হাওরে ঢল ও বন্যায় ধানে বিপর্যয়

বিদায়ী ২০১৭ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে ও এপ্রিলের প্রথমে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা তলিয়ে যায়। দুর্বল ও অসমাপ্ত বাঁধ ভেঙে ব্যাপক ফসল হানি ও জানমালের ক্ষতি হয়। এরপর বন্যা দেখা দেয় দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে। হাওরাঞ্চলে বাঁধ বানানোয় দুর্নীতি, অনিয়মের কারণে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। এতে কৃষকদের সর্বনাশ হয়েছে। দেশের অর্থনীতিরও বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। কমে গেছে ধান এবং চাল উৎপাদন। ফলে চালের বাজার ছিল অস্থির। ‘অসহনীয়’ দামে চাল কিনতে হয়েছে মানুষকে।
বিভিন্ন কারণে অন্যান্য খাদ্যপণ্য উৎপাদনেও হেরফের হয়েছে। বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সার্বিকভাবে খাদ্য উৎপাদন কমে গেছে। তবে খাদ্য পণ্যের উৎপাদন কমলেও গত অর্থবছরে কৃষি খাতে ২ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে আগাম বন্যার কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ৯ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন কমেছে। ১৬ নভেম্বর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ মুস্তফা কামাল। সংবাদ সম্মেলনে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব কে এম মোজাম্মেল হক জানান, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২২ দশমিক ৮৮ লাখ মেট্রিক টন আউশ ধান উৎপাদন হয়েছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ২১ দশমিক ৩৩ লাখ মেট্রিক টনে নেমে আসে।
তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমন উৎপাদন বেড়েছে। ওই অর্থবছরে ১৩৬ দশমিক ৫৬ লাখ মেট্রিক টন আমন উৎপাদন হয়েছে, যা আগের অর্থবছর ছিল ১৩৪ দশমিক ৮৩ লাখ মেট্রিক টন।
আগাম বন্যায় এবার বোরো ধানের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে বিবিএস সচিব বলেন, মার্চ থেকে মে- এই তিন মাস বাংলাদেশে বোরোর চাষ হয়। গত অর্থবছর এই মৌসুমে ১৮৯ দশমিক ৩৭ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়েছিল। আর এবার বন্যার কারণে তা কমে হয়েছে ১৮০ দশমিক ১৩ লাখ মেট্রিক টন।
মোজাম্মেল হক বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে গম উৎপাদনও ২০১৫-১৬ অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ হাজার মেট্রিক টন কমেছে। তবে গত অর্থবছর আলু ও ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯৪ দশমিক ৭৪ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছিল। আর ২০১৬-১৭ সময়ে হয়েছে আলু উৎপাদন হয় ১০২ দশমিক ১৫ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৫৫ লাখ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদিত হয়। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ভুট্টা উৎপাদন হয় ২৭ দশমিক ৫৮ লাখ মেট্রিক টন ।
অন্যান্য বছরের মতো, বিদায়ী বছরে সরকার কৃষককে ভর্তুকি মূল্যে সার, বীজ, কৃষি যন্ত্রপাতি দিয়েছে। সেচ মৌসুমে বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে কৃষিঋণ প্রদান করা হচ্ছে। বর্গাচাষিদের জন্য কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুদে বিনা জামানতে কৃষিঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো ২ কোটি ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৩৯৭ জন কৃষকের মাঝে কৃষি উপকরণ কার্ড বিতরণ করা হয়েছে।
সরকার কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও বহুমুখীকরণ, বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করেছে। পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কার এবং জলবায়ু পরিবর্তনে সহনশীল ফসলের জাত, প্রযুক্তি ও কৌশল উদ্ভাবনের ফলে দেশের কৃষি নতুন মাত্রা পেয়েছে। দেশের কৃষি খাতে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
ইলিশ আহরণ বেড়েছে
দেশে অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০১৭ সালে বেশি পরিমাণ ইলিশ আহরণ হয়েছে। তবে হাওরের বন্যা ও পানিতে বিষক্রিয়ার কারণে প্রায় তেরশ’ টন মাছ মারা গেছে। যা দেশের মৎস খাতের জন্য বড় ক্ষতি। তবে বিদায়ী বছরে অধিক সংখ্যক মা ইলিশ উপযুক্ত পরিবেশে ডিম ছাড়তে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুর নদীকেন্দ্রের ১৪ সদস্য বিশিষ্ট গবেষণা দল দেশের ৯টি পয়েন্টে গবেষণামূলক জরিপ চালিয়ে জানিয়েছে, ৪৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ ইলিশ ডিম ছাড়তে সক্ষম হয়েছে। এ কারণে ২০১৭ সালে ইলিশের পোনা বা জাটকা উৎপন্ন হবে ৪০ হাজার কোটি বা তার কিছু বেশি। যা গতবারের চেয়ে আড়াইগুণ বেশি। আগামী জাটকা মৌসুমে এসব পোনা সংরক্ষণ করা সম্ভব হলে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ থেকে ৬ লাখ মেট্রিকটন ইলিশ উৎপাদন হতে পারে।
অপরদিকে হাওরের পানিদূষণে প্রায় ৪১ কোটি টাকার ১ হাজার ২৭৬ টন মাছ মারা গেছে। এ ছাড়া মারা গেছে ৩ হাজার ৮৪৪টি হাঁস। পানিতে অক্সিজেন একেবারেই কমে যাওয়ায় এবং অ্যামোনিয়া ও অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে মাছ মারা গেছে।
হাওরের পরিস্থিতি নিয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগাম বন্যায় হাওর অঞ্চলের ধানখেত তলিয়ে যাওয়ায় কাঁচা ধানগাছ ও ধানের থোড়ে পচন ধরে। এতে হাওরের পানি ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে পড়ে এবং এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে হাওরে মাছের মড়ক দেখা দেয়। মাঠপর্যায় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, হাওরে পানিদূষণে এ পর্যন্ত ১ হাজার ২৭৬ টন মাছ এবং ৩ হাজার ৮৪৪টি হাঁস মারা গেছে। মৃত মাছের মূল্য প্রায় ৪১ কোটি টাকা।
অপরদিকে বিদায়ী বছরের শেষদিকে এসে; নভেম্বরে জানা গেল, চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে এক ধাপ নিচে নেমে গেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল চতুর্থ। ২০১৭ সালে তা পঞ্চম স্থানে নেমে আসে। বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে ভিয়েতনাম। গত ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বিশ্বের মাছ উৎপাদনের পরিসংখ্যান নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার স্ট্যাটিসটিকস-২০১৭ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন সর্বশেষ ২০১৫ সালের তথ্যকে ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, দেশে ওই বছর মোট ২১ লাখ মেট্রিক টন চাষের মাছ উৎপাদিত হয়েছে। মূলত প্রতি দুই বছর পর এফএও রোম কার্যালয় থেকে মাছের উৎপাদনবিষয়ক বৈশ্বিক এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়ে থাকে।

কৃষিপণ্য রপ্তানি ছিল ইতিবাচক
চলতি অর্থবছরের (২০১৭-১৮) প্রথম পাঁচ মাসে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে ২৫ কোটি ৯৬ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার বা প্রায় ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। যা এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি। একইসঙ্গে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে একই সময়ের তুলনায়ও এই খাতের রপ্তানি আয় ১৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে চা রপ্তানিতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে এ খাতে আয় হয়েছে ১৩ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার; যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। তবে গত অর্থবছর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে এ খাতে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৪০ দশমিক ২১ শতাংশ।
জুলাই-নভেম্বর মেয়াদে সবজি রপ্তানিতে ৩ কোটি ৮ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আর এ বিপরীতে এ সময়ে এ খাতে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি। তবে আগের অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসের চেয়ে এ খাতের রপ্তানি আয় ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ কমেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে তামাকজাত পণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৩ কোটি ৬৪ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার; যা এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে আগের অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসের চেয়ে এই খাতের আয় ৩৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেড়েছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর মেয়াদে ফল রপ্তানিতে আয় হয়েছে ২১ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার; যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭৭ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে।
আলোচ্য সময়ে মসলা জাতীয় পণ্য রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ কোটি ৫৪ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। এই সময়ের মধ্যে এই খাতে আয় হয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার; যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসের মসলা জাতীয় পণ্য রপ্তানি আয়ের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসের আয় ৪৩ দশমিক ৮১ শতাংশ বেড়েছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে শুকনো খাবার রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৬ কোটি ৩৯ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। যা এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩২ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং আগের অর্থবছরের একই সময়ের আয়ের তুলনায় ৮৫ দশমিক ৬১ শতাংশ বেড়েছে।
অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে অন্যান্য কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে ১০ কোটি ৭১ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। যা এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১০৭ দশমিক ১৮ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এ খাতের আয় ১ দশমিক ০২ শতাংশ কমেছে। প্রধান ফসল ধানের উৎপাদন কম হলেও মৎস, প্রাণীসম্পদ, সবজির মতো কৃষির অন্যান্য উপখাত মিলিয়ে ভালোই কেটেছে দেশের সার্বিক কৃষি খাতের ।
আজকের বাজার: সালি / ০১ জানুয়ারি ২০১৮