ভিশনারি উদ্যোক্তাদের কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হবে

মালিকানার দিক থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এখন একটি মাল্টিন্যাশন্যাল স্টক এক্সচেঞ্জ। এখানে আমাদের যেমন মালিকানা আছে, তেমনি ২৫ শতাংশ মালিকানায় রয়েছে চায়নার দুটি স্টক এক্সচেঞ্জ। সেই হিসেবে এটি একটি মাল্টিন্যাশন্যাল স্টক এক্সচেঞ্জ। কিন্তু একটি মাল্টিন্যাশন্যাল স্টক এক্সচেঞ্জই বড় কথা না। একটি মাল্টিন্যাশন্যাল স্টক এক্সচেঞ্জ হলেই যে আমাদের বাজারের গুনগত মান পরিবর্তন হবে, এমন কোন কথা নাই। কিন্তু আমরা তেমনটা প্রত্যাশা করছি।

আমাদের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের জন্ম ১৯৫৪ সালে। বিগত এতগুলো বছর হয়ে গেলও আমরা সত্যিকার অর্থেই এই বাজারকে খুব বড় কোন জায়গায় নিতে পারিনি। তারপরও তিলে তিলে আজকে আমাদের বাজারটা যে জায়গায় এসে দাড়িয়েছে, এখান থেকে কিন্তু বড় হওয়ার মত অনেক জায়গা আছে। আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যার্থতা হল, বিগত পয়ষট্টি বছরে আমরা ইকুইটির বাহিরে কোন প্রোডাক্ট এখানে যোগ করতে পারিনি। যে কারণে মাল্টিন্যাশন্যাল স্টক এক্সচেঞ্জ বলুন বা চাইনিজ বিনিয়োগকারী বলুন যারা এসেছে তাদের একটা ভিশন হলো, এখানে নতুন নতুন প্রোডাক্ট যোগ করা। যেসব প্রেডাক্টের মাধ্যমে আমরা একটা সাসটেইনেবল ইকুইটি মার্কেটতো চাই, সেই সাথে একটা বন্ড মার্কেট যেন তৈরি হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। তারপর আমাদের এখানে মিউচুয়্যাল ফান্ডের একটা ভাল অবস্থান তৈরি করা দরকার। ডেরিভেটিভস প্রোডাক্ট যাতে চালু হয়, এরকম অনেকগুলো কাজ তারা করবে, আমরা একসাথে করব। এরকম একটি প্রস্তাবনা ও ইচ্ছা এবং সেইসাথে আমরা কাজও করছি।

সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি: সত্যিকারের ভালো বাজার তৈরির জন্য যাকিছু করা দরকার তা সবই আমরা করতে চাই। ইতিমধ্যে কিছু কিছু উদ্যোগ শুরু হয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি হল সিসিপি, আমাদের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইতিমধ্যে সিসিপি’র (সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি) অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে। এটি হলে আমাদের নিজস্ব যে সেটেলমেন্ট ব্যাবস্থাপনা, সেটি অনেক উন্নত হবে। যদিও আমাদের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সেটেলমেন্টে কোন ফেইলুর নেই, তারপরও আমরা স্বয়ংক্রিয় একটি সেটেলমেন্ট কোম্পানি করছি এবং এটি হয়েছে।

স্মল ক্যাপ মার্কেট: খুব শিঘ্রই আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা স্মল ক্যাপ মার্কেট চালু করতে যাচ্ছে। এই ধরণের প্রোডাক্টগুলো যখন আসবে, আমরা মাল্টিন্যাশন্যাল হওয়ার জন্য যা কিছু দরকার সেদিকেই কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি। সত্যিকার অর্থে ভালো এবং সুন্দর বাজার হওয়ার জন্যে যা যা করার দরকার সেসব আমরা করছি।

রিস্ক বেইজড ক্যাপিটাল এডুকেসি: আমাদের ব্রোকার বা ডিলার যারা আছেন, তাদের ক্যাপাসিটি এবং ক্যাপাবিলিটি আরও উন্নত করার জন্য রিস্ক বেইজড ক্যাপিটাল এডুকেসি চালু হচ্ছে খুব অল্প সময়ের মধ্যে। তো এই ধরণের বেশ কিছু কর্মসূচি চালু হতে যাচ্ছে।

বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম: আমাদের নিয়ন্ত্রণ সংস্থার উদ্যোগে সারাদেশে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করানো এবং তাদেরকে বিনিয়োগ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য লিটারেসি প্রোগ্রামসহ নানা ধরণের কার্যক্রম চালু হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, বিএসইসিসহ সরকারের সহায়তায় আমরা কিন্তু এসব করছি। এগুলো আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু প্রয়াস যাতে আমাদের বাজারটা বড় হয়, ভালো হয়।
আমাদের বিএসইসি’র ক্ষমতায়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় ব্যাপার। বিএসইসি আরও এম্পাওয়ার্ড হওয়া দরকার। আমাদের স্টক-এক্সচেঞ্জেরও আরও ক্ষমতায়ন দরকার।

ভালো উদ্যোক্তা: ভালো ভালো নতুন প্রোডাক্ট আসার সাথে আমাদের মার্কেটে কিন্তু ভালো উদ্যোক্তাদের শেয়ার আসতে হবে। ভালো উদ্যোক্তা বলতে আমি যেটা বলতে চাই, দেখুন, বিশ্ববাজারে মাইক্রোসফ্ট যখন তালিকাভুক্ত হলো, তখন কিন্তু আজকের এই মাইক্রোসফ্ট ছিল না। ট্রিলিয়ন ডলার, বিলিয়ন ডলার শেয়ারের কোম্পানি ছিল না, ছিল একটি গ্যারেজ কোম্পানি। আপনি অ্যাপল’র কথা চিন্তা করে দেখেন, তারা যখন বিশ্ববাজারে এসেছে আজকের এত বড় কোম্পানি অ্যাপল কিন্তু বাজারে ঢুকেনি। তখন ছোট ছিল, কিন্তু উদ্যোক্তা ছিল ভালো। মাইক্রোসফ্ট’র উদ্যোক্তা বলেন আর অ্যাপল’র উদ্যোক্তা বলেন, তারা কিন্তু সত্যিকার অর্থেই ভিশন নিয়ে মার্কেটে এসেছিল যে, তারা একদিন বড় হবেই। তাদের পুঁজি দরকার, তাই তারা বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এধরণের উদ্যোক্তা আমাদের বাজারে আসা দরকার। আমি ভালো উদ্যোক্তা বলতে এই ধরণের উদ্যোক্তাদের বোঝাতে চেয়েছি।

লুটপাটের কোম্পানি চাই না: আমাদের এখানে কী হচ্ছে? আপনি বিগত কিছুদিন খেয়াল করে দেখেন, যে সব উদ্যোক্তা তাদের কোম্পানি শেয়ারবাজারে লিস্টেড করেছে, তারা অনেকটাই কিন্তু লুটপাট করার উদ্দেশ্যে করেছে। তাদের ভিশনটাই ছিল লুটপাটের উদ্দেশ্য, বাজার বান্ধব না। আমরা এই ধরণের উদ্যোক্তা চাই না। আমরা চাই, এমন উদ্যোক্তার শেয়ার আমি কিনব, আমার কাছে পুঁজি আছে, তার কাছে আছে বুদ্ধি বা মেধা এবং তার কাছে আরও আছে ভিশন। আমাদের দু জনের সমন্বয়ে আমদের অনেক গ্রোথ হবে। আমিও বড় হব, সেও বড় হবে। এই ধরণের উদ্যোক্তা আমরা চাই।
আমি একটা খারাপ উদাহরণ দিচ্ছি। আপনাদের মনে আছে হয়তো, ‘রাস্পিট’ নামে একটি গ্রুপ ছিল। দেখেন এই উদ্যোক্তারা যখন এসেছিল, তারা বাজারে দুই তিনটি কোম্পানি লিস্টেড করেছিল। টাকা পয়সা নিয়ে ভেগে গেলো, তাদের কোন কার্যক্রমতো নেই, আজ সেসব কোম্পানির কোনো অস্তিত্বও নেই।

আবার একই সমসাময়িক বাংলদেশি উদ্যোক্তা ‘স্কয়ার গ্রুপ’। স্কয়ার গ্রুপের কথা আপনি যদি চিন্তা করেন, খুব ছোট একটা কোম্পানি হিসেবে মার্কেটে এসেছিল স্কয়ার গ্রুপ। এখন তাদের যারা কম্পিটিটিটর, তাদের চাইতেও অনেক ছোট ছিল। আজ শুধু মাত্র ভালো উদ্যোক্তা হওয়ার কারণে, মানুষের বিশ্বাস-আস্থা অর্জন করার কারণে, যারা একসময় জায়ান্ট ছিল, সেসব জায়ান্টদেরকে ছাপিয়ে আজকে তারা অনেক উপরে চলে এসেছে। স্কয়ার ফার্মা এখন শুধু বাংলাদেশি কোম্পানি না, এটি মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানি। স্কয়ার ফার্মাকে আমি যদি বলি, এটি শুধু একটি কোম্পানিই না, এটি একটি হোল্ডিং কোম্পানি। কেননা স্কয়ার ফার্মার যেসব জায়গায় বিনিয়োগ আছে, সেসব বিনিয়োগের সুফল যখন আসবে, তখন এটি আরও অনেক অনেক বড় হবে। এটিই কিন্তু উদ্যোক্তার ভিশন।

আইপিওতে দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে হবে: তাই আমি সবসময় বলতে চাই আমাদের বাজারে সু-উদ্দোক্তাদের শেয়ার আসতে হবে। আমাদের বাজারে ভালো কোম্পানি লিস্টেড হবে না। ভালো কোম্পানি কেন লিস্টেড হবে? কারণ তারতো লিস্টেড হওয়ার প্রয়োজন নেই, পুঁজির দরকার নেই। ব্যাংক লাইন ধরে থাকে তাকে পুঁজি দেওয়ার জন্য, তাই সে পুঁজি উত্তোলনের জন্য বাজারে আসবে না। আমাদের বাজারে আরেকটি বড় সমস্যা হলো দীর্ঘসূত্রিতা। আইপিওতে আসতে হলে কোনো কোম্পানিকে যে পরিশ্রম করতে হয়, যে সময় ক্ষেপণ করতে হয়, এটাকে যদি আমরা কমিয়ে না আনতে পারি তাহলে ভালো উদ্যোক্তা আসবে না।

প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের আনতে হবে: ভালো উদ্যোক্তা আনার পাশাপাশি আরো কিছু বিনিয়োগকারীদেরকেও বাজারে আনতে হবে। আমাদের যারা মিডল-ক্লাস ইনকাম পিপল, উনাদেরকে বাজারে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশের বিশাল একটি অংশ বিদেশে থাকে। আমরা সবসময় চাই যে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আমাদের এখানে বিনিয়োগ করবে। কিন্তু আমাদের যেসব ভাই বোন প্রবাসে থাকে, অর্থাৎ এনআরবি তাদের একটি বড় অংশকে যে আমরা বিনিয়োগে আনতে পারি, সে চিন্তা আমরা কিন্তু করছি না। আমার কাছে একজন প্রবাসী বিনিয়োগকারি সরাসরি এসে বিনিয়োগের আগ্রহের কথা বললেন। উনি বললেন, আমি আপনাকে ডলার দিব আপনি আমাকে কিভাবে দিবেন ? তখন আমি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলেছি, ভাই আমি আপনার বিনিয়োগটা নিতে পারছি না। কারণ আপনি আমাকে ডলার দিলে আমি সেটা দিয়ে শেয়ার কিনতে পারব না। আমাকে দিতে হবে টাকা। একইভাবে আপনি যখন বিক্রি করবেন, আমি আপনাকে ডলারে ফেরত দিতে পারব না। আমি আপনাকে টাকায় ফেরত দিব। সেজন্য আপনাকে এখানে একটা লোকাল একাউন্ট খুলতে হবে। তখন উনি আমাকে বললেন, উনি এখানে কোনো আত্মীয় স্বজনের উপর নির্ভরশীল হতে চান না। উনি চান, বিদেশ থেকে উনি এখানে বাই অর্ডার পাঠাবেন, সেল অর্ডার পাঠাবেন এবং উনি ওখান থেকে আমাকে ডলারে বা ফরেন কারেন্সিতে পেমেন্ট করবেন। একইভাবে, আমিও যখন উনাকে পেমেন্ট দিব, তখন ফরেন কারেন্সিতে পেমেন্ট দিতে হবে। এই জিনিসটা আমরা আমাদের প্রবাসী ভাইদের জন্য করতে পারি নাই। এটা যদি আমরা করতে পারি, তাহলে আমাদের কেবল বিদেশী বিনিয়োগকারীদের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে না। বড় একটি বিনিয়োগ আমরা পাব আমাদের প্রবাসীদের কাছ থেকে।

এই ধরণের আরও অনেক উদ্যোগ আমাদের নেয়া উচিত। এগুলো হয়তো আস্তে ধীরে হবে। হলে পরে আমাদের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানি বা মাল্টিন্যাশন্যাল স্টক এক্সচেঞ্জের গুনগত মানের দিকে আস্তে আস্তে যেতে পারবে। আমি আশা করি, সেজায়গায় পৌঁছুতে খুব বেশি কস্টকর হবে না। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়। সরকার যদি আমাদের সহায়তা করে বা সরকারের সহযোগিতা পেলে অবশ্যই এই অর্জনটা আরও তাড়াতাড়ি সম্ভব।

মো. সাজেদুল ইসলাম
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শ্যামল ইকুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড
পরিচালক, ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন