পঁচা পণ্যে সয়লাব খাতুনগঞ্জ,দাম বাড়ার শঙ্কা

চট্টগ্রামে গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে সব থেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ। টানা বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় বন্ধ ছিল প্রায় ৬ হাজার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে পানি উঠে দোকান কিংবা গুদামে রাখা পচনশীল পণ্য পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ডালসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য পানিতে ভিজে খাতুনগঞ্জ এখন পঁচা পণ্যে সয়লাব। এতে বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এই ৫ দিনে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবী করলেও বাস্তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশী হবে বলে মনে করছেন তারা। ব্যবসায়ীরা জানান, প্রাথমিক ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা ধারণা করা হয়েছে মাত্র। তবে ক্ষতি তো ব্যক্তিকেন্দ্রিকভাবে হয়ে থাকে। সব হিসাব একসঙ্গে পাওয়া সম্ভব হয় না। এজন্য ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকার বেশী হবে বলে যুক্তি দেন তারা।

জানা গেছে, ভারী বর্ষণের আগে বিভিন্ন গুদাম ও দোকানে ভোগ্যপণ্য মজুদ করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। কিন্ত গত ৪-৫ দিনের টানা বৃষ্টিপাত এবং সামুদ্রিক জোয়ারের কারণে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ-আসাদগঞ্জ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এতে করে মজুদ করে রাখা পণ্যের একটা বড় অংশ পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে পণ্য অন্যত্র সরানোর সুযোগও পায়নি ব্যবসায়ীরা। এতে গতকাল এই ভিজে যাওয়া নষ্ট পেঁয়াজ ২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী এনামুল কবির জানান অর্থসূচককে বলেন, আমরা পণ্য এনে মজুদ করি। ক্রেতা এসে কিনে নিয়ে গেলে গুদাম খালি হয়ে যায়। আবার মজুদ করি, আবার বিক্রি করি। তবে গত শনিবার থেকে আমরা যেসব পণ্যে গুদাম, আড়ত ও দোকানে মজুদ করেছিলাম সেটা ঐ ভাবে পড়ে আছে, পানিতে আমার অর্ধেক পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। এ বাজারের অনেক ব্যবসায়ীদের একই অবস্থা। এখন দোকান ও গুদামগুলোর পঁচা পণ্য সরাতে দোকানের কর্মচারীরা কাজ করে যাচ্ছেন। তবে পণ্যভেদে দাম কিছুটা বেড়েছে বলে জানান তিনি।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জানান, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও জোয়ারের পানিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কাঁচাপণ্য ও চাল ব্যবসায়ীরা। এছাড়া চিনি, ডাল, শুঁটকি, আটা-ময়দা ও গম ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার পণ্য জোয়ারের পানিতে নষ্ট হয়। বৃষ্টি অব্যাহত থাকার কারণে যানবাহন চলাচলও বন্ধ ছিল। এতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ক্রেতা-ব্যবসায়ীদের পণ্য সরবরাহ দিতে বিলম্ব হয়। ফলে বিক্রি করা পণ্য গুদামে থাকায় লোকসান দ্বিগুণ হয়েছে ব্যবসায়ীদের।

ব্যবসায়ীরা জানান, গত রোববার সকাল থেকে এই বাজারে বিক্রি কমে গেছে ৯০ শতাংশ। এখানে জোয়ার ও বৃষ্টিপাতে যে পরিমানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে সেটা খাতুনগঞ্জের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এ সময় ক্ষয়ক্ষতি থেকে গুদাম ও আড়তের মালপত্র রক্ষা করতে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সারা রাত জেগে পানি সরানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পানির অতিরিক্ত চাপে সেটা সম্ভব হয়নি। জোয়ারের পানির কারণে বাজারে সড়কে প্রায় এক ফুট বেশি পানি জমে। এতে তলিয়ে যায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। নষ্ট হয় কয়েকশত কোটি টাকার পণ্য। তবে আমদানিকারকদের কাছ থেকে বাকিতে পণ্য পেতে বিপত্তি সৃষ্টির আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা ক্ষয়ক্ষতির কোনো হিসাব জানাতে অনীহা প্রকাশ করেন। এতে করে কি পরিমান অর্থের ক্ষতি হয়েছে সেটা বলা সম্ভব নয়। যে ৩০০ কোটি টাকা ক্ষতির কথা বলা হচ্ছে সেটা থেকে ক্ষতির পরিমান বেশী হবে বলে জানান তারা।

খাতুনগঞ্জের মোহাম্মদী ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আলম মিন্টু অর্থসূচককে বলেন, আমার পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ অন্যান্য পণ্য গুদামে মজুদ করে রেখেছিলাম। কিন্তু পানি ঢুকে এসব পণ্যের বেশিরভাগ পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন দুর্গন্ধে টিকে থাকা দায়। এজন্য কর্মচারীদের দিয়ে ঐ পঁচা পণ্য সরাতে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। বলতে গেলে এই বাজারে এখন পঁচা পণ্যে সয়লাব হয়ে পড়েছে।

চট্টগ্রাম চেম্বার ও কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম অর্থসূচককে বলেন, ভোগ্যপণ্যের বিশাল মজুদসম্পন্ন পাইকারী বাজারে বিভিন্ন দোকান ও গুদামে মজুদকৃত কোটি কোটি টাকার ভোগ্যপণ্য জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হচ্ছে। সারাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে পণ্য পরিবহন বিঘ্নিত হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংক ঋণের সুদসহ ব্যবসায়ের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে; যার দায়ভার ব্যবসায়ীসহ ভোক্তা সাধারণকে বহন করতে হচ্ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, জোয়ারের পানিতে চাক্তাই, চালপট্টি, চামড়া গুদাম, পোস্ট অফিস গলি, ইসমাইল ফয়েজ রোড, ড্রামপট্টি, শুঁটকিপট্টি, রাজাখালী ও আসাদগঞ্জ এলাকায় সবচেয়ে বেশি পানি প্রবেশ করেছে। এ সময় ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা নিজেরাই বালতিতে করে আড়ত ও গুদাম থেকে পানি সরিয়ে নেওয়ার কাজ করছেন। অনেক আড়ত ও গুদামে ভেজা পণ্য শুকাতেও দেখা যায়। তবে গতকাল বেলা ৫টার দিকে পানি অনেকটা নেমে যাওয়ায় পানির চাপ কম ছিল।

এদিকে গতকাল বুধবার সারাদিন চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত না হওয়া এবং পানি কম উঠার কারণে ফের দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্রেতারা মালামাল কিনতে আসছেন। তবে বাজার পর্যালোচনা দেখা গেছে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে পণ্য ভেদে কেজিতে ৫ থেকে ৮ টাকা বেড়েছে।

এদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনে ও এই ভোগ্যপণ্যের বাজারকে রক্ষা করতে চাক্তাই খাল এলাকায় বেড়ী বাঁধ নির্মাণ, কালের মুখে স্লুইসগেট নির্মাণ, খালের গভীরতা বাড়ানো, খাল দখল মুক্ত করা, নতুন ৩টি খালের খনন দ্রুত শেষ করা, পাহাড় কাটা বন্ধসহ বিভিন্ন দাবি জানিয়েছেন খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ীরা।

আজকের বাজার: এলকে/এলকে ২৭ জুলাই ২০১৭