ব্যবসা-উন্নয়ন গতির সঙ্গে সাপোর্ট সার্ভিস মিলছে না

‘এখনকার অনেক নীতিই আমাদের অগ্রগতির সঙ্গে ম্যাচ করতে পারছে না। মিয়ানমারে সরকার আগে থেকে পলিসি তৈরি করে রাখে। ঘোষণা করে দেয়। সেই পলিসি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ আসে। আমাদের এখানে ঠেকে ঠেকে পলিসি হচ্ছে। কেউ কোনো সমস্যার মুখে পড়লে তাৎক্ষণিক সরকারের কাছে যাচ্ছেন। তখন এটার সমাধান হচ্ছে। কিন্তু সমস্যায় পড়ার আগে পলিসি তৈরি করে রাখা উচিত। এবছরের বাজেট যদি দেখেন- এ বছর বাজেটে ভ্যাট বাস্তবায়ন করা নিয়ে ব্যবসায়ী এবং সরকারের মধ্যে রীতিমত একটা দ্বন্দ্ব তৈরি দেখা গেল। এটা তো আশা করি না। আমার মতে সরকারের ভ্যাট পুরোপুরি প্রত্যাহার করাটা ঠিক হয়নি। অনেকগুলো পণ্য আগে থেকেই ১৫% ভ্যাটের আওতাভুক্ত। এর সঙ্গে সামান্য কিছু বাড়াতে পারতো। অনেক জায়গায় আবার ছাড়ও দিতে হতো। কিন্তু সরকার পুরোপুরি আবার আগের জায়গায় চলে গেছে। এটা আমার মনে হয় ঠিক হয়নি। যে কারণেই হোক আমাদের অগ্রগতিটা কিন্তু একটু হলেও পিছিয়ে আছে। হয়ত আমরা ৭ পার্সেন্ট জিডিপি ক্রস করে যেতে পারতাম। এই যে আমাদের একটা পেছন-টান আছে এটা আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না। যেহেতু অগ্রগতি আছে আমরা সবাই খুশি হচ্ছি’ — দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে এসব কথা বলেছেন, রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান। আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন এবি টিভির সঙ্গে তাঁর কথপোকথনের চুম্বক অংশ তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

ব্যবসা-বাণিজ্যের চ্যালেঞ্জ

আমাদের দেশের ইকোনোমিক গ্রোথ হচ্ছে। আমাদের প্রতিটি পণ্যের কনজামশন বাড়ছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে। এক্সপোর্ট বেড়েছে। বর্তমানে ব্যবসা সম্প্রসারণের পাশাপাশি যে ধরনের সহযোগিতা থাকা দরকার সেগুলো নেই। ট্রেড লাইসেন্স থেকে শুরু করে ব্যবসার যে সাপোর্টগুলো পাওয়া দরকার সেগুলো সেভাবে পাচ্ছি না। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে যে লাইসেন্সগুলো নেওয়া দরকার সেখানেও ভোগান্তির শিকার হতে হয়। বিদ্যুৎ সংযোগ, গ্যাসের কানেকশন, ব্যাংকিং সাপোর্ট, পোর্ট ফ্যাসিলিটি সাপোর্ট থেকে শুরু করে কোনো সাপোর্টই সেভাবে এগোচ্ছে না। আমাদের দেশ, আমাদের অর্থনীতি যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সে গতিতে সহযোগিতার বিষয়গুলো জরুরি। সহায়তা পেতে আগের তুলনায় এখন আরও বেশি সময় লাগে। আগে একটি পাসপোর্ট করতে ১৫ দিন সময় লাগত। এখন সেটি কমে ৭ দিন হওয়ার কথা সেখানে এখন সময় আরও বেশি লাগে। ব্যাংকের সহায়তা পেতে আগে তিনটি জায়গা থেকে অনুমতি নিলে হতো এখন পাঁচটি জায়গা থেকে নিতে হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও ছাড়পত্র নিতে হয় আবার অন্যান্য অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও লাগে। এতে বেশি সময় লাগছে। অর্থব্যয়ও বেশি হচ্ছে। এসব প্রক্রিয়া যত সহজ করা হবে আমাদের গ্রোথ তত দ্রুত হবে। আবার সরকারের পলিসি সাপোর্টের ব্যাপারটাও রয়েছে। দেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের কতটুকু সুবিধা দেওয়া হবে, লেডি এন্টারপ্রেনারদের জন্য কী করা হবে, ম্যাচিউরড এন্টারপ্রেনারদের জন্য কী করা হবে? দেশের শিল্প স্থাপনের জন্য কোন ধরনের নীতিমালা গ্রহণ করা উচিত? দেশের রপ্তানি বাড়াতে করণীয় কী? এমন সব বিষয় নিয়ে সরকারের ভাবতে হবে। এখনকার অনেক নীতিই আমাদের অগ্রগতির সঙ্গে ম্যাচ করতে পারছে না। মিয়ানমারে সরকার আগে থেকে পলিসি তৈরি করে রাখে। ঘোষণা করে দেয়। সেই পলিসি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ আসে। আমাদের এখানে ঠেকে ঠেকে পলিসি হচ্ছে। কেউ কোনো সমস্যার মুখে পড়লে তাৎক্ষণিক সরকারের কাছে যাচ্ছেন। তখন এটার সমাধান হচ্ছে। কিন্তু সমস্যায় পড়ার আগে পলিসি তৈরি করে রাখা উচিত। এবছরের বাজেট যদি দেখেন- এ বছর বাজেটে ভ্যাট বাস্তবায়ন করা নিয়ে ব্যবসায়ী এবং সরকারের মধ্যে রীতিমত একটা দ্বন্দ্ব তৈরি দেখা গেল। এটা তো আশা করি না। আমার মতে সরকারের ভ্যাট পুরোপুরি প্রত্যাহার করাটা ঠিক হয়নি। অনেকগুলো পণ্য আগে থেকেই ১৫% ভ্যাটের আওতাভুক্ত। এর সঙ্গে সামান্য কিছু বাড়াতে পারতো। অনেক জায়গায় আবার ছাড়ও দিতে হতো। কিন্তু সরকার পুরোপুরি আবার আগের জায়গায় চলে গেছে। এটা আমার মনে হয় ঠিক হয়নি। যে কারণেই হোক আমাদের অগ্রগতিটা কিন্তু একটু হলেও পিছিয়ে আছে। হয়ত আমরা ৭% জিডিপি ক্রস করে যেতে পারতাম। এই যে আমাদের একটা পেছন-টান আছে এটা আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না। যেহেতু অগ্রগতি আছে আমরা সবাই খুশি হচ্ছি।

আমাদের দেশে বিনিয়োগে চ্যালেঞ্জ
আমি প্রথমেই একটি উদাহরণ দিচ্ছি- আমরা এলপিজি’তে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে আমার প্রথম সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়া। এর পর ‘বিশেষ শিল্পে’র ছাড়পত্র নিতে হয়। বিষয়গুলো সময় সাপেক্ষ। এগুলোতে অনেক সময় নষ্ট করে দেয়। একেকটা জায়গা থেকে একেকটা ছাড়পত্র নিতে হবে। এই ছাড়পত্রগুলো নেওয়ার প্রয়োজন আছে। তবে ওয়ানস্টপ সার্ভিস হলে সুবিধে হয়। তা না হলে আমাদের এখানে-সেখানে দৌঁড়া-দৌঁড়ি করেই অনেক সময় চলে যায়। দেখা যায়, ছাড়পত্র পেতেই এক বছর চলে যাচ্ছে। এটা একটা বড় বাধা। এ ধরনের বাধাগুলো ইনভেস্টমেন্ট দমিয়ে দিচ্ছে। এবং মানুষকেও অনেক পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। দেখা যায়- একজন একটি ফ্যাক্টরি করে ইলেকট্রিসিটি চাচ্ছেন, তখন বলা হয়, না,এখন ইলেকট্রিসিটি দেওয়া যাবে না । সে গ্যাস কানেকশন পাবে আশা করে ফ্যাক্টরিটা করেছে, কিন্তু গ্যাস পাচ্ছে না। আবার গ্যাস পাবে কি পাবে না, সে বিষয়েও ফ্যাক্টরি করার আগে ছাড়পত্র পাওয়া যাচ্ছে না। এ সব কারণে অনেকেই নতুন উদ্যোগ নিতে সাহস পাচ্ছে না। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। দেখা গেছে- একজন বিদেশি ইনভেস্টর জমি কিনতে গেছে। সেখানে ভেজাল দেখে সরে আসছে। তবে এত কিছুর পরও ভালো কিছু হচ্ছে। ইকোনোমিক জোন তৈরি হচ্ছে। ইকোনোমিক জোনের মধ্যে জমি কিনলে কেউ এসে বলতে পারবে না, এখানে আমার ভাগ আছে। এখানে ইন্ডাস্ট্রি করতে দেওয়া যাবে না। এসবের সুবিধা আমরা পাব। কিন্তু প্রসেসটা অনেক স্লো হয়ে যাচ্ছে।

ওয়ানস্টপ বিজনেস সার্ভিস
ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস আমাদের দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল। সম্প্রতি সরকার এটির ঘোষণা দিয়েছে। বিডা-কে দায়িত্বও দিয়েছে। তবে এখনো ব্যবহারিকভাবে কাজের বাস্তবায়ন হয়নি। এটার জন্য যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমস্যা রয়েছে সেগুলোও আলোচনার মধ্যে এসেছে। ধরুন- ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু হলো। তারা বলে দিল- এখানে ২০০০ কিলোওয়াটের অনুমতি দেওয়া হলো। কিন্তু পিডিবি বলল, ২০০০ দেওয়ার ক্ষমতাই আমার নেই। তোমার পারমিশনে কী আসবে যাবে? এরকম কিছু প্র্যাক্টিক্যাল সমস্যা আছে। এগুলো নিয়ে বিডা আলোচনা করে যাচেছ। এখন পর্যন্ত সঠিক সমাধানের পথ আসেনি। সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। এখন সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।

এলপিজিতে রানারে’র বিনিয়োগ
কিছুদিন আগেও একজন মন্ত্রী বলেছেন, আমাদের দেশে কম দামে জ্বালানি পাওয়ার সুযোগ আর নেই। এর পরও অনেকে এলপিজি ব্যবসায় আসছে। গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। দাম কম-বেশি পরের কথা। আগে পর্যাপ্ত থাকতে হবে। পর্যাপ্ত থাকলে দাম বেশি হলেও মানুষ নিবে। আমরা যদি বাজারে সহজলভ্য করতে পারি, তাহলে যে মূল্যে আমরা প্রোডাক্টটা পাব, তার উপরে একটা মূল্য নির্ধারণ করে, বাজারে ছাড়তে পারব। আমার মতে, উচ্চ মূল্যের চেয়ে সংকট আরো বেশি খারাপ।

অন্যন্য জ্বালানির কথা বলতে গেলে দেখা যাবে, আমাদের সিএনজি পর্যাপ্ত নয়। বিকল্প হিসেবে থাকছে এলপিজি। আমাদের এলপিজি’র একটি বড় অংশ গৃহকাজে ব্যবহার হচ্ছে। রান্নার কাজে ব্যবহার হয়। আগে মানুষ গ্যাসের বদলে কাঠ ব্যবহার করতো। এখন কাঠ ব্যবহার করবে কোথা থেকে? আমাদের তো পর্যাপ্ত কাঠও নেই। এখন কাঠ ব্যবহার করতে গেলে গাছ-গাছালি উজাড় হয়ে যাবে। তাছাড়া আমাদের আরও গাছ লাগানো উচিত। সেখানে কিভাবে গাছ উজাড় করে রান্নার কাজ করা হবে? এজন্য এলপিজি গ্যাস দরকার। এখানে দাম বিষয় নয়। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য করেই দাম নির্ধারণ করা হবে। বর্তমানে এলপিজি নিয়ে একটি প্রতিযোগিতা আছে। তবে এর মূল্যমান প্রতিযোগিতাই ঠিক করে দেবে। প্রতিযোগিতাই বাজারে সঠিক মূল্য নির্ধারণ করে দেয়।

শিল্প উন্নয়নে করণীয়
আমাদের শিল্পের জন্য সবার আগে অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার। এরপর আমাদের পোর্ট ফ্যাসিলিটির বড় ধরনের উন্নয়ন দরকার। যদিও এসব দিকে কাজ হচ্ছে। এরপর জ্বালানি, ইলেকট্রিসিটি তো আছেই। এসকল বিষয়েই সরকার অবহিত আছে। একইসঙ্গে সরকারের পদক্ষেপও দেখতে পাচ্ছি। কিছু দীর্ঘ মেয়াদি,কিছু স্বল্প মেয়াদি। তবে কাজ হচ্ছে। এটিই আমাদের আশার জায়গা।

হাফিজুর রহমান খান
চেয়ারম্যান
রানার গ্রুপ