালের ২২ আগস্ট আরেক সার্কুলারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে আরেকটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩ সালের ১৬ ধারা অনুযায়ী তখন থেকে বিনিয়োগসীমা ধরা হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ইকুইটির ২৫ শতাংশ। ইকুইটি বলতে বোঝায় ব্যাংকের পরিশোধিত মুলধন ও অর্জিত মুনাফা বা লোকসানের যোগফল। এই নিয়ম ব্যাংকগুলোর জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে আমানতের ১০ শতাংশ অথবা ইকুইটির ২৫ শতাংশ বিনিয়োগ সীমা নির্ধরনের সমস্যাটা কোথায়? উদাহরণ দিয়ে বলা যায়,২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে ধরা যাক ওয়ান ব্যাংকের ইকুইটির পরিমাণ ছিলো ৮শ ৮৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ইকুইটির ২৫ শতাংশ নিয়মে পুঁজিবাজারে ব্যাংকটির বিনিয়োগসীমা দাড়াচ্ছে ২শ’ ২১ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

অন্যদিকে , ধরা যাক, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ওয়ানব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ছিলো ২২ হাজার ৯৪ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। আমানতের ১০ শতাংশ হিসেব করলে, ওয়ানব্যাংকের বিনিয়োগসীমা দাড়াতো ২ হাজার কোটি ২৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।

একই ভাবে ধরা যাক, ইস্টার্ণ ব্যাংকের ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইকুইটির পরিমাণ ছিলো ৮শ কোটি ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা,আর আমানতের পরিমান ছিলো ২৪ হাজার কোটি ২৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ২৫ শতাংশ হারে এখন বিনিয়োগসীমা দাড়াচ্ছে ২শ’ ০২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। আমানতের ১০ শতাংশ হারে ব্যাংকটি বিনিয়োগ করতে পারতো ২ হাজার কোটি ৪২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।

এদিকে, ইকুইটির ওপর ভিত্তি ধরে বিনিয়োগ সীমা ধার্য করার ক্ষেত্রে শেয়ারের বর্তমান বাজার দরকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। শেয়ারের এই দর ধরে বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ নিয়েই তৈরি হয়েছে দ্বিমত।

শেয়ারের ক্রয়মূল্য ধরে বিনিয়োগসীমা নির্ধারন হলে বিনিয়োগের পরিমান হবে একরকম,আর বাজার দর ধরলে হবে আরেক রকম।উদাহরন হিসেবে ধরা পুজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওয়ান ব্যাংকের ইকুইটি ১০০০ কোটি টাকা। তাহলে তার বিনোয়োগসীমা দাড়ায় ২৫০ কোটি টাকা। ধরা যাক ওয়ান ব্যাংক ২১ টাকা দরে ‘‘ক’’ কোম্পানির X টি শেয়ার এবং ১৩ টাকা দরে ‘খ’ কোম্পানির Y টি শেয়ার কিনেছে। এভাবে ক্রয় করা মোট শেয়ারের দাম দাড়িয়েছে ২২০ কোটি তাহলে ওই ব্যাংকটি শেয়ারবাজারে আরো ৩০ কোটি টাকা শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারবে। ক্রয় মূল্য ধরে বিনিয়োগসীমা নির্ধারণ করা হলে এই হিসাব দাড়ায়।

কিন্তু বাজারদর ধরে যদি সে হিসেব করা হয় তাহলে মিলানো কঠিন। ধরা যাক, ‘ক’ কোম্পানির ২১ টাকা দামের শেয়ার বৃদ্ধি পেয়ে ৭ দিন পর ২৫ টাকায় পৌছালো, খ কোম্পানির শেয়ারের বাজার দর সাত দিন পর বেড়ে ১৮ টাকায় পৌছালো। এরফলে ওয়ান ব্যাংকের মোট ক্রয় করা শেয়ারের বাজার মূল্যদাড়ালো ২৫৫ কোটি টাকা। এরকম পরিস্থিতিতে ওয়ান ব্যাংককে নিয়ম মানতে গিয়ে ৫ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে ২৫০ কোটিতে নামতে হবে। এর ফলে, শেয়ারবাজারে বিক্রির চাপ বৃদ্ধি পাবে। তাতে বাজার অস্থির হয়ে উঠতে পারে।

বিএসইসি ক্রয়মূল্যকেশেয়ার দর ধরে বিনিয়োগসীমা নির্ধারণের পক্ষে। কিন্তু কেন্দ্রিয় ব্যাংক বলছে বাজার দর ধরে বিনিয়োগসীমা ধার্যকরতে।আর এ নিয়ে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে শুরু হয়েছে টানটানি।

একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বন্ডেরবিনিয়োগকেও বিনিয়োগসীমার মধ্যে আনতে চাচ্ছে। কিন্তু বিএসইসি বলছে বন্ডের বিনিয়োগকে বিনিয়োগসীমারমধ্যে আনা যাবে না। কেননা বন্ডের বিনিয়োগ সুনির্দিষ্ট ও নিশ্চিত মুনাফা দ্বারা ধার্যকরা। এছাড়া পৃথিবীর প্রায়সব দেশেই শেয়ারের ক্রয় মূল্যেকে ভিত্তি হিসেবে ধরে বিনিয়োগসীমা ধরা হয়। এছাড়া বন্ডকে বিনিয়োগসীমার বাইরে রাখা হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া(আরবিআই) ২০০৯ সালের ৩০জুন জারী করা এক নির্দেশনায় ক্রয় মূল্য ধরেই বিনিযোগসীমা ধার্য করেছে। একই নিয়ম রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন বিনিয়োগসীমার নিয়ম বদলাতে হবে। আমনতের ওপর বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমনতের হার ১০ শতাংশ না করে ৫ শতাংশ করা যেতে পারে।

কোন কোন বাজার বিশ্লেষক বলছেন ইকুইটির নিয়ম বহাল রেখেই বিনিয়োগসীমা নির্ধারন করা যেতে পারে । তবে শেয়ারের ক্রয়মূল্য ধরেই বিনিয়োগসীমা ধার্য করা উচিত। পাশাপাশি বন্ডের বিনিয়োগকে এর বাইরে রাখতে হবে। বিএসইসি সুত্র জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানতে গিয়ে ব্যাংকগুলো চাপের মুখে পড়ে গেছে। ফলে বাজার অস্থির হয়ে উঠছে।

শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কোনো ব্যাংকের  বিনিয়োগসীমা পরিশোধিত মুলধন, মুনাফা ও ফ্রি রিজার্ভের যোগফলের ২৫ শতাংশ হার ধরে যে নিয়ম করা হয়েছে সেটা ঠিক আছে। তবে সেটা যখন শেয়ারের বাজার মূল্য দিয়ে ধার্য করা হয় তখনই অস্থিরতা তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রয়মূল্য দ্বারা বিনিয়োগসীমা ধার্যের নিয়মটা বাংলাদেশে অনুসরণ করা যেতে পারে। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো প্রজ্ঞাপন দ্বারা এই নিয়ম চালু করা হয় তবে তা বদলাতে হবে আরেক প্রজ্ঞাপন জারী করতে পারে। আর যদি জাতীয় সংসদে আইন করে চালু করা হয় তবে তা পার্লামেন্টের আইন সংশোধন করে পরিবর্তন করতে হবে। যে কোনো ভাবেই ক্রয়মূল্য ধরেই বিনিয়োগসীমা ধার্য করা উচিত বলেই মত দেন এই অর্থনীতিবিদ। তাহলেই বাজারের হঠাৎ বিক্রির চাপ কমে যাবে। বাজার স্বাভাবিক রাখতে যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বলে মনে করেন তিনি ।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ছাইদুর রহমান দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টফোর ডটকমকে বলেন,২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজের বিনিয়োগকে ব্যাংক গুলোর মূল বিনিয়োগ থেকে আলাদা করে বিনিয়োগসীমা নির্ধারন করে। এভাবে এখনো ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসীমা ব্যাংক কোম্পানী আইন ১৯৯১ এর ১২১ ও ৪৫ ধারা অনুযায়ী বিনিয়োগসীমা ধার্য করতে পারে।

বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবায়াত উল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন এখানে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার সহযোগিতা মূলক আচরণ দরকার। শেয়ারের ক্রয় মূল্য ধরে বিনিয়োগসীমা নির্ধারনের বিষয়ে প্রয়োজনে আইনের সংশোধনও করা দরকার। এ বিষয়ে সমাধানের জন্য প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হবেন বলে জানান তিনি। এদিকে বিনিয়োগকারীরা দাবি করছেন যে কোন মূল্যে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার টানাপোড়েন থেকে শেয়ারবাজারকে রক্ষা করতে হবে।