ভিটামিন বি’ আপনার দেহের জন্য কত জরুরী

বেরিবেরি রোগটার সাথে মোটামুটি কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত। আর ভিটামিন বি এর অভাবে এ রোগটি হয় তাও জানি। তবে ভিটামিন বি এর কয়েকটি রকমভেদ আছে আর সেগুলো ভিন্ন ভিন্নভাবে ভিন্ন রোগের জন্য দায়ী তা কম সংখ্যক লোকই জানি। তেমনি ভিটামিন-বি-১২ এর ঘাটতি দেখা দেওয়ার ব্যাপারটি সম্পর্কে অনেকেই খুব একটা সচেতন নয়। কিন্তু এটা খুবই সাধারণ একটি শারীরিক সমস্যা।

সাধারণত যেকোন বয়সের, যেকোন লিঙ্গের মানুষের মাঝেই ভিটামিন-বি-১২ এর ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তবে ৪০-৬০ বছর বয়সী নারীদের মাঝে এই সমস্যাটি বেশী দেখা দেয়। অনেকক্ষেত্রে নিরামিষাশীদের শরীরেও ভিটামিন-বি-১২ এর ঘাটতি দেখা দিয়ে থাকে। একজন পূর্ণ বয়স্ক লোকের শরীরে প্রতিদিন ২ দশমিক ৪ মাইক্রোগ্রাম পরিমাণ ভিটামিন বি-১২ প্রয়োজন হয়। জেনে নিই ভিটামিন বি’র কিছু কথা-

ভিটামিন বি ১- এর অভাবে বেরিবেরি রোগ হয়। দূর্বলতা, বুক ধড়ফড় করা, হাত পা ব্যাথা করা ইত্যাদি এই ভিটামিন বি ১ এর অভাবে হয়ে থাকে।

ভিটামিন বি ২- ঠোঁট এবং তালু ফাটা, ঠোঁটের কোনায় ঘা, গলা শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি এই ভিটামিন বি ২ এর অভাবে হয়ে থাকে।

ভিটামিন বি ৩ – চুলকানি, ত্বক খসখসে হয়ে যাওয়া, দুর্বলতা এবং ডায়রিয়া বি ৩ এর অভাবে হয়ে থাকে।

ভিটামিন বি ৫- এর অভাবে ত্বকের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

ভিটামিন বি ৬- উচ্চ রক্তচাপ, রক্ত স্বল্পতা,বিষন্নতা এবং ত্বকের সমস্যা ভিটামিন বি ৬ এর অভাবে অভাবে হয়ে থাকে।

ভিটামিন বি ৭- শিশুদের বৃদ্ধি এবং মানসিক বৃদ্ধি ভিটামিন বি ৭ এর অভাবে ব্যাহত হয়।

ভিটামিন বি ৯- অভাবে রক্ত স্বল্পতা হয়। গর্ভবতি মায়েদের ভিটামিন বি ৯ এর অভাবে গর্ভস্থ শিশুর জন্মবিকৃতি ঘটে থাকে।

ভিটামিন বি ১২- এর অভাবে রক্তস্বল্পতা এবং মানসিক সমস্যা দেখা যায়।

এছাড়াও বি- ১২- এর অভাবে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলো হতে পারে।

মাথা হালকা বোধ হওয়া

মাথা হালকা বোধ হওয়ার সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে তবে সেটার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। হুট করে মাথা ঘোরার সমস্যা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। এই ধরনের সমস্যা প্রতিনিয়ত দেখা দিতে থাকলে বুঝতে হবে শরীরে ভিটামিন-বি-১২ এর ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

  

অবশ অনুভূত হওয়া

কোন কারণ ছাড়া সুঁই ফোটানোর মতো অনুভূতি শরীরের কোন অংশে হলে বুঝতে হবে সেটা ভিটামিন-বি-১২ এর ঘাটতির ফলেই দেখা দিচ্ছে।

নিস্প্রাণ ত্বক

ভিটামিন-বি-১২ লোহিত রক্তকণা তৈরি করে থাকে। যে কারণে, শরীরে ভিটামিনে ঘাটতি দেখা দিলে ত্বক নিস্প্রাণ বা বিবর্ণ হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু তামাটে বর্ণের কারোর ত্বকের রং হুট করেই বিবর্ণ হয়ে গেলে বুঝতে হবে শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে।

ভুলোমনা হয়ে যাওয়া

ভুলো মনা ব্যাপার যদি নিয়মিত ঘটতে থাকে তবে সেটার ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। হুট করে কোন কিছু ভুলে যাওয়ার সমস্যাটি ভিটামিন-বি-১২ এর ঘাটতির জন্যে দেখা দেয়।

অনেক বেশী ক্লান্ত বোধ করা

নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানোর পরেও যদি সারাদিন ধরে ক্লান্তিভাব কাজ করে তবে বুঝতে হবে শরীরে কোন একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রামের পরেও ক্লান্তিভাব দূর না হওয়া ভিটামিন-বি-১২ এর ঘাটতি দেখা দেবার লক্ষণ।

দুর্বলবোধ হওয়া

অনেক লম্বা সময় ধরে দুর্বল বোধ হলে বুঝতে হবে শরীরে ভিটামিন-বি১২ এর ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

দৃষ্টিশক্তিতে সমস্যা দেখা দেওয়া

প্রায়শ দৃষ্টিশক্তির বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেওয়ার লক্ষণ হলো শরীরে ভিটামিন-বি-১২ এর অভাব তৈরি হয়েছে। ঘোলা দেখা, চোখের সামনে ঝিরিঝিরি দাগ দেখা, একটি বস্তুকে দুইটি হিসেবে দেখা দেওয়ার মতো সমস্যাগুলো দেখা দেওয়া শুরু করে।

নিচের খাবারগুলো থেকে ভিটামিন বি-১ থেকে ১২ পাওয়া যাবে।

কম চর্বিযুক্ত দই: বিভিন্ন ধরনের দইয়ে ভিটামিন বি-১২-এর মাত্রার তারতম্য দেখা যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দৈনিক চাহিদার অর্ধেক বি-১২ পাওয়া যায় দই থেকে।

কাজু: ভিটামিন বি-তে ভরপুর সবচেয়ে সুস্বাদু খাবারগুলোর মধ্যে একটি কাজু। বিশেষ করে বাটার কাজুর তো তুলনাই চলে না। এতে রয়েছে ভিটামিন বি-১ (থায়ামিন), ভিটামি বি৩ (নিয়াসিন) এবং ভিটামিন বি-৬।

স্পিরুলিনা: গভীর সমুদ্রের শ্যাওলা এটি। এখান থেকে সামুদ্রিক মাছ তাদের পুষ্টি সংগ্রহ করে। স্পিরুলিনায় প্রতিদিনের চাহিদা ১৫০ শতাংশ ভিটামিন বি-১২ থাকে। আর ভিটামিন বি-৬ রয়েছে ৫০ শতাংশ। মাত্র এক টেবিল চামচ স্পিরুলিনায় এগুলো পাওয়া যাবে।

ওট: এতে আছে ভিটামিন বি-১, ভিটামিন বি-২ (রিবোফ্লাবিন) এবং ভিটামিন বি-৬। এ ছাড়া এটি কোলোস্টেরল কমাতেও কাজ করে।

চিয়া সিড: ক্যালিফোর্নিয়া এবং ব্রিটেনে বেশ জনপ্রিয় এটি। ভিটামিন বি-১২ বাদে প্রায় সব রকমের ভিটামিন বি রয়েছে এতে। এ ছাড়া ওমেগা-৩ ফ্যাট এবং আয়রন রয়েছে। প্রতিদিন দুই টেবিল চামচ চিবিয়ে খাওয়াই যথেষ্ট।

কলা: পরিচিত এই ফলে ভিটামিন বি-৫ ও বি-৬ রয়েছে। এ ছাড়া পটাশিয়াম, ফাইবার, ভিটামিন সি এবং পানিও পাওয়া যায়।

স্কোয়াশ: এটি ভিটামিন বি-৬ এ পরিপূর্ণ। পটাশিয়াম, ফাইবার এবং পানিও রয়েছে কলার মতো। মিষ্টি আলু: স্বাদের সঙ্গে ভিটামিন বি-৬ পাবেন এতে। ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, বেটা-ক্যারোটিন এবং ভিটামিন সি তো আছেই।

পালং শাক: আমাদের দেশের শীতের এই শাক ভিটামিন বি-২ এ ভিটামিন বি-৯ (ফোলেট) দেয়। আয়রন ও ভিটামিন সি রয়েছে এতে।

বাদামের মাখন: সব বাদামেই ভিটামিন বি রয়েছে। তবে এর মাখনে সবচেয়ে বেশি। এ থেকে বি-১, বি-২, বি-৫ এবং বি-৯ পাওয়া যায়। এ ছাড়া উদ্ভিজ্জ প্রোটিন এবং হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী উপাদানও রয়েছে এতে।

ছোলা: ভিটামিন বি-১, বি-২, বি-৫, বি-৬ এবং বি-৯ ছাড়াও এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে।

আলমন্ড মিল্ক: এই বাদাম থেকে প্রস্তুতকৃত দুধে ভিটামিন বি-৬ এবং বি-১২ রয়েছে প্রচুর পরিমাণে।

মাছ: মাছে ভিটামিন বি-১২ রয়েছে। মাছের কোষে ভিটামিন সঞ্চিত করতে পারে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে। সারডিন, স্যালমন ও খোলসযুক্ত মাছে বি ভিটামিন পাওয়া যায়।

গরুর কলিজা: বি ভিটামিনের একটি অন্যতম ভালো উৎস হচ্ছে গরুর কলিজা। বি-১, বি-২, বি-৩, বি-৫, বি-৬, বি-৯ ও বি-১২ এ ভরপুর থাকে গরুর কলিজায়। বি-৬, বি-৯ ও বি-১২ এর দৈনিক চাহিদার অর্ধেকের বেশি পূরণ করতে পারে ৬৮ গ্রাম ওজনের গরুর কলিজা। ফোলেট (বি ৯) জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধে সাহায্য করে, ভালো ঘুম ও মেজাজ নিয়ন্ত্রণের হরমোন সেরেটোনিন উৎপাদনে সাহায্য করে বি-৬ এবং লাল রক্ত কণিকার গঠনে সাহায্য করে বি-১২।

মুরগি: সারাবছরই সহজলভ্য বি কমপ্লেক্সের ভালো ও ব্যতিক্রমী উৎস হচ্ছে মুরগির মাংস। এছাড়াও আমিষ ও খনিজেও পরিপূর্ন থাকে। রান্না করা মুরগির বুকের মাংসে নায়াসিন (বি-৩), পেন্টোথেনিক এসিড(বি-৫), পাইরিডক্সিন(বি ৬) এ প্রচুর পরিমাণে থাকে যা বিপাকের জন্য প্রয়োজনীয়। মুরগির বুকের মাংসের ৪ আউন্স ৭২ শতাংশ নায়াসিন, ১০ দশমিক ৬ শতাংশ পেন্টোথেনিক এসিড এবং ৩২ শতাংশ পাইরিডক্সিন সরবরাহ করে।

ডিম: সিদ্ধ, পোচ বা ভাজা যেভাবেই খাওয়া হোকনা কেন বি ভিটামিনের চমৎকার উৎস ডিম। ডিমে প্রায় প্রতিটা বি ভিটামিনই পাওয়া যায়। ভিটামিন বি-১২ এর সবচেয়ে ভালো উৎস হচ্ছে ডিমের কুসুম, যা লাল রক্ত কণিকার উৎপাদনে সাহায্য করে। এছাড়াও ডিমে নায়াসিন, ভিটামিন বি-৬ ও বায়োটিন থাকে যা বিপাকের নিয়ন্ত্রণে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এবং কোষের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

দুধ: দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারে থায়ামিন, রিবোফ্লাবিন ও বি ১২ থাকে। এছাড়াও সামান্য পরিমাণে বি-৩, বি-৫, বি-৯ এবং বি-৬ ও থাকে। ১ গ্লাস দুধে ভিটামিন বি ১২ থাকে শতভাগ, থায়ামিন থাকে ১৫ শতাংশ, রিবোফ্লাবিন থাকে ৪৫ শতাংশ, নায়াসিন থাকে ৩ শতাংশ, ফোলেট থালে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সামান্য পরিমাণে পাইরিডক্সিন থাকে।

মটরশুঁটি: বি কমপ্লেক্স ভিটামিনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস মটরশুঁটি। বিভিন্ন ধরণের মটরশুঁটি, শিমের বীচি ও ছোলাতে থায়ামিন, নায়াসিন, ফোলেট এবং রিবোফ্লাভিন এ সমৃদ্ধ থাকে। ভালো কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতে , প্রদাহ কমাতে এবং খাদ্যকে এনার্জিতে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করে এই ভিটামিনগুলো। মটরশুঁটির ফোলেট ও ভিটামিন বি-৬ কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

আজকের বাজার: এলকে/ ১ জানুয়ারি ২০১৮