সামর্থ্য অনুযায়ী স্বজন ও প্রতিবেশিদের জন্য কিছু করা উচিত

নিজাম উদ্দিন আহমদ:
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি প্রতিটি মানুষেরই কিছু না কিছু সামাজিক কার্যক্রম করা উচিত। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করেছি। দীর্ঘদিন ইত্তেফাকে সাংবাদিকতাও করেছি। বর্তমানে ‘মুক্তিবাণী’ নামে আমার একটা নিজস্ব পত্রিকা রয়েছে। আমার নিজস্ব উপলব্ধি হচ্ছে- সচেতন নাগরিক হিসেবে দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য এবং আত্মীয় স্বজনদের জন্য কিছু কাজ করে যাওয়া উচিত। আমরা অনেকেই অনেক ভালো আছি। অথচ এই দেশে অনেক মানুষ রয়েছে যারা বিনা চিকিৎসায় মারা যান। ঠিকমত দু’বেলা খাবার পান না। অনেক নিত্য সমস্যা থাকা সত্ত্বেও সমাধান করতে পারছে না। এ সকল কথা চিন্তা করে আমার স্ত্রীর নামে একটি ফাউন্ডেশন করেছি। ফাউন্ডেশনের অধীনে সামাজিক সব কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এর অংশ হিসেবে আমার জন্মস্থান ভোলায় একটি চক্ষু হাসপাতাল করেছি। এই হাসপাতালে গত ১০ বছরে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের চোখে অপারেশন হয়েছে। প্রায় দেড় লক্ষ লোকের চক্ষু চিকিৎসা করা হয়েছে। এবং যারা নিতান্ত গরিব শ্রেণির মানুষ তাদের জন্য আলাদা ডাক্তার রাখা হয়েছে। ডাক্তার তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেন এবং হাসপাতালের পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়।

আমার নিজের কথা
আমার বয়স যখন তিন বছর তখন আমার বাবা মারা যান। আমার মা মারা যান আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পড়ি। তখন আমার পরীক্ষা চলছিল বলে আমাকে খবর দেওয়া হয়নি। আমি আমার মায়ের লাশ দেখতে পাইনি। আমার বাবা মায়ের জন্য আমি তেমন কিছু করতে পারিনি। তাই ভোলায় আমি স্বল্প পরিসরে একটি বৃদ্ধ নিবাস করেছি। ওখানে ৪০/৫০ জন্য বৃদ্ধ থাকেন। যারা অসহায় তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের বাসস্থানের জন্য তিন তলা বিল্ডিং করে দিয়েছি। এর বাইরেও রমজান মাসে প্রায় ২০০২৫০ মানুষ থাকেন।

এছাড়া আমাদের নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে একটি মসজিদ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। যেটি সম্পূর্ণ মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি। ভোলার স্থাপত্য শিল্পের মধ্যে অন্যতম এটি। ভোলা শহরের প্রধান এলাকায় এটি করা হয়েছে। মসজিদের মধ্যে হেফজখানা আছে। মসজিদের পাশে এতিমখানা আছে। এছাড়া ভোলা উকিলপাড়ায় আরেকটি এতিমখানা করা হয়েছে। বৃদ্ধ নিবাস আছে। মাদ্রাসা আছে। এছাড়া আমার নামে ও আমার স্ত্রীর নামে দুটি হাই স্কুল আছে। আমি এসব করতে পেরে আনন্দিত। মহান আল্লাহর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমাদের ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কিছু স্কুলের শিক্ষার্থীদের নাস্তা দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মানুষকে সহায়তা করা হয়।

নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশনের আয়ের উৎস
আমার যত সম্পদ রয়েছে এর একটি অংশ নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশনের নামে দেওয়া আছে। এছাড়া আমার অন্যান্য আয়েরও একটি অংশ ফাউন্ডেশনে দেওয়া হচ্ছে। আমার স্ত্রীর বা আমার ছেলেদের ব্যাক্তিগত আয়ের অংশও এই ফাউন্ডেশনে দেওয়া হয়। আমার চাওয়া- যেন আমার মৃত্যুর পরও এই ফাউন্ডেশনের কাজগুলো চলমান থাকে। চালানোর মালিক তো মহান আল্লাহ। অনেক সময় টাকা থাকলেও কার্যক্রম সেভাবে চলে না। তারপরও টাকা অনেক বড় একটি বিষয়। তাই অর্থনৈতিকভাবে এটিকে স্বাবলম্বী করে রাখার চেষ্টা করছি। আশা করি আল্লাহ সহায় থাকলে আমার মৃত্যুর পরও এটি চলবে।

ভোলা ছাড়াও ঢাকার কয়েকটি জায়গায় চক্ষু সেবা কার্যক্রম রয়েছে
ঢাকায় অনেক অসহায় রোগী রয়েছে। জানা শোনা অনেকেই আছেন। তাদের ভোলা নিয়ে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই ঢাকার ২/৩ টি হাসপাতালের সঙ্গে আমি চুক্তি করেছি। আমি স্লিপ দিয়ে দিই। সেই স্লিপের ভিত্তিতে যতটুকু সম্ভব কনসিডার করে অপারেশন বা চিকিৎসা করা হয়। বিলটি পরে আমি দিয়ে দিই। ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে একটি হাসপাতাল ও শ্যামলীর একটি হাসপাতালের সঙ্গে আমার এ ধরনের চুক্তি রয়েছে। এছাড়া ভোলায় কিছু রোগী রয়েছে যাদের চিকিৎসা ভোলায় করানো সম্ভব হয় না। তাদের ঢাকায় এনে বড় বড় হাসপাতালে নিয়ে তাদের চিকিৎসা করানো হয়। তবে আমার ফাউন্ডেশনের আর্থিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করানো হয়। চোখেরই অনেক চিকিৎসা আছে যা অনেক ব্যয়বহুল। ফলে আমার ফাউন্ডেশনের পক্ষে খরচ বহন করা সম্ভব হয় না। এমনও হয় একজনের চিকিৎসা করাতেই ১ লক্ষ টাকা লেগে যাবে। এখানে আমি ১লক্ষ টাকায় ২০জনের চিকিৎসা করাতে পারি। তাই আমার আর্থিক সঙ্গতি অনুযায়ী চেষ্টা করা হয়।

চক্ষু সেবাকে যে কারণে প্রাধান্য দেওয়া হয়
আমি মনে করি চক্ষু একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মানুষের অন্যান্য রোগ হলে বা সমস্যা হলে অনায়াসেই চলতে পারে। কিন্তু চোখের সমস্যা হলে তার চলতে সমস্যা হয়। বিশেষ করে গ্রামে চোখে ছানি পড়লে মানুষ মনে করে সে অন্ধ হয়ে গেছে। যেখানে মাত্র ৫/৭ হাজার টাকা খরচ করে চিকিৎসা করা সম্ভব। অথচ এই সমস্যা এতই প্রকট যে গ্রামে দেখা যায় অনেক সময় স্ত্রীর চোখে ছানি পড়লে স্বামী তাকে সহ্য করতে পারে না। পরিবারের অন্যান্যরা তাকে নিচু দৃষ্টিতে দেখে। তার জীবন অনেকটা দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। তাই আমার ফাউন্ডেশন থেকে মাত্র ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করে এই সমস্যার সমাধান করা হয়। এতে সে নিজেও সুস্থ হলো এবং পরিবারের বোঝা হতে হলো না।

আছে অন্যান্য চিকিৎসার সুযোগ
আমাদের হাসপাতালে অন্যান্য চিকিৎসাও করানো হয়। সর্দি, কাশি, সাধারণ জ্বরের চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু আমি চক্ষু সেবাটিকে প্রধান হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমার হাসপাতালের মাধ্যমে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষের চক্ষু চিকিৎসা হয়েছে। আমি মনে করি এই দেড় লক্ষ পরিবারকেই সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। আর ছানি পড়লে একবার অপারেশন করিয়ে দেই। এতে সে দীর্ঘদিন ভালো থাকে।

অন্যান্য ব্যবসায়ী বা বিত্তশালীদের প্রতি পরামর্শ
আসলে কাউকে পরামর্শ বা উপদেশ দেওয়ার মতো কিছু নেই। সামাজিক কাজগুলো নিজের উপলব্ধি থেকে করতে হয়। আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। আমি মনে করি প্রতিটি মানুষের কিছু সামাজিক কাজ করা উচিত। মানুষের কল্যাণে কাজ করা উচিত। এগুলো বলে হয় না। আমি কাউকে উপদেশ দিচ্ছি না। তবে আমি চাই প্রত্যকেরই সামর্থ্য অনুযায়ী আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশিদের জন্য কিছু করা উচিত। মানুষ মানুষের জন্য। প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য। মৃত্যুর পর এটিই কাজে লাগবে। এই চিন্তা করলেই ভালো কাজ করতে মন চাইবে। কারও জন্য কোনো পরামর্শের বা উপদেশের প্রয়োজন নেই।

নিজাম উদ্দিন আহমদ

চেয়ারম্যান, মেঘনা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড