সিমেন্টের বাজার বাড়াতে পলিসি সাপোর্ট প্রয়োজন

বাংলাদেশের সিমেন্ট খাত একটি বিকাশমান খাত। বর্তমানে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনে ৩৮টি ফ্যাক্টরি তালিকাভূক্ত রয়েছে। ফ্যাক্টরিগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য এই অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে অনেক নিয়ম কানুন রয়েছে। তবে এই নিয়ম কানুনগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যাও রয়েছে।

বর্তমানে সিমেন্ট সেক্টরে সবচেয়ে মারাত্মক যে সমস্যাটা বিরাজ করছে, সেটা হলো ওভার ক্যাপাসিটি। বছরে আমাদের দেশে সিমেন্ট উৎপাদনের যে ক্যাপাসিটি আছে, তার প্রায় ৪৩ শতাংশ অব্যবহৃত থেকে যায়। এই সময়ে দেশে সিমেন্টের স্থাপিত উৎপাদন ক্যাপাসিটি আছে ৭ কোটি ৩০ লক্ষ মেট্রিক টন, তার বিপরীতে অর্জনযোগ্য ক্যাপাসিটি আছে ৬ কোটি ২০ লক্ষ মেট্রিক টন। আর ব্যবহৃত হয় মাত্র ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মেট্রিক টন। ফলে এই বিশাল পরিমাণ সিমেন্ট উৎপাদন ক্ষমতা অব্যবহৃত থেকে যাওয়ায় কোম্পানিগুলোকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।

একদিকে কোম্পানিগুলোর উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সিমেন্টের দাম কমে যাচ্ছে। এটাও সিমেন্ট সেক্টরের জন্য একটা বড় সমস্যা। দাম কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে কাঁচামাল বা র-ম্যাটারিয়াল এর দাম বৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়া।

চলতি অর্থবছরের আয়কর আইন অনুযায়ী, আমরা কাঁচামাল আমদানী পর্যায়ে যে এডভান্স ইনকাম ট্যাক্সটা দিতাম সেটাকে মিনিমাম ট্যাক্স বা নূন্যতম আয়কর করা হয়েছে। ফলে পরিশোধযোগ্য ট্যাক্সলাইবেলিটির প্রায় চারগুণ এডভান্স ইনকাম ট্যাক্স সরকারী কোষাগারে জমা দিতে হচ্ছে। মনে করেন যেখানে আগে আমাদের প্রতি মাসে ২ কোটি টাকা এডভান্স ইনকাম ট্যাক্স দিতে হতো সেখানে এখন প্রায় ৮ কোটি টাকা এডভ্যান্স ইনকাম ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। ফলে একটি কোম্পানীও লাভজনকভাবে চলছে না।

সিমেন্ট খাতে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করা। এখন কোম্পানিগুলো তাদের ওভার ক্যাপাসিটির জন্য দাম কমিয়ে ক্রেতা ধরে রাখার যে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, এটা একটা বড় সমস্যা। এটাকে বন্ধ করতে হবে।

বর্তমানে আমাদের সিমেন্ট খাতের কোম্পানিগুলোর প্রায় ত্রিশ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে, তার মধ্যে প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকাই ব্যাংকের ঋণ। আর সিমেন্টের বাজার হচ্ছে বছরে পঁচিশ হাজার কোটি টাকার মত। কোম্পানিগুলো এভাবে অ-লাভজনকভাবে চলতে থাকলে অচিরেই এই বিশাল পরিমাণ লোনের কিস্তির টাকা পরশোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং ব্যাংকগুলোর নন-পারফরমিং লোন বা অলস ঋণের পরিমাণ বাড়বে, যা এ মূহুর্তে আমাদের দেশে অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বেশি।

এডভ্যান্স ইনকাম ট্যাক্সের জন্য কোম্পানি গুলোর উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, কিন্তু সেই তুলনায় প্রোডাক্টের দাম বাড়ছে না। ফলে বড় কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতার বাজারে হিমশিম খাচ্ছে, আর ছোট কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

সিমেন্ট উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে, বন্দর থেকে আমরা দ্রুত কাঁচামাল খালাস করতে পারি না। বন্দর থেকে মাল খালাসে অনেক বেশি সময় লাগার ফলে আমাদের খরচ অনেক বেড়ে যায়। তবে এখানে বলতে হয় যে, ফ্লাইএ্যাশ ছাড়া বাকী চারটি র-ম্যাটারিয়াল আমদানিতে আমাদের তেমন কোন সমস্যা হয় না। সেগুলো আমরা কোন ঝামেলা ছাড়াই আমদানি করতে পারি।

সিমেন্ট উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা বেশ কিছুদিন যাবৎ ফ্লাইএ্যাশ ব্যাবহার করি। এই ফ্লাইএ্যাশ পুরোটাই আমদানি করা হয় ভারত থেকে। আমাদের দেশে যখন ফ্লাইএ্যাশের চাহিদা বেড়ে যায় তখন ভারতের সাপ্লায়াররা সিন্ডিকেট করে এর দাম বাড়িয়ে দেয়, এটাও একটা সমস্যা।

সিমেন্ট আমরা এখন পর্যন্ত কেবলমাত্র ভারতেই রপ্তানি করতে পেরেছি। এখানে রপ্তানি করতে গেলেও তাদের যে নিয়ম কানুনগুলো (নন-টেরিফ)রয়েছে তা আমাদের জন্য অনেকটা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। আর আমরা ভারতে যেসব এলাকায় সিমেন্ট রপ্তানি করি, ওসব এলাকা অত্যন্ত অনুন্নত এবং ওসব এলাকার মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও খুব একটা বেশী না। সেক্ষেত্রে আমরা যদি তাদের উপর রপ্তানি মূল্য বাড়াই তাহলে তাদের প্রোডাক্টের ব্যবহার কমে যাবে। এসব দিক বিবেচনা করে রপ্তানির ক্ষেত্রে একটা ব্যালেন্স আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।

আমরা আশা করতে পারি যে, সরকারের পলিসি সাপোর্ট যদি থাকে তাহলে আগামী চার পাঁচ বছরের মধ্যে সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর সুদিন ফিরবে।

আমাদের প্রিমিয়ার সিমেন্টের বিশেষত্ব হলো, আমরা কোয়ালিটিতে কোন ধরণের কম্প্রোমাইজ করি না। ব্যাগের উপর যা লেখা থাকে, আমরা ঠিক ওই পরিমাণ র-ম্যাটারিয়াল দেই। আমাদের আধুনিক নিজস্ব ল্যাব আছে, এর মাধ্যমে সময়মত আমরা পরীক্ষা নীরিক্ষা করে র-ম্যাটারিয়ালসহ সব উপাদান প্রয়োগ করে থাকি।

আমাদের সিমেন্ট উৎপাদনের ক্ষমতা ছিলো বছরে ছয় লক্ষ মেট্রিক টন। এখন তা থেকে আমরা প্রায় চব্বিশ লক্ষ মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতায় উন্নতি লাভ করেছি। আমরা আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা আরও সাড়ে ২৭ লক্ষ মেট্রিক টন বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি, ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যে এই বর্ধিত উৎপাদন শুরু হবে। আমরা গত বছরও আঠারো লক্ষ মেট্রিক টনের বেশী সিমেন্ট উৎপাদন করেছি।

মোঃ শফিকুল ইসলাম তালুকদার, এফসিএমএ
চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও), প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেড