‘পসরা’য় স্বাবলম্বী নুসরাত

ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়ে নুসরাত জাহান। বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা এই ছোট্ট শহরেই। চঞ্চল প্রকৃতির এই তরুণী স্বপ্ন দেখতেন নিজ উদ্যগে স্বাবলম্বী হওয়া। তার সেই স্বপ্ন দেখা, আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। নুসরাত জাহান এখন স্বাবলম্বী। তার তৈরি ওয়ালম্যাট কিংবা উলের তৈরি পণ্য এখন শহর থেকে গ্রামেসবখানেই ছড়িয়ে পড়েছে।

আলাপ-চারিতায় নুসরাত জানালেন, তার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প। পুঁজি বলতে ছিলো ইচ্ছে-ই। সেই ইচ্ছার ডানায় চড়ে এগিয়ে যাওয়ার গল্প শুনিয়ে তিনি বলেন, আমি জন্মেছি মফস্বল শহর ঠাকুরগাঁওয়ে। সেখানেই বেড়ে ওঠা। ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট হওয়ায় যখন যা চেয়েছিÑতাই করেছি। আঁকা-বুকি কিংবা নানা ধরণের ওয়ালম্যাট বানাতে ছোট থেকেই পছন্দ করতাম। সেই পছন্দের বিষয়গুলো নিয়ে মাত্র ৭ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করি অনলাইনে পণ্য বিক্রির কার্যক্রম। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

অনলাইন শপিং প্লাটফর্ম ‘পসরা’য় এখন তার প্রতি মাসে প্রায় লাখ টাকারও বেশি আয় হচ্ছে বলে জানালেন নুসরাত।

পড়াশোনা শেষ করে বেসরকারি একটি স্কুলে চাকরিও নিয়েছিলেন এই তরুণী। কিন্তু মাথায় যার নিজে কিছু করার পোকাতার কী চাকরি করা মানায়! তাই ছেড়ে দিলেন ৯-৫টার রুটিন চাকরি। নিজের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে মহামারী করোনার ঘরবন্দি সময়ে তিনি গড়ে তুললেন ‘পসরা’। বলেন, আট বছর চাকরি করেছি। কিন্তু হঠাৎ করে এটা ছেড়ে দিয়ে কী ভুল করলাম কিনা এমনটা মনে হচ্ছিলো। তবুও অনেকটা শখের বসেই ৭ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করি অনলাইন ব্যবসা।

‘ আমি যখন কাজটা শুরু করি তখন চারদিকে একটা অস্তির অবস্থা বিরাজ করছে। একদিকে মানুষের মনে করোনা আতঙ্ক। অন্যদিকে কর্মহীন হয়ে পড়ছে মানুষ। এর মাঝে সংসার, তিন মাসের সন্তান-সবকিছু মিলে আমার নিজেরও এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। জীবনের এই কঠিন সময়েই শুরু করলাম উদ্যোক্তা জীবন।’

নুসরাতের ভাষ্য, উদ্যোক্তা হিসেবে গত দেড় বছরে আমি পেয়েছি অনেক। নিজের মতো করে টুকটুক করে সংসারের পাশাপাশি পসরাকে এগিয়ে নিয়েছি। এ সময় খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি।

শুরুর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুরুতে মিরপুরের একটি দোকান থেকে শাড়ি কিনে আমার স্কুলের সহকর্মী ও পরিচিতজনের কাছে বিক্রি করি। বলে রাখা ভালো-আমি গামছা-শাড়ি দিয়ে পসরা-এর কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু অবশ্য পসরা’য় অনেক ধরনের পণ্য বিক্রি হয়।

‘নানা রকম পণ্যের সমাহার করার ইচ্ছে থেকেই এই নামটি বেছে নিই,’ যোগ করেন তিনি। নাম বাছাইয়ের কথা উল্লে করতে গিয়ে মিরপুরের একটি স্কুলের সাবেক শিক্ষিকা নুসরাত বলেন, ‘আমার পেজের নাম পসরা, যার অর্থ বিভিন্ন রকমের মনিহারী জিনিস। এক-দুটি পণ্যের মধ্যে যেন পসরা আটকে না যায়, সে জন্যই এ নাম বেছে নেয়া। কেবল পোশাক বা কেবল সাজসজ্জার পণ্য নয়। আমার মন যখন যা চাইবে, তা-ই যেন সব সময় তৈরি করতে পারি।’

নুসরাত এখন সেভাবেই কাজ করছেন। প্রায় সব ধরনের শাড়ি নিয়ে কাজ করেন তিনি। নিজেই শাড়িতে ডিজাইন করেন। জামদানি, মণিপুরী, কাতান, তাঁতের শাড়ি, বিভিন্ন ডিজাইনের গয়না নিজের হাতে তৈরি করেন। আবার শাড়ি, গয়নার পাশাপাশি সালোয়ার-কামিজ, কুর্তি ও ব্লাউজ নিয়েও কাজ করেন এই উদ্যোক্তা।

ঠাকুরগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। পরিবার থেকে সাহিত্য নিয়ে পড়ার উৎসাহ পান। ভর্তি হন রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজে। সেখান থেকেই বাংলা সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স সমাপ্ত করেন। এ ছাড়া চাকরির জন্য কলেজ নিবন্ধন পরীক্ষা পাস করেন। করেছেন বিএড।

উদ্যোগে স্বামীকে পাশে পাওয়ার কথা জানিয়ে নুসরাত বলেন, কিছু করার আগ্রহ দেখে আমার স্বামী আমাকে অনলাইনে এ উদ্যোগ শুরু করার পরামর্শ দেন। বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও দিয়েছেন তিনি। যা আমার ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

এদিকে নুসরাতের এ উদ্যোগে পরিচিত কয়েকজন ব্যক্তিও কর্ম পেয়েছেন। স্থায়ী কর্মী নেই। তবে আমার কাজে সহযোগিতা করতে পাঁচজন নারী রয়েছেন; যারা পণ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্যাকেজিং, কুরিয়ারে পৌঁছে দেয়ার কাজ করছেন। এর মাঝে টেইলারিংয়ে একজন এবং আরেকজন হাতের কাজ করেন।

কেমন সাড়া পেয়েছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে নুসরাতের হাস্যোজ্জ্বল উত্তর, ‘প্রতি মাসে কমপক্ষে ৮০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকার মতো পণ্য বিক্রি হয়। তবে বিভিন্ন উৎসবে আয় আরও বেশি হয়।’

নতুনদের উদ্দেশ্যে এই নারীর পরামর্শ, ‘এ দেশের সমাজ বাস্তবতায় নারীরা আসলে অনেক পিছিয়ে। প্রায়-ই শুনতে হয়- তোমাকে দিয়ে এটা হবে না। কিন্তু আমি কখনও এসবের তোয়াক্কা করিনি। এগিয়ে গেছি সব মোকাবেলা করে। তাই যারা নিজে কিছু করতে চায় তাদের অবশ্যই ঝক্কি-ঝামেলা পাশ কাটিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে এগিয় যেতে হবে। লেগে থাকলে সাফল্য আসবেই।’

আর নারী হিসেবে অনলাইন ব্যবসা করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের বিষয়ে নুসরাত বলেন, বিচিত্র ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। বিশেষ করে মেসেঞ্জারে কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে। প্রথমে বেশ মুষড়ে পরতাম। কিন্তু থেমে থাকিনি। ‘পসরা’ কে অনেক দূর নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহন করে নারীদের স্বালম্বী হওয়ার পথ দেখিয়ে দিতে চান নুসরাত জাহান।

যোগাযোগ করা হলে নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন উই-এর প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, নানা সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাদের নারীরা কর্মদক্ষতা দেখিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। এটা আমাদের জন্য গর্বের। ‘একদিন বিশ্বব্যাপী নারী উদ্যোক্তাদের এই জোয়ার ছড়িয়ে পড়বে,’ যোগ করেন তিনি। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান