পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তি জরুরী

বৈশ্বিক মহামারী আমরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ২০২০ সালে কোভিডের কারণে পুঁজিবাজার প্রায় দুই মাস বন্ধ রাখা হয়েছিল। যখন মার্কেট খোলা হলো এবং নতুন কমিশন দায়িত্ব নিল, তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা একটি ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে দিল। এই ফ্লোর প্রাইস দেওয়ার ফলে বড় ধরনের ধ্বশ থেকে বাজার রক্ষা পেয়েছে।

স্পর্শকাতর বাজার: আমি আগেও বলেছি, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা খুবই স্পর্শকাতর। অল্পতেই আতঙ্কিত হয়ে যায়। এটা মার্কেটের জন্য একটি খারাপ দিক। আমরা সব সময় বলে আসছি, আপনি যে স্টকেই ব্যবসা করুন না কেন, বুঝে শুনে করবেন। দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করবেন। ওভার প্রাইসে শেয়ার কিনবেন না। যদি ভালো স্টক হোল্ড করতে পারেন দীর্ঘসময়ের জন্য, ভালো একটা রিটার্ন পাবেন। ইতোমধ্যে আমাদের সূচক ৩৯০০ থেকে ৭২০০ পর্যন্ত উঠেছে। মার্কেটর সূচক ৭১৫০ যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সাইকোলজিক্যালি একটা বিষয় কাজ করছিল যে, সূচক মনে হয় এর উপরে আর যাবে না। তখন আমরা লক্ষ্য করলাম সূচক ৬৯০০ তে বারবার টাচ করছিলো। গতমাসে একটি ইস্যু ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ যোগ হওয়ার ফলে ইন্ডেক্স বড় ধরনের কারেকশন হয়ে গেল। ইন্ডেক্স ৭১০০থেকে ৬৪০০ তে নেমে এসেছে।

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব: ইউক্রেনে হামলার পর, সারা বিশ্বে স্টক মার্কেটে বড় ধরনের পতন হয়েছিল। এটা মার্কেটের নিয়ম। এটা আমরা এভোয়েড করতে পারি না। এটা নিছক একটা প্যানিক। আমাদের বিনিয়োগকারী অস্থির হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করল। যার ফলে ইনডেক্সের পতন হয়েছে। আমি গত দুই সপ্তাহে ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন মিডিয়ায় বলেছি বাজারে এই মুহূর্তে প্যানিক করার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমাদের পুঁজিবাজার বিনিয়োগের অনুকূলেই আছে। আমি যদি আমার প্রতিবেশী ভারতের সাথে কম্পেয়ার করি, তাদের মার্কেটে কোভিডের সময় সূচক ছিল ২৫৯০০ সেটা বেড়ে ৬৩০০০ গিয়ে ছিল। পরে কারেকশন হয়ে ৫৩০০০ এসেছে। বর্তমানে তাদের সূচক ৫৬০০০ এর আসেপাশে।

আমাদের বিনিয়োগকারী অল্পতেই প্যানিক হয়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা ভাবে সূচক মনে হয় আরো পড়বে। যার ফলে তাদের হাতে থাকা স্টক, লসে বিক্রি করে। এটা বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের বিনিয়োগকারীরা যদি বুঝে শুনে স্টক কিনে হোল্ড করে, তাহলে লস হবে না। আমি এখানে আরেকটি কথা যোগ করব, আপনারাই তো সঞ্চয়পত্র, এফডিআর কিনে পাঁচ বছর আর খোঁজ নেন না। তাহলে পুঁজিবাজারে আজকে স্টক কিনে কাল দাম পড়ে গেলে, কেন আপনারা অস্থির হয়ে বিক্রি করছেন? আপনি স্টক হোল্ড করেন। আমাদের ইকোনমিক অবস্থা এক দেড় মাসে এতটা খারাপ অবস্থায় যায়নি যে, আমাদের পুঁজিবাজার ৭০০ থেকে ৮০০ পয়েন্টের কারেকশন দরকার আছে। আমাদের মার্কেটের বর্তমান পিই রেশিও ১৪ পয়েন্ট আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পিই রেশিও ২৭ প্লাস। তার মানে, আমাদের মার্কেট বিনিয়োগের জন্য অনেক উপযুক্ত।

আমাদের শেয়ারবাজার বিনিয়োগ উপযোগি: যে কোনো বিচারে আমাদের স্টক মার্কেট এখন বিনিয়োগযোগ্য। আমাদের যে কোম্পানিগুলো ভালো ডেভিডেন্ড দিচ্ছে, সেগুলোর বেশিরভাগই আন্ডার ভ্যালুড হয়ে আছে। আরো একটি বিষয় হচ্ছে লো-পেইডআপ কোম্পানি। এ নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা ছিল, যে কোম্পানির গুলোর পেইড আপ ৩০ কোটি টাকার নিচে, ছয় মাসের মধ্যে তাদের পেইড আপ ৩০ কোটি টাকা করতে হবে। এই নির্দেশনার ফলে লো পেইড আপের কোম্পানিগুলো ভাইব্রেন্ট হয়েছিল। সম্প্রতি আমরা দেখেছি, ছোট পেইড আপের কিছু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, যাদের হিউজ রিজার্ভ আছে, তারা ক্যাশ ডিভিডেন্ড ডিক্লার করেছে। এটা দেখে অনেক বিনিয়োগকারী ভাবছে, হয়তো লো পেইড আপ সংক্রান্ত এসইসির নির্দেশনা মনে হয় কার্যকর হচ্ছে না। তাই লো পেইড আপ কোম্পানিগুলোর দাম কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আমি বলতে চাই, মার্কেট প্যানিক করার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং আশার কথা হচ্ছে, মাঝে আমাদের মার্কেটে লেনদেন যেভাবে কমে যাচ্ছিল, সম্প্রতি সেটা আবার বাড়ছে। বিনিয়োগকারীদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো, আপনার হাতে থাকা স্টক, লসে বিক্রি করার প্রয়োজন নেই। আপনি হোল্ড করেন। অবশ্যই প্রফিট পাবেন, যদি আপনি ভালো স্টকে বিনিয়োগ করে থাকেন।

বিএসইসি’র উদ্যোগ: সম্প্রতি পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে, রেগুলেটরি পক্ষ থেকে পজিটিভ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যার ফলে মার্কেট তার গতি ফিরে পেয়েছে। এরমধ্যে সার্কিট ব্রেকারের ইস্যুটা হচ্ছে খুব ভাল একটা টুলস। ব্যাংকগুলোকে দুই শতাংশ বিনিয়োগ করতে বলা হয়েছে। মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো বিনিয়োগ করবে বলেছে। এগুলো তখনই দৃশ্যমান হবে, যখন আমি দেখব মার্কেটে ভলিউম বাড়ছে। স্টক তার প্রাইস ফিরে পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা যারা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী আছি, আমাদেরকে লিডারের ভূমিকা রাখতে হবে। মার্কেটের ইন্ডেক্স উঠানামা করতেই পারে। যদি ট্রেড ভলিউম বাড়ে তাহলে আমরা বুঝতে পারি, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী মার্কেটে আছে। এখানে ইনভেস্ট করা যায়।

বর্তমান চ্যালেঞ্জ: আমি মনে করি পুঁজিবাজারের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা। আস্থা ফিরিয়ে আনতে গেলে আমাদের সর্বপ্রথম দরকার কর্পোরেট গভর্নেন্স প্রোপারলি কমপ্লাই করা। কোম্পানিগুলো লিস্টিং হচ্ছে, কিন্তু প্রোপারলি ডেভিডেন্ড দিচ্ছে না, ডিসক্লোজার দিচ্ছে না। যদিও রেগুলেটর এ ব্যাপারে সজাগ। অতীতে মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো রি ইউনিট ইস্যু করত। ক্যাশ ডিভিডেন্ড পে করত না। অথচ আইনে বলা ছিল রিয়েলাইজড গেইনের ৭০% মিনিমাম ক্যাশ ডেভিডেন্ড পে করতে হবে। আশার আলো হচ্ছে গতবার থেকে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয়া শুরু করেছে। আস্থা ফিরিয়ে আনতে গেলে আমাদের প্রত্যেকটি লেভেল থেকে পজিটিভ ভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। শুধু রেগুলেটরি না আমরা যারা হাউজে কাজ করছি, আমাদেরও দায়িত্ব আছে। বিনিয়োগকারীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। বিনিয়োগকারীদের প্রপার মেসেজ দেয়া। কোম্পানি সম্পর্কে বলা, যাতে বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়।

ভালো কোম্পানির লিস্টিং: পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করার জন্য ভালো কোম্পানিকে লিস্টিং করাটা অপরিহার্য। একটি কোম্পানি যখন লিস্টিং হয়, এতে তার প্রাইস ডিসকভারি হয়। যেমন একটি কোম্পানি বুকবিল্ডিং-এ ১০ টাকা ফেস ভ্যালু শেয়ার ৪০টাকাও রেট করতে পারে। যদিও একটি নির্দেশনা আছে দশ শতাংশের নিচে ডিভিডেন্ড দিলে, এই গ্রুপে থাকতে পারবে না। এটা কমপ্লাই করতে গেলে ৪০ টাকা প্রাইসেস শেয়ার যদি ২০ পার্সেন্ট ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয়। তাহলে তার ইলড হয় ৫ টাকা।

আরেকটা সমস্যা হচ্ছে কোম্পানিগুলো ব্যাংক থেকে সহজে লোন পেয়ে যাচ্ছে। এই লোনের কস্ট ম্যাক্সিমাম ৮-৯ শতাংশ। অনেকে কোম্পানি চিন্তা করে যদি আমি লিস্টেড হই। তাহলে আমার কমপ্লায়েন্স ইস্যু আছে। আমি অন্যের কন্ট্রোলে চলে যাব। আমার কমপ্লায়েন্সের খরচও আছে। লিস্টিং ফী আছে। কমপ্লায়েন্সের ডিপার্টমেন্ট থাকবে। কিন্তু এভাবে যদি চিন্তা করে, আমারা লিস্টিং হলে আমাদের ভ্যালু ডিসকভারি হবে। তাহলে কিন্তু লিস্টেড হতে আগ্রহী হবে। কোম্পানির হাতের স্টক এন্টারপ্রেনার হিসেবে বড় একটি ভ্যালু ক্রিয়েট হবে। এন্টারপ্রেনার হিসেবে আমাদের মাইন্ডসেট চেঞ্জ করতে হবে। এটা আমি মনে করি, সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা সিএসআর। ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনতে হলে ওনাদের বুঝাতে হবে। আপনারা লিস্টিং হন, লিস্টিং হলে সুবিধা শুধু ট্যাক্স রিবেট না। আপনার কোম্পানীর প্রাইস ডিসকভারি হবে। কোম্পানি হোল্ডিংয়ের ভ্যালু বাড়বে।

মোনার্ক হোল্ডিংসের ভিশন: আমি মোনার্ক সিকিউরিটি হাউজের সিইও হিসেবে বলতে –চাই, আমাদের ভিশন-মিশন হচ্ছে, আমরা ইতিমধ্যে একটি ওএমএস কম্পানি করেছি নয়টি ব্যাংকের সাথে। এই ওএমএস রান করাতে পারলে, আমরা সারাদেশে আউটলেট করার প্ল্যান করেছি। দেশের যেসব জায়গায় আউটলেট থাকবে, সেখানে ফ্রী ক্যাম্পেইন করে বিনিয়োগকারীদের মার্কেট সম্পর্কে বেসিক ধারণা দিব। নতুন নতুন বিনিয়োগকারী আনার চেষ্টা করব। হিউজ ফান্ড আছে, কারণ আমরা জানি, ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেট এখন কম। রিটার্ন কম। আমরা বিনিয়োগকারীদের বুঝানোর চেষ্টা করব। এই সেক্টরে যদি বুঝে বিনিয়োগ করেন, ভালো প্রফিট করতে পারবেন।

আপনারা জানেন মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেডের চেয়ারম্যান বিশ্ব বিখ্যাত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। উনার মাধ্যমে আরও যারা ক্রিকেট অঙ্গনে আছেন আইকন হিসেবে, উনাদেরকে পুঁজিবাজারে আনার চেষ্টা করব।

মো. আলমগীর হোসেন
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড