ভালো আইপিও না আসার অন্যতম কারণ ‘দীর্ঘসূত্রিতা’

মাহবুব এইচ মজুমদার : আমরা পুঁজিবাজার বলতে বেশিরভাগ সময়েই শুধু সেকেন্ডারি মার্কেটকেই বলি। আসলে পুঁজিবাজারের দুইটা অংশ একটি প্রাইমারি এবং আরেকটি সেকেন্ডারি মার্কেট। তবে বর্তমানে যেটা আলোচিত আর সমালোচিত বিষয় সেটা সেকেন্ডারি মার্কেট নিয়ে। পুঁজিবাজারের এখন উদ্বেগের কারণ হলো টানা ১২ থেকে ১৩ দিন বাজারের সূচকের পতন।

যদিও মাঝখানে একদিন একটু পজেটিভ ছিলো। মূলত এই যে মার্কেট ডাউন ট্রেন্ডে ১২ দিন ছিল সেটা আমরা গত ১০ বছরে কমই দেখেছি। অনেক দুর্যোগের সময়ও এরকম অবস্থা দেখিনি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মূল সূচকের প্রায় ১ হাজারের মত কমে গেছে। যা শতকরা ১৫ শতাংশের মত কমেছে প্রায়।

কেন এই পতন হলো, বাজারের এই পতনের সত্যিই কোন কারণ কি আছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে আমি বলবে, সূচক পতনের সত্যিই তেমন কোন কারণ নেই। বাজারে তারল্য কখনও বাড়বে আবার কখনও কমবে এটাইতো বাজারের বৈশিষ্ট্য। বাজারে মানি সার্কুলেশন কিছুটা কম আছে সেটা সত্যি, কিন্তু তেমন কোন মানি সার্কুলেশন কমে যায়নি যেটার ফলে বাজার খারাপ হবে। পুঁজিবাজারের বর্তমান সূচকের পতনের অন্যতম কারণ আতঙ্ক। মানি মার্কেটে মানি না থাকার কারণ, যেভাবে ব্যাংকের কার্যকলাপ পরিচালনা করা দরকার ছিল সেভাবে পরিচালনা করতে পারেনি। ফলে সেটার প্রভাব পুঁজিবাজারে পরেছে।

মার্কেটে মানি সার্কুলেশন কিছুটা কমবে। কারণ ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেট বেড়ে গেছে। তাই পুঁজিবাজারে টাকার কিছুটা সংকট হতে পারে। ফলে কিছু টাকা ব্যাংকের ফিক্সট ডিপোজিটে চলে যাবে, কারণ লোকজন মনে করে ব্যাংকে রাখা পুঁজিবাজারের চেয়ে ঝুকি কম। যেটা পুঁজিবাজারের জন্য নেতিবাচক। পৃথিবীর সব দেশেই এফডিআরের রেট অনেক কম।

এমনও দেশ আছে যেখানে ব্যাংকে টাকা রাখলে ব্যাংক আরও চার্জ করে। আরেকটা ভুল সেভিংস সার্টিফিকেট, সরকার এই স্কিমটা চালু করেছে অনেকটা সোস্যাল সিকিউরিটির জন্য নিম্ন আয়ের কিংবা পেনশন হোল্ডারদের জন্য। কিন্তু সেটার অপব্যবহার হচ্ছে বিভিন্নভাবে। যেখানে কৌশলে উচ্চবৃত্ত বা মধ্যবৃত্তরা এই সুযোগটা নিচ্ছে। ফলে সরকারকে অনেক টাকা সুদ গুনতে হচ্ছে এই খাতে।

তারপর আইসিবিকে মার্কেট মেকার হিসেবে কাজ করতে হয় যাতে পুঁজিবাজারে গতিশীল থাকে। আইসিবি গঠনের উদ্দেশ্য ছিল এটাই। কিন্তু বর্তমানে আইসিবির তেমন সাপোর্ট বাজারে নেই। আইসিবি যা শেয়ার কিনে তার চেয়ে বেশি বিক্রি করছে। যার ফলে শেয়ারের সাপ্লাই বেড়ে গেছে। এবং তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।

তারপর বাংলাদেশ ব্যাংক যে রিজার্ভ রেশিও কমিয়েছে সেটা পুরো অর্থনীতি ব্যবস্থার উপর কমানো হয়েছে। যার ফলে এর সুফলটা পুঁজিবাজার খুবই সামান্য পরিমানে আসবে। আবার পুঁজিবাজারে নীতিগত নিরাপত্তায় আমাদের যে দাবিগুলো ছিলো যেমন, এক্সপোজাল গণনার ভুল, নন লিস্টেট শেয়ার বাজারে নিয়ে আসা এই ধরণের প্রতিষ্ঠিত ভুলগুলোর ব্যপারে অর্থমন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ থাকা শর্তেও বাংলাদেশ এ ব্যপারে কিছুই করেনি। এটাও একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে পুঁজিবাজারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি এই নীতিগুলো ঠিক না করে তবে পুঁজিবাজারে কিছুটা সমস্যা থেকেই যাবে। যেকোনো দেশে পুঁজিবাজার যত শক্তিশালী, সে দেশের অর্থনীতি তত শক্তিশালী। পুঁজিবাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ করার দরকার নেই। ইন্ডাস্টিজগুলো হবে পুঁজিবাজার থেকে টাকা নিয়ে। এজন্য পুঁজিবাজারকে সচল করতে হবে।

পুঁজিবাজারকে সচল করতে হলে প্রথমত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুল পদ্ধতিগুলো সংশোধন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, রেগুলেটরদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করতে হবে। তৃতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ভূমিকাকে ক্ষতিযে দেখা উচিত।

কোন কোন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী রিটেল ট্রেডারের মতো কাজ করছে, সে নাম নিয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর এবং লাইসেন্সও নিয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর। কিন্তু তার অর্থনৈতিক ব্যবহার ডে ট্রেডারের মতো দেখা যাচ্ছে। এই বিষয়গুলো বন্ধ করতে হবে।

গত ১৩ দিনে আমাদের দেশে পুঁজিবাজারে সূচক ১৫ শতাংশ কমেছে। ২০১৫ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে চীনে দুই সপ্তাহের মধ্যে সূচক পড়ে গিয়েছিলো ৩০ শতাংশ। কিন্ত ঘটনায় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থ্যাগুলো পদক্ষেপ নিয়ে ওই পরিস্থিতির মোকাবেলা করে। তবে আমাদের দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই বিষয়গুলোকে তো বেধেই রেখেছে। ভুল গণনার পদ্ধতি করছে তারা। এই বিষয়গুলো ঠিক করতে হবে।

এখন নির্বাচনী বছর হিসেবে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা মার্কেট ভালো থাকবে। বিষয়গুলোর উপর নজর দেওয়া হলে দ্রুতই সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে যাবে। তবে এ ব্যাপরে সরকারের উচ্চ মহল থেকে আজ পর্যন্ত দেখিনি একটা কমিটি গঠন করতে।

আমাদের যে ‘সিভিল অ্যাকশন’ কমিশন আছে তাদের সাথে বসেও এ বিষয়ে কখনো আলোচনা করেনি। আর করলেও সেটা ছিলো আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা। কার্যকরি কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

বড় বড় প্রজেক্টগুলো কিভাবে পিপির অধিনে পুঁজিবাজারে করা যায় এবং এত বছর বলার পরেও একটা সরকারি শেয়ার পুঁজিবাজারে আনতে পারেনি এ সমস্ত কিছুর জন্য আমার কাছে মনে হয় আমলাতন্ত্র জটিলতা দায়ী। আমলারা যদি পুঁজিবাজারের প্রতি সদয় না হয় তবে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবেনা।

যেকোনো দেশে যেখানে বার্ষিক উন্নয়নের ৬০-৮০ শতাংশ আসে পুঁজিবাজার থেকে। সেখানে আমাদের দেশে ২ শতাংশও আসে কিনা সন্দেহ রয়েছে। পুঁজিবাজার একটা পরিক্ষামূলক পদ্ধতি। এখান থেকেই অর্থ নিতে হবে এর বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই। ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করতে চাইলে আল্টিমেটলি ব্যাংক এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দুটোই ফেল করবে। পুঁজিবাজার ছাড়া পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা তৈরি হয়নি যার মাধ্যমে দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সচল করা যায়্।

১০-১৫ বছর আগে একজন বিনিয়োগকারী যেকোন পরিমান শেয়ার কিনতে পারতো। কিন্তু সেকেন্ডারি মার্কেটে এখন একটা অথবা যৌথভাবে দুইটি শেয়ার কিনতে পারবে। কাজেই দুইটি শেয়ার কেনার জন্য সেকেন্ডারি মার্কেটে কোন প্রভাব পরেনা। এজন্য প্রতি সপ্তাহে যদি একটি করে আইপিও কেনা থাকে তবে আমার মনে হয়না এটা কোন সমস্যা। বরং দুই তিনটা আইপিও একসাথে থাকা বিনিয়োগকারীদের জন্য সুবিধা। অনেকদিন পর পর আইপিও আসলে অযৌক্তিকভাবে দাম বেড়ে যেতে পারে।

এখানে আইপিও যদি অনেক থাকে তবে বিনিয়োগকারীরা পছন্দমত বেছে নিতে পারে। কাজেই আমার মনে হচ্ছে প্রাইমারি মার্কেটের সাথে সেকেন্ডারি মার্কেটের কোন সরাসরি সম্পর্ক নেই।

আমাদের দেশের কম্পনিগুলো আমেরিকান অথবা সিঙ্গাপুরে স্ট্যান্ডার্ড হবে না। তবে এটা সত্যি যে, একটা কোম্পানি আসার পরে আগের দুই-তিন বছরের যে লভ্যাংশ রেখেছিলো তার পরের বছর যদি তা যুক্তি ছাড়া কমে যায় সেখানে নিশ্চয়ই কোন কারসাজি চক্র থাকে। ভালো আইপিও না আসার অন্যতম কারণ হলো দীর্ঘসূত্রিতা। এজন্য ভালো আইপিও আনতে কীভাবে দীর্ঘসূত্রিতা কমানো যায়, নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর সেটা চেষ্টা করা উচিত।

আমাদের মার্চেন্ট ব্যাংকেরও সেটা ভাবা উচিত। আমরা আসা করছি দ্রুতই আপনারা অনেক ভালো আইপিও বাজারে দেখতে পারবেন। আইপিওতে আসার জন্য যে সংখক আইনকানুনের জটিলতা রয়েছে সেখানে অব্যাহতি দেওয়ার কোন বিধান নেই। আমার মনে হয়, কিছু সেক্টরকে অব্যাহতি দিয়ে আইনে বিধান রাখা উচিত।

এই মুহূর্তে পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে ২০১২ সালে নভেম্বর মাসে প্রকাশিত অর্থমন্ত্রণালয় থেকে একটা সার্কুলেশন অনুযায়ী, পুঁজিবাজার সম্পর্কে যে কোন কিছু করতে হলে অবশ্যই সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে করতে হবে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এনবিআর ও অন্যান্য রেগুলেটর যারা আছেন, তারা যদি সবাই সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পরমর্শে বসে পুঁজিবাজারকে গতিশীল করার চিন্তা করে তবে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে।

মাহবুব এইচ মজুমদার
সিইও
এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেড।

রাসেল/