যে কারণে হয় শ্বেতী রোগ, প্রতিকার কী?

শ্বেতী রোগ, যেটা আমাদের দেশে একটি ত্বকের সমস্যা। এ রোগে আমাদের শরীরের ন্যাচারাল কালারটা চলে যায়। আক্রান্ত স্থানটা সাদা হয়ে যায়। অজ্ঞতার কারণে শ্বেতী আক্রান্ত রোগীকে দেখলে আঁতকে ওঠেন অনেকে। এই রোগ নিয়ে সাধারণের মনে অনেক কুসংস্কার আর ভ্রান্তি আছে।

শ্বেতী বা ধবল রোগ কী

শ্বেতী ত্বকের একটি রোগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যার নাম লিউকোডারমা বা ভিটিলিগো। আমাদের ত্বকের মধ্যে মেলানোসাইট কোষে থাকে মেলানিন, যা ত্বকের স্বাভাবিক রঙের ভারসাম্য রক্ষা করে। মেলানিনের ক্রিয়াকলাপে বাধা সৃষ্টি হলে বা ভারসাম্য নষ্ট হলে দেখা দেয় শ্বেতী। শ্বেতী বা ধবল বংশগত কারণে হতে পারে।

প্রতি ১০০ জন শ্বেতী রোগীর মধ্যে ৩০ জনের ক্ষেত্রেই শ্বেতী হয় বংশগত ধারায়, মাতৃ বা পিতৃকুলের কারো না কারো থেকে জিনের প্রভাবে। বাকি ৭০ শতাংশের ক্ষেত্রে শ্বেতী সাদা দাগ ছড়াতে থাকে নিজস্ব কারণে, যার মূলে রয়েছে মেলানিনের কারসাজি!

বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ১০ কোটি মানুষ শ্বেতীতে আক্রান্ত। প্রয়াত শিল্পী মাইকেল জ্যাকসনও এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাই প্রতিবছর ২৬ জুন তার প্রয়াণ দিবসে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘ওয়ার্ল্ড ভিটিলিগো ডে’ বা বিশ্ব শ্বেতী দিবস হিসেবে।

সাধারণত মুখমণ্ডল, কনুই, বুকের ত্বক প্রথমে আক্রান্ত হতে শুরু করে। কখনো কখনো শ্বেতী চোখের পাশ দিয়ে, নাকের দুই পাশে বা ঠোঁটের কোণ বা ওপরের ত্বকেও শুরু হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে শ্বেতী খুব একটা ছড়ায় না, একটা বিশেষ জায়গাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। আবার কারো এমনভাবে মুখে, বুকে, হাতে, পায়ে ছড়িয়ে পড়ে যে বোঝাই যায় না একসময় গায়ের রং আসলে কী ছিল! দ্বিতীয় ধরনের শ্বেতীর দাগই মানুষকে শ্রীহীন করে তোলে। ৫০ শতাংশ শ্বেতী ধরা পড়ে বয়স বছর দশেক হওয়ার পর।

শ্বেতী রোগে জীবনাচরণ

এটি একটি অটোইমিউন রোগ, আর এর সঙ্গে অন্যান্য অটোইমিউন রোগ সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে। যেমন পরিপাকতন্ত্রের কিছু সমস্যা, থাইরয়েড বা অন্যান্য হরমোনের রোগ, টাইপ-১ ডায়াবেটিস ইত্যাদি। তাই অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমস্যার দিকেও নজর দিতে হবে।

শ্বেতী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। মানসিক চাপ রোগটিকে ত্বকের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে। কারণ, মানসিক চাপ ইমিউন সিস্টেমকে আরও দুর্বল করে দেয়।

ক্যাফেইন, ডার্ক চকলেট, গ্লুটেন, দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্য, সাদা চিনি এবং সাইট্রাস ফলের মতো কিছু সাধারণ খাবার শ্বেতী রোগকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। কোন কোন খাবারে সমস্যা বাড়ে, তা লক্ষ করুন আর নোট করুন। আখরোট, পেঁপে বেশি করে খাবেন। ভিটামিন বি, সি এবং অ্যামিনো অ্যাসিডসমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর সুষম খাবার গ্রহণ করুন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যামিনো অ্যাসিড পেতে প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খান। এ ছাড়া অন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের জন্য খাবার তালিকায় প্রোবায়োটিকস এবং প্রিবায়োটিকস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

অনেকেই শ্বেতী রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে ত্বকের বাইরের অংশে কিছু উপকরণের প্রয়োগ করে থাকেন। যেমন হলুদের গুঁড়ো ও শর্ষের তেলের মিশ্রণ। এতে কোনো ক্ষতি নেই।

এ ছাড়া তুলসী বা পুদিনাপাতা পিষে তা লেবু রসে মিশিয়ে পেস্ট করে অনেকে ব্যবহার করেন। শ্বেতী রোগের আরেকটি কারণ হলো কপারের ঘাটতি। বাদাম, বীজ এবং সবুজ সবজি তামাসমৃদ্ধ খাবার। তামার পাত্রে সংরক্ষণ করা পানি পান করে আপনি উপাদানটির ঘাটতি পূরণ করতে পারেন।

আয়রন ও দস্তাসমৃদ্ধ খাবারও গুরুত্বপূর্ণ। বাদাম, বীজ, শাক এবং সবুজ সবজি দস্তাসমৃদ্ধ। শ্বেতী নিয়ে ভালো থাকতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা। সুতরাং সক্রিয় থাকুন, প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন, নিয়মিত ব্যায়াম করুন, পর্যাপ্ত ঘুমান ও সুষম খাবার গ্রহণ করুন।

চিকিৎসা কী

ছোট আকৃতির ও সীমিত শ্বেতী মলম বা ওষুধে সেরে যেতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মলম লাগানো বা ওষুধ সেবনের পাশাপাশি সকালবেলার রোদ লাগাতে হবে শ্বেতী আক্রান্ত স্থানে।

বড় আকারের শ্বেতী হলে মলম আর ওষুধে কাজ হতে প্রায় দুই বছর লাগতে পারে। ওষুধে কাজ না হলে অস্ত্রোপচার। শ্বেতী চিকিৎসায় যে অস্ত্রোপচার করা হয়, তার নাম পাঞ্চ গ্রাফটিং। যে ধরনের শ্বেতী বছর দুয়েক মোটামুটি একই জায়গায় অবস্থান করে, সেই শ্বেতী সারিয়ে তুলতে পারে এই পাঞ্চ গ্রাফটিং।

যত অল্প বয়সে শ্বেতীর চিকিৎসা শুরু করা যায় তত ভালো। তাই শরীরের যেকোনো জায়গায় সাদা দাগ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। শ্বেতী আক্রান্ত রোগীকে দেখলে আঁতকে ওঠার কিছু নেই। শ্বেতী রোগীরা বেশির ভাগই মানসিক অবসাদে ভোগেন। অন্যরাও তাদের এড়িয়ে চলেন। কিন্তু এটি ছোঁয়াচে বা অভিশপ্ত কোনো রোগ নয়, কুসংস্কার এড়িয়ে যথাযথ চিকিৎসা নিলে ভালো থাকা যায়। খবর-ডেইলি বাংলাদেশ

আজকের বাজার/আখনূর রহমান