সিরামিক শিল্পে রপ্তানিবান্ধব পরিবেশ দরকার

বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী শিল্পের মধ্যে সিরামিক শিল্প উল্লেখযোগ্য। দেশে ৫৫টি প্রতিষ্ঠান সিরামিকজাত পণ্য উৎপাদন করছে। রপ্তানিও হচ্ছে এসব পণ্য। আর এই পুরো সিরামিক পণ্যের প্রায় ৪০ ভাগ রপ্তানি করে শাইনপুকুর সিরামিক। শাইনপুকুর সিরামিক উৎপাদন শুরু করে ১৯৯৭ সাল থেকে। দেশের চাহিদার প্রায় ৬০ ভাগ সিরামিক পণ্য এই কোম্পানি উৎপাদন করে। বর্তমান সময়ে দেশের সিরামিক ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা, সম্ভাবনা আর এই শিল্পের বিকাশের নানা প্রতিকূলতা নিয়ে তার ভাবনার কথা আজকের বাজার-কে বলেছেন শাইনপুকুর সিরামিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।

 আমাদের দেশের সিরামিক সেক্টর মোটামুটি তিন ধরনের পণ্য উৎপাদন করে থাকে। এগুলো হচ্ছে টেবিল অয়্যার, স্যানিটারি অয়্যার আর টাইলস। এসব পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫৫টি। এর মধ্যে ৮টি প্রতিষ্ঠান টেবিল অয়্যার তৈরি করে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যান্য পণ্য তৈরি করে। দেশের প্রায় ৯০ ভাগ পূরণ করছে আমাদের দেশে উৎপাদিত সিরামিক পণ্য; যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

টেবিল অয়্যার দেশের চাহিদার ৯০ ভাগ পূরণ করে। অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে আসে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। আর রপ্তানির হিসাব ২০১৩-১৪ সালে ছিল ৪৭ মিলিয়ন ডলার। তবে অপ্রত্যাশিতভাবে বিগত তিন বছর আয় কমে গিয়ে গত বছর আয় হয়েছে ৩৭ মিলিয়ন ডলার।

 রপ্তানি কমে যাবার কারণ : কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, সিরামিক বেশ দামি পণ্য। তা ছাড়া, সিরামিকের টেবিল অয়্যার সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে না বললেই চলে। এগুলো সাধারণত হোটেল-রেস্টুরেন্টে ব্যবহৃত হচ্ছে। সারা বিশ্বের মানুষের লাইফস্টাইল এখন অনেকটাই চেঞ্জ হয়ে গেছে। ফলে বাসাবাড়িতে এসবের ব্যবহার কমে গেছে। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে অনেক সময় দাম রাখা সম্ভব হয় না। এর কারণ, আমাদের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করে পণ্য বানিয়ে রপ্তানি করতে হয়। আবার  কাঁচামাল আমদানিতে অতিরিক্ত ভ্যাট ও ট্যাক্স দেওয়ার পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক ঝামেলা পোহাতে হয়।

সব মিলিয়ে আমাদের পণ্যের দাম প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় বেশি পড়ে যায়। এ ছাড়া ২০০৮ সালের পরে ইউরোপের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক ধস নেমে আসায় তারা জীবন ধারণের ধরন বদলে  ফেলেছে। পাশাপাশি চীন ও ভিয়েতনামের নিজেদের কাঁচামাল আছে, ফলে তাদের উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়। কিন্তু আমাদের ওই সব দেশ থেকে কাঁচামাল নিয়ে এসে উৎপাদন করতে হয়। তারপর আমাদের দেশে ভালো মানের ডিজাইনারের অভাব আছে। এ রকম অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে আমাদের কাজ করতে হয়।

আরও একটা বড় সমস্যায় পড়তে হয়েছে, তা হলো আমাদের দেশে ডলারের বিপরীতে টাকার মান বেড়ে যাওয়া। আমরা কাঁচামাল যখন আমদানি করেছি, তখন ডলারের বিপরীতে দিতে হয়েছে ৮২-৮৩ টাকা, অথচ রপ্তানির সময় টাকার মান বেড়ে যাওয়ায় আমরা পেয়েছি ৬৫-৬৬ টাকা। অন্যদিকে ইন্ডিয়ানরা বা চায়নারা তাদের প্রত্যাশিত রেট পেয়েছে ইউরোপের বাজার থেকে।

প্রতিযোগী দেশগুলো আমাদের কাছ থেকে অনেক বেশি সুবিধা নিচ্ছে অর্থনৈতিক দিক থেকে। আমাদের সরকারও গার্মেন্টস সেক্টর, এগ্রিকালচারসহ অনেক সেক্টরে সাবসিডি দিচ্ছে, কিন্তু সিরামিক ইন্ডাস্ট্রির জন্য কোনো সাবসিডি নেই। আমাদের দেশে এই শিল্পের জন্য কাঁচামাল আমদানির জন্য অগ্রিম ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয়। এর পাশাপাশি কাঁচামাল খালাসের জন্য নানা রকম প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়। অনেক সময় মিসিং হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। অথচ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য এই শিল্প একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারত।

তারপরও আমাদের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে: আমাদের পণ্যের মান অন্য দেশের তুলনায় ভালো হচ্ছে। এ কারণে আমরা  বিশ্বের ৫০টি দেশে এসব পণ্য রপ্তানি করতে পারছি। আমাদের অভ্যন্তরীণ স্যানিটারি মার্কেটও বেশ ভালো। অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে এ ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে রপ্তানির আগ্রহ একটু কম দেখা যায়। টাইলসের ক্ষেত্রেও একই রকম। ফ্যাক্টরিগুলো গড়ে উঠছে দেশীয় বাজারের ওপর নির্ভর করে। আশার কথা হচ্ছে, আমাদের পণ্যের মানের কারণে ভারত, নেপাল ভুটানসহ প্রতিবেশী অনেক দেশে রপ্তানির একটি বড় সম্ভাবনা রয়েছে। আশা করছি খুব তাড়াতাড়িই এই রপ্তানি প্রক্রিয়া শুরু হবে।

তবে দেশের সিরামিক পণ্যের বেলায় রপ্তানিবান্ধব পরিবেশ নেই। প্রায় সব ধরনের রপ্তানিযোগ্য শিল্পে সরকারের একটি সাবসিডি আছে, কিন্তু এই শিল্পে কোনো সাবসিডি নেই। আমি মনে করি, সরকারের উচিত এসব পণ্যের জন্য সাবসিডি দেওয়া।

অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপরই টিকে আছে সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি: তবে টেবিল অয়্যারের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব না। আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের ক্ষেত্রেও ধাপে ধাপে যে পরিমাণ ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয়, তাতে পণ্যের দাম পড়ে যায় অতিরিক্ত। তাই টেবিল অয়্যার মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে অনেকটা। তবে আর সব পণ্যের বেলায় দেশের চাহিদার ওপর অনেকটাই নির্ভরতা রয়েছে।

উৎপাদন বেড়েছে না কমেছে: আমাদের  এখানে কয়েক বছর আগে ৭০ হাজার ইউনিট পণ্য উৎপাদন হতো, এখন হচ্ছে ৪০ হাজার ইউনিট। দেশে বর্তমানে ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠানে সিরামিক পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। এই খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রতি বছর সিরামিক পণ্যের রপ্তানি আয় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। আর দেশে এর বাজার প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার।

কর্মসংস্থান ও প্রতিকূলতা: সিরামিক শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

তবে বাধাও রয়েছে। হলি আর্টিজানের মতো ঘটনাসহ নানা রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদেশি ক্রেতারা দেশে কম আসছেন। সে কারণে রপ্তানির নতুন নতুন কাজ পাওয়া একটু কঠিন হয়ে গেছে। যতটুকু রপ্তানির কাজ আসছে, নানা প্রতিকূলতার কারণে সময়মতো রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। তার মধ্যে জ্বালানির স্বল্পতা একটি বড় সমস্যা। অনেক সময় কোনো ঘোষণা ছাড়াই গ্যাসের চাপ কমে যায়। বিদ্যুতের অভাব দেখা দেয়। অনেক সময় একসঙ্গে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করায় প্রচুর কাঁচামাল মেশিনের মধ্যে জমে থাকে। সময়মতো জ্বালানি সরবারহ না থাকায় এসব কাঁচামাল নষ্ট হয়ে যায়।

আমাদের কমিটমেন্ট অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। এর ফলে একদিকে আমাদের বায়ার নষ্ট হয়, অন্যদিকে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়। বিদ্যুৎ বা গ্যাস কোম্পানি যদি আমাদের এক দিন আগে জানিয়ে দিত যে আগামীকাল জ্বালানি সরবরাহ থাকবে না, তবে আমরা আগাম প্রস্তুতি নিতে পারতাম। আমাদের ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে নেওয়া যেত। জ্বালানি সরবরাহ কমে গেলে শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন-ভাতা দিতে হয়। একই সঙ্গে পরিশোধ করতে হচ্ছে সুদসহ ব্যাংকঋণের কিস্তির টাকা। ফলে উৎপাদন চালিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এসব কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখন ঋণখেলাপি হওয়ার পথে।

এই শিল্পের টিকে থাকার জন্য করণীয়: শুল্ক আইনের বিধান অনুযায়ী সিরামিক ও টাইলসের ওপর বিদেশ থেকে তৈরি পণ্য আমদানি ও দেশে উৎপাদন, উভয় পর্যায়ে সমান ৪৫ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে দেশে উৎপাদন পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক ১৫ থেকে ৪৫ শতাংশ। আর তৈরি পণ্যের আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ৬০ থেকে ৪৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে আমদানিকারকদের ৯ শতাংশ শুল্ক কম  হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানি পণ্যের চেয়ে দেশীয় পণ্যের মূল্য ৩৬ শতাংশ অতিরিক্ত হবে। এর একটা সুষ্ঠু সমাধান না হলে এই শিল্প অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।