‘ব্লু-ইকোনমি’ বাড়াতে পারে প্রবৃদ্ধি

‘ব্লু-ইকোনমি’র সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে আগামি এক দশকে দেশের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞগণ। প্রতিবেশি রাষ্ট্র মায়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ মীমাংসার পর তারা দেশের সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদ নির্ভর ‘ব্লু-ইকোনমি’ খাতে এ বিপুল সম্ভাবনা দেখছেন। তারা বলেন, পাশাপাশি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে জাতীয় অর্থনীতিতে ‘ব্লু-ইকোনমি’ থেকে বাংলাদেশকে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন নিশ্চিত করতে হবে।

এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর অনারারি ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশের স্থলভাগের আয়তনের পাশাপাশি সমুদ্রসীমার আয়তনও উল্লেখযোগ্য। বিদ্যমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেশের স্থলভাগের পাশাপাশি সমুদ্রসীমার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল নিয়েও ভাবতে হবে। তিনি বলেন, ‘সমুদ্রের সম্পদ আহরন, এই সম্পদ সংরক্ষন ও টেকসইভাবে কাজে লাগাতে হবে’।

অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, সমুদ্র সম্পদের মধ্যে তেল-গ্যাসসহ বিভিন্ন খনিজ সম্পদ এবং মৎস্যসহ বিভিন্ন প্রানিজ সম্পদ রয়েছে। এগুলো যথাযথভাবে আহরণের জন্য দক্ষ জনবল এবং পর্যাপ্ত আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি প্রয়োজন।

তিনি বলেন, ‘সমুদ্রভিত্তিক ‘ব্লু-ইকোনমির সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে আমরা আগামি একদশকে দেশের প্রবৃদ্ধির গতিকে ১০ শতাংশে নিয়ে যেতে পারবো’।
সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও এখাতে সমন্বয়ের লক্ষ্য নিয়ে সরকার ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ব্লু-ইকোনমি সেল গঠন করে। এই সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব গোলাম শফিউদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ব্লু- ইকোনমি সেল সংশ্লিষ্ট ১৭টি মন্ত্রনালয় ও বিভাগের কার্যক্রম সমন্বয় করছে । প্রতি দুইমাস পরপর এই সেলের সভা অনুষ্ঠিত হয়।

উন্নত অর্থনীতির জন্য সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদ থেকে জিডিপিতে ৫ শতাংশ যোগ করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সমুদ্র ভিত্তিক অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময়। এ ব্যাপারে সরকার খুবই আন্তরিক।’

সমুদ্র নির্ভর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরে তিনি জানান, ইতিমধ্যে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম চলছে। পাশাপাশি গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় উদ্যোগ নিয়েছে। এতে সহায়তার জন্য বাংলাদেশ নৌ বাহিনী এগিয়ে এসেছে। পর্যটন খাতেও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

গত বছরের ২২ ও ২৩ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘ব্লু-ইকোনমি’ বিষয়ক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘ব্লু-ইকোনমি কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে। বাংলাদেশ ২০১৯ সালের মধ্যে ৮ শতাংশ, ২০২৫ সালে ৯ শতাংশ এবং ২০৩০ সালে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্য নির্ধারন করেছে তা বাস্তবায়নে ব্লু-ইকোনমি থেকে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অবশ্যই আনতে হবে’

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাওসার আহমেদ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৪ সালে ‘দি টেরিটোরিয়াল ওয়াটার অ্যান্ড ম্যারিটাইম জোনস অ্যাক্ট ১৯৭৪’ নামে একটি আইন পাস হয়।

তিনি বলেন, ‘সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশেই শুধু নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই এ বিষয়ে ওইসময় সচেতনতা ছিল না। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বিচক্ষন ছিলেন বলেই ১৯৭৪ সালে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত আইন পাস করেছিলেন’।

কাওসার আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শীতা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক, সাহসী ও সময়োপযোগি সিদ্ধান্তের ফলেই বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে’।

মেরিটাইম অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমিও দেশকে অতিদ্রুত উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দিতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে জাতীয় অর্থনীতিতে ‘ব্লু-ইকোনমি’ থেকে বাংলাদেশকে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন নিশ্চিত করতে হবে’।

তিনি আরও বলেন, ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হওয়ার পর দেশের মূল ভূখন্ডের সমপরিমাণ প্রায় ৮১ ভাগ সমুদ্র থেকে সম্পদ আহরণের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা সমুদ্রের পরিবেশ নষ্ট না করে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে।

তিনি বলেন, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহন করার পরপরই বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দেন। দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনায় কোন ইতিবাচক সমাধান না হওয়ার বঙ্গোপসাগরে অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয় নেয় বাংলাদেশ।

২০০৯ সালের অক্টোবরে দুই প্রতিবেশি রাষ্ট্র মায়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে যথাক্রমে জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে (ইটলস) এবং নেদারল্যান্ডস -এর দ্যা হেগ শহরে অবস্থিত স্থায়ী সালিশি আদালতে (পিসিএ) আবেদন করে বাংলাদেশ।

কাওসার আহমেদ বলেন, ‘২০১২ সালের মার্চে ইটলস-এর রায় এবং ২০১৪ সালের জুলাইয়ে স্থায়ী সালিশ আদালতের রায়ের মাধ্যমে যথাক্রমে মায়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। ফলে প্রায় চারদশক ব্যাপি বিরোধের অবসান ঘটায় বাংলাদেশ লাভ করে একটি স্থায়ী সমুদ্রসীমা, যার মোট আয়তন ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার’।

আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অনুযায়ি, বেজলাইন বা উপকূলীয় তটরেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রিয় সমুদ্র অঞ্চল, তটরেখা থেকে ২৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সংলগ্ন অঞ্চল, তটরেখা থেকে দুইশ’ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ ছাড়াও একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরের ১৫০ নটিক্যাল মাইল তথা তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপান।

কাওসার আহমেদ বলেন, আগামি বছরের শেষ নাগাদ মহীসোপান সংক্রান্ত সিএলসিএস-এর রায় পাওয়া যাবে। এটা রায় বাংলাদেশের অনুকূলে যাবে আসবে বলেই আশা করা যায়।

তিনি বলেন, মেরিটাইম নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা, সাগরে পর্যটন, সাগরের ঢেউ ও বায়ু থেকে শক্তি উৎপাদন, তীরবর্তী অঞ্চল থেকে খনিজ আহরণ, অগভীর সাগরে নতুন ভূমি সৃষ্টি, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, মৎস্য সম্পদ আহরণ, নির্বিঘ্ন নৌ চলাচল, নৌদূষণ দূরীকরণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলবায়ূ পরিবর্তন মোকাবেলা এবং এসকল ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল সৃষ্টিসহ সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও পরিবহন সংক্রান্ত সকল বিষয় গবেষণা ও উন্নত শিক্ষা একান্ত আবশ্যক।

সমুদ্র সম্পদ আহরন ও এখাতে সমন্বয়ের লক্ষ্য নিয়ে গত বছরের ৫ জানুয়ারি ‘ব্লু ইকোনমি সেল’ উদ্বোধন করা হয়। ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, সমুদ্রে সম্পদ আহরণে ব্লু ইকোনমি সেল সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করবে।

সূত্র: বাসস

আজকের বাজার:এলকে/ ১৪ জানুয়ারি ২০১৮