বৃহত্তর রংপুরে খাল পুনঃখননে জলাবদ্ধতামুক্ত ৬,১০০ হেক্টর জমি আবাদযোগ্য

বৃহত্তর রংপুর জেলার পাঁচটি বিলুপ্ত খালের ৩০ কিলোমিটার অংশ সম্প্রতি পুনঃখননের ফলে দীর্ঘ তিন দশক পর ৬ হাজার ১শ’ হেক্টর জমি জলাবদ্ধমুক্ত হয়ে আবারো চাষাবাদযোগ্য হয়েছে।

এতে পুনঃখননকৃত খালগুলোর উভয়পাড় এবং সংলগ্ন এলাকার ৭৫ টি গ্রামের ১৯ হাজার ৫৭৫ জন কৃষক সরাসরিভাবে উপকৃত হয়েছেন। তারা এখন বর্ষা মৌসুমসহ প্রতিবছর এসব জমিতে তিনটি করে ফসল আবাদ করতে পারবেন। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে এসব খাল পুনঃখনন কাজ পরিচালনা করে ৬ হাজার ১শ’ হেক্টর জমিতে সেচ এবং ২ হাজার ৮শ’ হেক্টর জমিতে সম্পূরক সেচ প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

বিএমডিএ’র একজন কর্মকর্তা বাসস’কে জানান, ‘খালগুলোর পুনঃখননের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষকরা প্রতিবছর ৬০ কোটি টাকা মূল্যের অতিরিক্ত ৩০ হাজার ৫ শ’ টন ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হবেন। এছাড়াও, পরিবেশ ও জীব বৈচিত্রের উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রার মনোন্নয়ন হবে।’ বিএমডিএ পাঁচ বছর মেয়াদি (২০১৯-২০২৪) ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ (ইআরপি) প্রকল্পের আওতায় ২৫০.৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৩০ কিলোমিটার বিলুপ্ত খাল, নদী, বিল ও অন্যান্য জলাশয় পুনঃখনন কাজ বাস্তবায়ন করছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের শুরুতে গত এক বছরে রংপুরের বিভিন্ন উপজেলায় মরা তিস্তা খালের ৪.৫০ কিমি অংশ, ঘিরনই খালের ৩.৫০ কিলোমিটার, ছতরা খাল ও শালমারা খালের প্রতিটির আট কিলোমিটার করে এবং কুড়িগ্রামের বোয়ালেরদাড়া খালের ছয় কিলোমিটার অংশ ইতিমধ্যেই পুনঃখনন সম্পন্ন হয়েছে। সম্প্রতি বাসসে’র সঙ্গে আলাপকালে স্থানীয় সুবিধাভোগী কৃষক, গ্রামবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, বিলুপ্ত হওয়া পাঁচটি খালের আংশিক পুনঃখনন ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হওয়ায় সেচ, বনায়ন, হাঁস পালন ও মাছ চাষ ও গৃহস্থালির কাজে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের বিস্তৃত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার কালুপাড়া ইউনিয়নের শংকরপুর গ্রামের কৃষক মশিউর রহমান জানান, বিলুপ্ত মরা তিস্তা খালের ৪.৫০ কিলোমিটার অংশের পুনঃখনন হওয়ায় খালটিতে জলের প্রবাহ পুনরুদ্ধার হয়েছে। ফলে, বৃষ্টি ও বন্যার পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। ‘পুনরায় খনন করা খালটি অতি সাম্প্রতিক সময়ে বৃষ্টির পানি দ্রুত যমুনেশ্বরী নদীতে প্রবাহিত হওয়ায় আমার ২.৬২ হেক্টর জমি তিন দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়েছে। আমি এই জমিতে এখন আমন ধানের চাষ করছি,’-তিনি বলেন।

বদরগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের কাজীপাড়া গ্রামের কৃষক গোলাম মর্তুজা জানান, তিনি কখনই ভাবতে পারেননি যে তার দেড় হেক্টর জমি বর্ষাকালেও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে আবার আবাদযোগ্য হতে পারে। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি বিলুপ্ত ঘিরনই খালের ৩.৫০ কিলোমিটার অংশ পুনঃখননের ফলে আমার দেড় হেক্টর জমি জলাবদ্ধতা মুক্ত হয়েছে। আমি এখন থেকে উক্ত জমিতে বর্ষাকালে আমন ধানসহ প্রতিবছর তিনটি ফসল চাষ করতে পারব।’

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বেরুবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মোতালেব বলেন, বিএমডিএ ইতোমধ্যেই ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ বোলেদারদার খালের ৬ কিমি অংশ পুনঃখনন করায় এলাকার ২৫ টি গ্রামের ৬ হাজার কৃষক সরাসরি লাভবান হয়েছেন। খালটি পুনঃখনন স্থানীয় ৯ হাজার পরিবারের প্রায় ৪০ হাজার মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা এখন সেচ এবং পরিপূরক সেচ, হাঁস পালন, মাছ চাষ ও গৃহস্থালির কাজে খননকৃত খালে সংরক্ষণ করা পানি ব্যবহার করতে পারছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

একই ইউনিয়নের চর বেরুবাড়ী গ্রামের কৃষক আবদুল হালিম জানান, খালটি পুনঃখননের ফলে তার ছয় বিঘা জমি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেয়েছে। তিনি এখন থেকে সেখানে প্রতিবছর তিনটি ফসল চাষাবাদ করতে পারবেন। রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা ইউনিডনের বড় বান্দানপাড়া গ্রামের কৃষক কায়কোবাদ মন্ডল জানান, ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ চতরা খালের আট কিলোমিটার অংশ পুনঃখননের ফলে ওই এলাকায় ৯০০ হেক্টর জমি জলাবদ্ধতা মুক্ত হয়ে পুনরায় বর্ষা মৌসুমে আবাদযোগ্য জমিতে পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমি গত তিন দশকে এবারই প্রথমবারের মতো আমার পাঁচ বিঘা জলাবদ্ধতা মুক্ত হওয়া জমিতে এখন আমন ধান চাষ করছি। খালটি পুনঃখননের ফলে এলাকার ১২টি গ্রামের ১৯,০০০ মানুষ উপকৃত ও আনন্দিত হয়েছে।’ রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ভাঙ্গনী ইউনিয়নের ভাগবানপুর গ্রামের কৃষক বাদশা মিয়া জানান, ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ শালমারা খালের ৮ কিলোমিটার অংশ সম্প্রতি পুনঃখননের ফলে তার তিন একর জমি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেয়েছে। তিনি এখর ওই জমিতে আমন ধান চাষাবাদ করছেন।

বাসসে’র সঙ্গে আলাপকালে সাথে ইআইআর প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এবং বিএমডিএ’র রংপুর সার্কেলের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার হাবিবুর রহমান খান বলেন, ২০২৪ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ সমাপ্ত হলে বৃহত্তর রংপুরের হাজার হাজার মানুষ বহুমাত্রিক সুবিধা উপভোগ করবেন। তিনি আরও বলেন, ‘বৃহত্তর রংপুরের রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধার ৩৫ টি উপজেলায় আর্থ-সামাজিক বিকাশ ত্বরান্বিত করার জন্য ভূপৃষ্ঠের পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের সংরক্ষণ এবং সুরক্ষার জন্য সমন্বিত ইআইআর প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ চলছে।’

বৃহত্তর রংপুর জেলার বিলুপ্ত জলাশয়গুলি পুনঃখননের ফলে সেগুলোর পানি ধারণক্ষমতা ও ভূগর্ভস্থ পানি স্তরের পুনর্ভরণ বৃদ্ধি পাবে, পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থা সহজতর হবে এবং কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরতা হ্রাস করবে। ইঞ্জিনিয়ার খান আরও বলেন, ‘পুনঃখননকৃত খালগুলির প্রতি এক কিলোমিটার দৈর্ঘে সংরক্ষিত ভূ-পৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করে ৩০ হেক্টর জমিতে সেচ এবং ১০০ হেক্টর জমিতে পরিপূরক সেচ প্রদান করা সম্ভব হবে।’ তথ্য-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান