যে কারণে নাম রাখা হয় ‘ইবলিশ চত্বর’

চৈত্রের ভরদুপুর। প্রায় জন শূন্য একটি পায়ে হাঁটার পাকা রাস্তা। রাস্তার দুইপাশে নির্দিষ্ট দূরন্ত পরপর সারিবদ্ধ মেহগনি গাছ। গাছগুলো সবুজ কচি পাতায় ছেঁয়ে গেছে। কচি পাতার ফাঁক থেকে লাজুক কোকিলের মন ভুলানো কুহু কুহু ডাক আর ঘুঘু পাখির কুরু কুরু শব্দে রঙিন হয়ে ওঠেছে স্বপ্ন হাওয়া। একটু দূর থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। এক চিলতে বসন্তের রোদ পড়ে গাছের কচিপাতা চিকচিক করছে। বলছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়নাভিরাম ইবলিশ চত্বরের কথা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে সোজা উত্তরে ছোট একটি আমের বাগান। তার ওপাশে বিশাল মাঠ। আর এ মাঠকেই বলা হয় ইবলিশ মাঠ বা ইবলিশ চত্বর। মাঠটির দক্ষিণে রয়েছে আমবাগান আর একটি বিশাল শানবাঁধানো পুকুর। পশ্চিমে আমগাছের সারির ওপাশে শিক্ষকদের আবাসিক ভবন। উত্তরে মেহগনি গাছের সারির পাশেই ছাত্রীদের সবচেয়ে পুরোনো মুন্নজান হল এবং তার পাশেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর পূর্ব দিকে রয়েছে ড. মমতাজউদ্দীন আহমেদ অ্যাকাডেমিক ভবন।

কয়েকদিন আগেও ইবলিশ চত্বরের প্রকৃতিতে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ছিলো দুষ্কর। সেখানেই ফাগুনের শেষভাগে এসে প্রকৃতি যেনো একেবারে নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বসন্তের বিদায় লগ্নে ভরে ওঠেছে পত্রপল্লবে। পাখির কলতান, প্রজাপতি আর মৌ-মাছিদের আপন গতিতে ছুটে চলা। ব্যাকরণের কোনো উপমা দিয়ে এখানকার সৌন্দর্য হয়তো লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।

সকাল থেকে আড্ডা জমে ইবলিশ চত্বরে। বিকেলে তার পূর্ণতা পায় শিক্ষার্থীদের কোলাহলে। নানান সাজে এখানে আসেন তরুণ-তরুণীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আড্ডাপ্রিয় শিক্ষার্থীদের অন্যতম জায়গা এই ইবলিশ চত্বর। শুধুমাত্র যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এখানে আড্ডা জমায় তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাশাপাশি বহিরাগত ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে আড্ডা জমায় নিয়মিত। এছাড়া এখানে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ছাড়াও মাঠে চলে সকাল-বিকাল ব্যাট-বলের লড়াই। ক্লাস শেষে ক্লান্ত দুপুরে বিশাল আকৃতির আম গাছের নিচে প্রশান্তি খুঁজে শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও পুকুরের চারপাশে বসার জন্য বানানো হয়েছে ছোট ছোট বেঞ্চ। সন্ধ্যা হওয়ার পর এখাকার ল্যাম্প পোস্টে জ্বলে ওঠে সবুজ, হলুদ, লাল, নীল রঙের বাতি।

কাগজে কলমে জায়গাটির নাম পুরাতন ফোকলোর চত্বর। কিন্তু জায়গাটি ইবলিশ চত্বর নামেই সুপরিচিত। এই নামকরণের পেছনে রয়েছে ভিন্ন মত। কেউ কেউ বলেন, প্রেমিক-যুগল এবং কপোত কপোতিদের দ্বারা ওই এলাকা সবসময় পরিপূর্ণ থাকতো। তাই দেখে নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এ চত্বরের নাম দেন ইবলিশ চত্বর। আরো জানান যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই চত্বরে ‘ইবলিশ’ নামে একটি নাটকের প্রদর্শনী করে অনুশীলন নাট্যদল। আর সেখান থেকেও এর নামকরণ হতে পারে ইবলিশ চত্বর।

১৯৯৮ সালে ফোকলোর বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীর উদ্যোগে কৃষ্ণচূড়া এবং রাধাচূড়াগাছের চারা রোপণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এ চত্বরের নাম রাখা হয় ফোকলোর চত্বর। মূলত ইবলিশ নামটিকে বিলুপ্ত করার জন্য একই চত্বরে ফোকলোর আড্ডা কমিটি এ কাজটি করে। পরে ২০০৩ সালে ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থীরা এর সাইনবোর্ডও টাঙিয়ে দেয়। কিন্তু খাতা-কলমে ফোকলোর চত্বর হলেও সবাই ইবলিশ চত্বর হিসেবেই চেনে।

সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর বলেন, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ইবলিশ চত্বরে আড্ডার তুলনা হয় না। এইখানে বসে বিকালের সূর্য ডোবা দেখা আর সিগ্ধ বাতাসে পরশ বুলিয়ে দেয়। বন্ধুদের সঙ্গে গোল হয়ে বসে আড্ডা কিংবা গ্রুপ স্টাডিতে রয়েছে আলাদা অনুভূতি। খবর-ডেইলি বাংলাদেশ

আজকের বাজার/আখনূর রহমান