হাতের নাগালে বিচারিক সেবা

রাজধানীর নন্দিপাড়া এলাকার বাসিন্দা পলাশ হাওলাদার। তার এলাকায় একটি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, সেমাই এবং ফাস্ট ফুড আইটেম তৈরি করছিল। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এ প্রতিষ্ঠানটির তৈরি খাদ্য সামগ্রীর বিক্রয়ের জন্য ১১টি কেন্দ্র ছিল। বিভিন্ন সময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ করা হলেও তারা আমলে নেয়নি। পলাশ হাওলাদার-এর অভিযোগের ভিত্তিতেই পরবর্তিতে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় মোবাইল কোর্ট।

পলাশ হাওলাদার বাসস’কে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির এই অনৈতিক কর্মকান্ড দেখে আমি ই- মোবাইল কোর্টে অভিযোগ দাখিল করি। অভিযোগটি গ্রহণ করে মোবাইল কোর্ট সরেজমিনে এসে প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করে আমাদের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে। এর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটিকে অর্থদন্ডসহ সিলগালা করে দেয়। ই-মোবাইল কোর্টে এতো সহজে বিচারিক সেবা পাওয়ায় পলাশ হাওলাদার সন্তোষ প্রকাশ করেন।

কুমিল্লার চান্দিনার মাইজখার এলাকার শিক্ষক বিধান চন্দ্র শীল বলেন, আমার ছাত্রী ১৫ বছর বয়সী নবম শ্রেণীর এক ছাত্রীর পরিবার তার বিয়ের আয়োজন করছিল। ছাত্রীর অভিভাবককে মেয়েটিকে বিয়ে না দিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেই। কিন্তু অভিভাবক কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। বরং তিনি স্থানীয় ইউপি সদস্য ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় বিয়ের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেন। মেয়ের বাবা বিয়ের কার্ড করে দাওয়াতি কার্যক্রমও শুরু করে দেয়। এ অবস্থায় আমি ই- মোবাইল কোর্ট সিষ্টেমের মাধ্যমে অভিযোগ দাখিল করি। আমার অভিযোগের ভিত্তিতে উপজেলা প্রশাসন থেকে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিষ্ট্রেট মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিয়েটি বন্ধ করেন। বিধান চন্দ্র শীল হাতের কাছে এবং সহজে বিচার প্রাপ্তির এই সুবিধা পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এই ঘটনায় ই-মোবাইল কোর্ট সম্পর্কে আমাদের মধ্যে সুস্পষ্ট ধারণা জন্মেছে যে, বিচারিক সেবা এখন সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে।

ই-মোবাইল কোর্ট সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ই-মোবাইল কোর্ট সিষ্টেমের মাধ্যমে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিষ্ট্রেটগণ খুব সহজে ও দ্রুততার সাথে অনলাইনে এবং প্রয়োজনে অফলাইনে মোবাইল কোর্টের সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারেন। এ ব্যবস্থায় অভিযোগনামা দায়ের, অভিযোগ গঠন, জব্দতালিকা প্রস্তুত, জবানবন্দি গ্রহণ ও আদেশ প্রদান করা হয়। এখন পর্যন্ত ই-মোবাইল কোর্টে ৭ হাজার ৮০৯ জন ব্যবহারকারী রয়েছেন এবং ২ লাখেরও অধিক মামলা ই-মোবাইল কোর্টে নিষ্পত্তি হয়েছে।

শহর থেকে গ্রাম সকল পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর নাগরিক সেবা প্রদানে এটুআই কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করে আসছে। এখন দেশের সর্বত্রই ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া। এরই ধারাবাহিকতায় স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, উদ্ভাবনী ও জনমুখী বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং আদালত ও নাগরিকের মধ্যকার দূরত্ব কমানোর লক্ষ্যে বিচার বিভাগীয় তথ্য বাতায়নের যাত্রাও শুরু হয়েছে। বর্তমানে ৬৪টি জেলা আদালতে, ৫টি দায়রা আদালতে এবং ৮টি ট্রাইব্যুনালে বিচার বিভাগীয় বাতায়ন সক্রিয় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার সরকার (গুএড়া) প্ল্যাটফর্ম উদ্বোধন করেছেন। এ প্ল্যাটফর্মের বিভিন্ন সেবা, ই-নথি, একসেবা উদ্যোগের সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় সংযোজন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে ভার্চুয়াল কোর্ট সিষ্টেম (গুঈড়ঁৎঃ) কার্যক্রম ৮৭টি নিন্ম আদালতে শুরু হয়েছে। দেশের বিচার বিভাগের জন্য তৈরী এ সেবায় একইসাথে শুনানি কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সুরক্ষিত ভিডিও কনফারেন্সিং সিষ্টেম সংযুক্ত করা হয়েছে। এ কার্যক্রমের আওতায় এ পর্যন্ত ২৭ হাজারের অধিক জামিন আবেদন গ্রহণ, ১৬ হাজারেরও বেশী জামিন শুনানির তারিখ ধার্য এবং ১১ হাজারেরও অধিক ভার্চুয়াল শুনানি সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় ৯ হাজার আইনজীবী এই প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধিত হয়েছেন।

কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট শরীফুল ইসলাম বলেন, তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে সুরক্ষিত ভিডিও কনফারেন্সিং সিষ্টেমে বিচারিক সেবা নিশ্চিত হওয়া তার কাছে একসময় বিস্ময়কর মনে হতো। তিনি বলেন, এখন এটিই বাস্তবতা। করোনা মহামারিজনিত বর্তমান পরিস্থিতিতে শারীরিক উপস্থিতি ব্যতিরেকে ভার্চুয়ালি বিচারিক কার্যক্রম চালু রাখতে পারায় বিচার প্রার্থীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে। সহজে কম সময়ে ও কম খরচে নিশ্চিত হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তিবান্ধব নাগরিক সেবা।

করোনাভাইরাস জনিত কারণে জরুরি সেবা ছাড়া সবকিছুই চলছে বিধিনিষেধ মেনে। কিন্তু বন্ধ হয়নি দেশের সর্বোচ্চ ও নিম্ন আদালতে বিচারিক কার্যক্রম। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে চলছে কোর্টসমূহ। এতে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বিচারক ও আইনজীবীরা মামলা পরিচালনায় অংশ নিচ্ছেন। ফলে বজায় থাকছে সামজিক ও শারীরিক দূরত্ব। থাকছে না করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।

এখন দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশের মানুষ ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য হলো- সমাজের শ্রেণি, বর্ণ, পেশা ও গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সকল মানুষের দোরগোড়ায় সহজে এবং দ্রুততার সাথে সরকারি সেবা পৌঁছে দেয়া।

এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সর্বত্র সমন্বিত ই-সেবা কাঠামো গড়ে তুলেছে এবং এ লক্ষ্যে এটুআই এর সহযোগিতায় বর্তমানে প্রায় সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বৃহৎ পরিসরে ই-সেবা প্রদান করে আসছে। দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে উচ্চ ও নিম্ন আদালতসহ বিচার বিভাগের তথ্য নিয়ে চালু আছে বিচার বিভাগীয় তথ্য বাতায়ন। স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও জনমুখী বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং আদালত ও নাগরিকের মধ্যকার দূরত্ব কমানোর লক্ষ্যে এ উদ্যোগের যাত্রা।

সরকারি সব সেবা এক প্ল্যাটফর্মে আনার অঙ্গীকার নিয়ে ‘আমার সরকার বা মাই গভ’ প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে। কেউ বিপদে পড়লে অ্যাপটি খুলে মোবাইল ফোন ঝাঁকালে সরাসরি ৯৯৯ নম্বরে চলে যাবে ফোন। ৩৩৩ নম্বরে কল করেও এই এ্যাপ ব্যবহারকারীরা নানা ধরনের তথ্য ও সেবা নিতে পারবেন। প্রয়োজনীয় তথ্যের মাধ্যমে আবেদন, কাগজপত্র দাখিল, আবেদনের ফি পরিশোধ এবং আবেদন-পরবর্তী আপডেটসহ অন্যান্য বিষয় জানা যাবে। আর আবেদনকারীর পরিচয় নিশ্চিত করা হবে জাতীয় পরিচয়পত্রের সাহায্যে। প্ল্যাটফর্মটিতে বর্তমানে ৪৫০ টি সেবা জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ওই প্ল্যাটফর্মটিতে র‌্যাপিড ডিজিটাইজেশনের আওতায় প্রায় ১০৫৬ টি সেবা ডিজিটাইজেশন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা এখন প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা। তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহারে বাঙ্গালি জাতির অগ্রগতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি কেড়েছে। নাগরিক সেবার মানোন্নয়নে বর্তমানে সরকার গৃহিত সামগ্রিক সেবাদান প্রক্রিয়ায় গতি এনেছে। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ ডিজিটাল রাষ্ট্র হিসেবে একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত হবে, আমরা হবো সেই গর্বিত রাষ্ট্রের নাগরিক। তথ‌্য-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান