ভ্যাট-ট্যাক্স নিয়ে চোর-পুলিশ খেলা বন্ধ করতে হবে

নিজাম উদ্দীন চৌধুরী বাপ্পী। প্লাটিনাম গ্রুপের চেয়ারম্যান এই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবার এফবিসিসিআই নির্বাচনে পরিচালক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি, এফবিসিসিআই নির্বাচন ও ভ্যাট-ট্যাক্স নিয়ে ব্যবসায়ীদের ভাবনাসহ নানা বিষয়ে আজকের বাজারের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। বক্তব্যের অনুলিখন তারই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি
ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি সার্বিকভাবে ভালো। শুধুমাত্র গ্যাস সমস্যাটা রয়ে গেছে। গ্যাসের জন্য কিছু অসম প্রতিযোগিতা চলছে। যাদের গ্যাস মজুদ রয়েছে তাদের কস্ট পড়ছে এক রকম। আবার যারা অল্টারনেটিভ পাওয়ার ব্যবহার করছে তাদের কস্ট পড়ছে আরেক রকম। এর বাইরে বলতে গেলে পুরো বিশ্ব এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে।  উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছি আমরা। এ দেশে এখন বিদেশিরা অল্প সংখ্যক কাজ করতে আসছে। আশা করি সামনে আরো অনেক বিদেশি আসবে। এ দেশ থেকে আর কেউ সহজে বিদেশে যাবে না। এটি সুস্পষ্ট এবং দৃশ্যমান।

ব্যবসায়ীদের সমস্যা
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা  তো থাকবেই। তবে বিক্রি যদি ঠিক থাকে তাহলে বাকি সমস্যা এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে। অলরেডি আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছেন। যখন ব্যবসায়ীদের ইন্টারেস্ট আসছে তখনই তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন।

এক সময় আশুলিয়ায় শুধু শ্রমিকদের গুরুত্ব দেয়া হতো। বিগত সময়ে দেখা গেছে, টেক্সটাইলকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে যারা অবৈধ কার্যকলাপ করছে বা অসম আন্দোলন করছে তাদের ঠেকিয়ে ব্যবসায়ীদের সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। কারণ ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠান গড়েন। শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠান চালায় এটা ঠিক আছে। তবে আগে তো প্রতিষ্ঠান হতে হবে। সেই আস্থা আসতে হবে। মোটামুটিভাবে এভাবে সমস্যাগুলো সমাধান করা যাচ্ছে।

তবে আরো সচেতন হতে হবে। যেমন- পোর্ট সার্ভিসগুলো আরও বেশি স্মুথ হতে হবে। আমরা ভ্যাট-ট্যাক্স সবই দিতে চাই। তবে তা সহনশীল লেভেলের হতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের ভ্যাট দ্বিগুণ। অথচ ভ্যাটের পরিমাণ এর অর্ধেক হলে মিনিমাম প্রফিট ম্যাক্সিমাম সেলসের মতো ভ্যাটের আওতা বেড়ে যেত। ট্যাক্সের রেশিওটা কমিয়ে আনা উচিত। কমিয়ে আনলে এদেশের সাধারণ ব্যবসায়ীরাও ট্যাক্স দিতে উদ্বুদ্ধ হবেন। ভ্যাট-ট্যাক্সের ক্ষেত্রে চোর-পুলিশ খেলা বন্ধ করে এটাকে একটা কমফোর্টেবল জায়গায় আনতে হবে। ভ্যাট ট্যাক্সের ক্ষেত্রে আমাদের মাঝে এখনো আতঙ্ক রয়েছে। এই আতঙ্ক কাটানোর দায়িত্ব সরকারের, এনবিআরের এবং অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের।

চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয়
শিল্প মন্ত্রণালয় বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যে সেক্টরভিত্তিক ব্যবসায়ী প্রতিনিধি রয়েছেন তা বর্তমানে রাজনৈতিক লোক দিয়ে চালানো হচ্ছে। আমার মনে হয়, এখানে ৫০-৫০ সমন্বয় সেল গঠন করা যেতে পারে।  প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ে ইনডিভিজ্যুয়েলি একটা করে কমিটি থাকতে হবে। এই কমিটি মন্ত্রণালয়ধীন  ব্যবসায়ীদের একত্র করে প্রস্তাবগুলো আনবে। সেই প্রস্তাবগুলো রুটলেভেল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত ব্যবসার সম্ভাবনা, সমস্যা ও করণীয় চিহ্নিত করবে। এজন্য প্রতিটি জেলা থেকে একজন করে এবং জাতীয় পর্যায়ে ৫ জন প্রতিনিধিকে ওই কমিটিতে ইনক্লুড করতে হবে। এদের নিয়ে বছরে ন্যূনতম একবার একটা প্রোগ্রাম করতে হবে। এই জায়গাগুলোতে সরকারের চেষ্টা আছে কিন্তু আরো উদ্যোগী হতে হবে। আরো বেশি  ক্লোজ মনিটরিং করতে হবে। আরো বেশি প্রকৃত ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

আমাদের দেশে দেখা যায়, মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছেন যিনি তিনি ব্যবসার সঙ্গে কম সম্পৃক্ত রয়েছেন। কিন্তু  একজন ব্যবসায়ীর প্রকৃত সমস্যা বুঝতে হলে তো ব্যবসার সঙ্গে পুরোপুরি জড়িত হতে হবে। না হলে সে কীভাবে সমস্যার সমাধান করবে? আর ব্যবসায়ীদের তিনটি স্তরে ভাগ করতে হবে। ১. বৃহৎ আকারের ব্যবসায়ী, ২. মাঝারি আকারের ব্যবসায়ী ও ৩. নারী এবং যুব উদ্যোক্তা। যেটাকে বলা হয়, ইয়ুথ মেন অ্যান্ড ওমেন। এই তিন স্তরে প্রমোট করতে হবে। আর তখনই প্রকৃত শিল্পের বিকাশ হবে। এতে নতুন নতুন ব্যবসায়ী তৈরি হবে। যরা পুরাতন ব্যবসায়ী; বাবা দাদার আমল থেকে ব্যবসা করে আসছেন তাকে দিয়ে শিল্পের বিকাশ হবে না। সেটা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় থেমে যাবে। আর শিল্প বিকাশের সব থেকে বড় বাধা হচ্ছে  নতুন এবং তরুণ উদ্যোক্তা বিকাশে সরকারের তেমন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া।

আমলারা মনে করেন, তারা সব বোঝেন ব্যবসায়ীরা কিছুই বোঝেন না। অথচ আমাদের ভ্যাট ট্যাক্সেই তাদের বেতন হয়। সহায়ক ভূমিকা পালন করছি আমরা। আমাদের সমস্যা ওনারাও বোঝেন; তবে রিটায়ারে যাওয়ার পরে। যখন নিজেও ব্যবসায়ী হন। এটা যদি ক্ষমতা থাকতে বুঝতেন তাহলে সমন্বয়টা আরো ভালো হতো। এ দেশ আরো এগিয়ে যেত এবং শিল্পের বিকাশ আরো বহু আগেই হতো। এখনো সহ অবস্থানটা সুন্দর হচ্ছে না। তারা ব্যবসায়ীদেরকে শিল্প বিকাশ, শিল্পের উন্নয়ন বা শিল্পের গবেষণার জন্য কাজে লাগিয়ে ভালো কিছু করতে পারতেন। ব্যবসায়ীদেরও কিছু সমস্যা রয়েছে। ভালো মন্দ মিলিয়েই তো চলতে হয়।

এফবিসিসিআইয়ের ভূমিকা
ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে এফবিসিসিআই ইচ্ছে করলে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। তবে প্রতিবছর যেটা হয় ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের মতো নির্দিষ্টসংখ্যক কিছু সিনিয়র নেতারা বসে প্যানেল ঠিক করে দেন। এরপর দেখা যায়,ওহি নাজিল হবার মতো হঠাৎ এসেই প্রেসিডেন্ট হয়ে যান। এখন সাধারণ ভোটের মাধ্যমে যদি নির্বাচিত না হন তাহলে সাধারণ ব্যবসায়ীদের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে না। ঢাকা চেম্বার হলো একটা নির্দিষ্ট কমিউনিটির চেম্বার আর এফবিসিসিআই হলো বাংলাদেশের সকল চেম্বারের চেম্বার, সকল অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাসোসিয়েশন এবং ফরেন চেম্বারগুলোর অ্যাসোসিয়েশন। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম পর্যায়ের একটা ইনস্টিটিউট এটা হবার কথা। এখান থেকে সকল প্রপোজাল রিকোর্মেন্টগুলো যাবে। মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে উপযোগীতা অনুযায়ী সেখান থেকে সাজেশন দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এখানে যদি হঠাৎ আসা কোনো ব্যাক্তি দায়িত্ব পান। যার অ্যাসোসিয়েশনের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। রুট লেভেল থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসেননি। তাহলে তো তিনি সমস্যাগুলো বুঝবেন না। প্রকৃতপক্ষে তিনি ব্যবসায়ীদের পারপাস সার্ভ করতে পারবে না। তবে এখন আমাদের দেশের ট্রেড অর্গানাইজেশনগুলো অ্যাকটিভ হচ্ছে। সচেতনতা বাড়ছে বরং শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়নগুলো ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। সন্ত্রাস নৈরাজ্য ও ফ্যাক্টরি ভাঙচুরের মাধ্যমে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে তারা। কিন্তু ট্রেড অর্গানাইজেশনগুলো কিছুটা হলেও ব্যবসার প্রতিনিধিত্ব করছে।  অর্গানাইজেশনগুলোর মাধ্যমে ব্যবসায়ী-আমলার মধ্যেও কিছুটা সমন্বয় হচ্ছে। এফবিসিসিআইয়ের মাধ্যমে হচ্ছে। ইনডিভিজ্যুয়ালি সকল অর্গানাইজেশনের মাধ্যমেই হচ্ছে। এখন এটাকে আরো বেশি কার্যকর করতে হবে এবং একে সবধরনের রাজনীতির উর্ধ্বে রাখতে হবে।

আমাদের দেশের সরকার গণতান্ত্রিক সরকার। এফবিসিসিআইয়েও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হবে। মহিউদ্দিন সাহেব নিউট্রাল অবস্থানে আছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকবেন। তবে ভালো হতো যদি তিনি স্বতন্ত্র থেকে দুই পাশে দুইটা ডিরেক্টর প্যানেল ঠিক করে দিতেন। এমনিতেই কোনো নির্বাচন হয় না। শুধু সুযোগ আছে ডিরেক্টরদের নির্বাচন করার। তাহলে দুই প্যানেল থেকেই নির্বাচিত হয়ে আসতেন। সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছেও জবাবদিহিতা থাকতো। সেই সুযোগটা নষ্ট করে কিছু ব্যবসায়ী সরকারকে বুঝিয়ে সরকারি ভাবধারার একটা প্যানেল দাঁড় করিয়েছে।

ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরাম সম্পর্কে যে কথাটি শোনা যাচ্ছে যে সরকার সমর্থিত প্যানেলে স্থান না পেয়ে এই প্যানেল গঠন করা হয়েছে; এটাও ঠিক নয়। গণতন্ত্রের স্বার্থে এরা ১০-১২ জন আগে থেকেই ফোরাম গঠন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ওখান থেকে ছিটকে পড়েও কিছু সংখ্যক এসেছেন। এতে বরং ভালো হয়েছে।  এফবিসিসিআইয়ে গণতন্ত্র নিশ্চিত হয়েছে। যারাই কমিটিতে আসুক নির্বাচিত হয়ে আসবেন। এতে সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছে তাদের জবাবদিহিতাও থাকবে। আর জবাবদিহিতা ছাড়া কোনো সংগঠনই দাঁড়াতে পারে না। এজন্য বিশেষভাবে ইসহাকুল হোসেন সুইট ভাইকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনৈতিক মানুষ। প্রতিবাদী মানুষ। তার কারণেই দ্বিতীয় প্যানেলটি গঠিত হয়েছে। পরে অবশ্য সরকার সমর্থিত প্যানেল থেকে বাদ পড়ে অনেকে এসেছেন। অপর প্যানেলটিকেও নেগেটিভলি দেখছি না। তবে আশা করি মহিউদ্দিন সাহেব দুই প্যানেলের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

এফবিসিসিআইয়ের কমিটি নির্বাচনের পর দেখা যায় অনেকেই বোর্ড মিটিংয়ে  অনুপস্থিত থাকেন। তারা তখন সিএফসি কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে নানা সুযোগ সুবিধা নেন। আমি বলব সেই দিন এখন আর নেই। মানুষ এখন অনেক সচেতন। বর্তমান সরকারের মন্ত্রীরা যেমন দেশের যে কোনো সমস্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সমাধান করেন। তেমনি আমি মনে করি, প্রেসিডেন্ট ছাড়া কমিটির সবাই মন্ত্রীদের মতো। তারাও ব্যবসায়ীদের সকল সমস্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সমস্যার সমাধান করবেন। প্রতি ৩ মাসে একটি কো-অর্ডিনেশন মিটিং হতে পারে। প্রতি বছর সাকসেস কি আসলো এটি এজিএম-এর মাধ্যমে সাধারণ ভোটারদের জানানো। এরকম কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এফবিসিসিআইকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে প্রত্যাশা রাখি। আর সাধারণ ভোটারদের কাছে প্রত্যাশা, ভোটের সময় নিজের বিবেকবোধটাকে জাগ্রত রেখে যোগ্য ব্যাক্তিকে ভোট দিবেন।

নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে বলতে গেলে প্রথমে পরামর্শ থাকবে- সে যে ব্যবসা করতে চায় সে সেক্টর সম্পর্কে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। আর অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করতে ওই সেক্টরের যে কোনো প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন চাকরি করবে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ট্রেনিং নিতে পারে। এরপর এসএমই লেভেলে শুরু করবে। পরে ধীরে ধীরে বড় আকারে যাবে। কোনোভাবেই শুরুতেই মেগা আকারে যাওয়া যাবে না। তাহলেই প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হবার সম্ভাবনা থাকবে না। একজন উদ্যোক্তার স্বপ্ন নষ্ট হবে  না। দেশ নতুন উদ্যোগে নতুন উদ্যমে স্বপ্নের জায়গায় পৌঁছবে। সোনার বাংলা নিশ্চিত হবে।

আজকের বাজার: আরআর/ ০৬ মে ২০১৭