পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করে স্বাবলম্বী ফরিদপুরের সাহিদা

ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার সাহিদা বেগম একজন গৃহিনী। সাধারণ আর পাঁচটি গৃহিণীর মতই ছিলো তার জীবন। কিন্তু গৃহিণী তকমা পেছনে ফেলে তিনি এখন নারী উদ্যোক্তা, সফল নারী উদ্যক্তা। দেশে কৃষিতে যে ক’জন নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন সাহিদা তাদের প্রথম কাতারে। পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করে তিনি অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন। পেঁয়াজের বীজ তাকে করেছে স্বাবলম্বী, উদ্যক্তা।

সম্প্রতি আলাপ-চারিতায় এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, প্রায় ১৮-১৯ বছর ধরে পেঁয়াজের বীজের আবাদ করে চলেছেন তিনি। গত বছর প্রায় শতাধিক মণ পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করেছেন।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য মতে, গত মৌসুমে পেঁয়াজের বীজ বিক্রি হয়েছে ৫-৬ হাজার টাকা কেজি দরে। সাহিদা বেগমের ভাষ্য, চলতি মৌসুমেও পেঁয়াজ রোপন করেছি। ১৫ জনের মতো শ্রমিক কাজ করে নিয়মিত। তবে মৌসুমে শ্রমিকের সংখ্যা আরো বাড়ে তা বাড়ে।

বীজ উৎপাদনের জন্য যে পেঁয়াজ লাগানো হয়েছে তার ফলন আসবে এপ্রিল-মে মাসে। তখন তা সংরক্ষণ করে পরে বিক্রি করা হয় বলে জানালেন তিনি।

শুরুর দিনগুলোর কথা উল্লেখ করে উদ্যোক্তা সাহিদা জানান, কৃষক পরিবারের বউ হওয়ার কারণে আগে থেকেই নানা কৃষিকাজের সঙ্গে পরিচয় ছিল। মূলত পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের বিষয়টি মাথায় আসে তার শ্বশুরের কাছ থেকে। তিনি (সাহিদার শ্বশুর) পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করতেন। তবে তা ছিলো ছোট আকারে। কখনও বেশি করে ফলাননি।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শুরুটা মূলত শখের বশেই। ২০০৪ সালে ২০ শতক জমিতে পেঁয়াজ রোপন করি। সে বছর মাত্র দুই মন বীজ উৎপাদিত হয়। তা বিক্রি করে পেয়েছিলাম ৮০ হাজার টাকা। পরের বছর আরো বেশি পরিমাণ জমিতে পেঁয়াজ চাষ করার সিদ্ধান্ত নিই। সেই বছর ১৩ মণ বীজের ফলন হয়।

সাহিদা বেগম জানান,‘বীজ বিক্রি করে ভালো লাভবান হলাম। পরের বছর আরো জমি বাড়ালাম। ৩২ মণ বীজ উঠলো।’ এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সাহিদা বেগমকে। গত বছর ১৫ একর আর চলতি বছর ৩০ একর জমিতে পেঁয়াজ বীজের চাষ করেন । ঘরে তুলেছিলেন ২০০ মন বীজ। এরপরও চাহিদা পূরণ করতে পারেন না বলে জানান সাহিদা বেগম।

তার ভাষ্য, আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি জমিতে বীজের চাষ করলেও অনেক সময় চাহিদা পূরণ করতে পারি না। স্থানীয় হাট-বাজার তো বটেই, জেলা শহর ফরিদপুর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ী কিংবা কৃষকেরা বীজ সংগ্রহ করতে আসেন। অনেক কোম্পানিও যোগাযোগ করে।

‘আমাদের বীজ ভালো বলে চাহিদা থাকে। কৃষকরা অনেক খুশি। কারণ এর মধ্যে কোনো ঝামেলা নাই। নিজের প্রোডাক্ট তাই এ নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই।’
চাহিদা এমন ছিলো যে গত মৌসুমে যদি আরও বেশি থাকতো সেটাও বিক্রি করতে পারতেন বলে জানান তিনি।

পেঁয়াজ বীজ চাষের প্রক্রিয়া ও খরচা-পাতি প্রসঙ্গে এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, মৌসুমে পেঁয়াজের বাল্বের দাম অনেক বেশি থাকে। কীটনাশক, সার, সেচ দিতে হয়। অতিরিক্ত কুয়াশা, শীলাবৃষ্টি, ঝড়-বৃষ্টি বেশি হলেও বীজ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এসব বিষয়েও নজর দিতে হয়।

বীজ প্রক্রিয়াকরণের বিষয়টি তুলে ধরে সাহিদা বলেন, ক্ষেতে বীজ উৎপাদন করি। সেই সঙ্গে বাজারজাতসহ প্রক্রিয়াজাতকরণের দিকটি ভালোভাবে করার জন্য নিজেই কারখানা করেছেন। সেখান থেকেই বীজ প্যাকেটজাত করা ও ক্রেতাদের কাছে তা সরবরাহ করা হয়। তার তৈরি করা বীজ ক্রেতাদের কাছে পরিচিত ‘খান সিডস’ নামে।

তার এই কারখানায় কাজ করে স্থানীয় অনেক নারী-পুরুষ। এছাড়া তার অনুপ্রেরণায় পেঁয়াজ বীজের চাষ শুরু করেছেন স্থানীয় অনেক নারীও। স্থানীয় নগরকান্দা উপজেলার পুরাপাড়া গ্রামের নারী উদ্যোক্তা হালিমা বেগম বলেন, সাহিদা আপার দেখাদেখি আমিও শুরু করি পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন। ছোট আকারে করলেও আস্তে আস্তে তা বড় করেছি। সংসারে আয়-উন্নতি হচ্ছে।

স্থানীয় বাজারের ‘কৃষিঘর’ বীজ ভান্ডারের মালিক মিজানুর রহমান জানান, বীজের মান ভালো হওয়ার কারণে খান সিডস থেকে ৫০০ কেজির মতো বীজ কিনেছিলেন তিনি। এই বীজ থেকে চারা গজানোর হার বেশি থাকে বলে স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে চাহিদা রয়েছে প্রচুর।

এদিকে ফরিদপুর জেলায় পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সেরা চাষী হিসেবে পুরষ্কার পেয়েছেন সাহিদা বেগম। বর্তমানে উৎপাদন করছেন, রাজশাহী তাহিরপুর, সুপারকিং, সুখসাগর ও নাসিরকিং নামে পেঁয়াজের বীজ বীজ। এছাড়া হাইব্রিড পেঁয়াজের বীজও উৎপাদনও করছেন তিনি।

কৃৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে ফরিদপুরের অবস্থান দ্বিতীয়। আর পুরো দেশে পেঁয়াজের বীজের যে চাহিদা থাকে তার ৬০-৭০ ভাগ এককভাবে আসে ফরিদপুর জেলা থেকে।

সাহিদা জানালেন, তার এই উদ্যোগে সবসময় পাশে থাকেন স্বামী বখতেয়ার উদ্দিন; যিনি পেশায় একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। দুই মেয়ে রয়েছে সংসারে, যারা মাকে সব সময় সহযোগিতা করে আসছে। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান