অতিমূল্যায়িত শেয়ারের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে

পুজিবাজার অভিমত

সুলাইমান রুবেল
স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রতিটি ধাপে যে উন্নয়নমূলক পরিবর্তন এসেছে তা বিস্ময়কর। সময় সময় সরকার পরিবর্তন হয়েছে। সকলের প্রচেষ্ঠায় দেশ অনেকদূর এগিয়েছে। ব্যবসায়ী হিসেবে আমার যে অভিজ্ঞতা, তা থেকে মনে হয় আমরা আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু পারিপাশির্^ক, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কারণে এখনও আমরা সেভাবে এগুতে পারিনি।

রাজনৈতিক দল হিসেবে যারাই সরকার গঠন করে, তাদের সঙ্গে ব্যাবসায়ীদের একটা সমন্বয় থাকা দরকার। সরকার দেশ পরিচালনা করছে। এখানে ব্যাবসায়ীদেরও অবদান আছে। একজন মা পরিবারের সব কাজ করে সন্তানকে নাস্তা খাইয়ে অফিসে পাঠান। তার অবদানটা আমরা সেভাবে দেখি না বা মূল্যায়ণ করি না। কিন্ত আমার ব্যাবসার উন্নয়নে তারও একটা বিশাল ভাগ রয়েছে। সেটা আমরা জিডিপিতে দেখি না। ঠিক একইভাবে রাষ্ট্রেরও সে দায়বদ্ধতার জায়গা আছে। যিনি সরকার গঠন করছেন, তার যেমন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমন্বয়ে ভূমিকা রাখা উচিত তা তিনি করছেন না। আবার বিরোধী দলে যারা থাকেন তাদেরও সেই ভূমিকাটা পালন করা উচিত। কিন্ত তারাও তাদের দায়বদ্ধতার জায়গায় থাকছেন না। আবার সুশিল সমাজ থেকে শুরু করে ব্যাবসায়ী সমাজের যারা রয়েছেন- তাদের কোন অবদানও আমরা দেখতে পাই না। এটা শুধু যে আমাদের সমস্যা তা কিন্ত না। কম বেশি সকল দেশেই এ সমস্যা রয়েছে। এগুলোকে কাটিয়ে উঠে আরো কিছু কনসেপ্ট গড়ে তোলা দরকার।

২০০১ সালে সর্বপ্রথম আমরা একটা উদ্যোগ হাতে নেই, যার নাম ছিল ‘ইউথ ডেভলপমেন্ট’। এর লাইসেন্স করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ি। কারণ বানিজ্য মন্ত্রনালয় এই নামে কোনো রেজিস্ট্রেশন দিতে চায় নি। তাদের কথা তরুণরা তো কোনো প্রোডাক্ট নয়। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে আমরা তাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হই যে, তরুণরাও একটা আলাদা প্রোডাক্ট। তারপর আমরা টিও লাইসেন্স পাই। ২০০৬ সালে এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনে ‘বেস্ট ইউথ অ্যাওয়ার্ড’ কম্পিটিশনে এন্টারপ্রেণার হিসেবে ২৪ টি দেশের মধ্যে আমি প্রথম হই। পরবর্তীতে ‘ইউথ’ নামে একটি সেল গঠিত হয়। এর পর থেকে আর কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি।

আসলে উদ্যোক্তা হওয়া আর ব্যবসায়ী হওয়া এক বিষয় না। এটা শুরুতেই বুঝতে হবে। আলাদা আলাদাভাবে এ দুইটি বিষয়কে ভাবতে হবে। সরকারকে তরুণদের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে এই সেক্টর থেকেই ব্যাবসা বের করা সম্ভব। প্রতিটি তরুণ একেকজন আলাদা মেধা, আলাদা সত্ত্বা।

যুব মন্ত্রণালয়ে প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়। এই টাকা কোথায় যায়, কি হয় জানি না। এখানে যদি একটা যুব ব্যাংক করে তাদের সুযোগ করে দেয়া যায়; যাতে তরুণরা প্রশিক্ষণ শেষে জামানতবিহীন ঋণ নিয়ে নিজেদের তৈরি করতে পারে। কিন্তু আমরা দখছি কি? আপনি যদি নতুন করে কোন ব্যাংকে ঋণের জন্য আবেদন করেন, তারা আপনার অভিজ্ঞতা চাইবে। তিন বছরের ট্রেড লাইসেন্স চাইবে। আপনি যদি নতুন উদ্যোক্তা হন, কি করে তাদের রিকোয়ারমেন্ট পূরণ করবেন! এজন্য প্রতিটা এলাকার জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাহলে তরুণদের মাধ্যমে একটা বিপ্লব আনা সম্ভব।

বাংলাদেশ বিশাল একটা সম্ভাবনার দেশ এবং এই দেশের তরুণরা সম্ভাবনাময়। আমরা তাদের কাজে লাগাতে পারি। কিন্ত বাধাটা আমাদের মন মানসিকতায়। কোন কাজ করতে গেলে বড়রা যদি বলে- ‘ওরা আর কি কাজ করবে? তারা তো এখনও ছোট।’ এই ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। না হলে হবে না।

আমাদের মতো উদ্যোক্তাদের অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। যদি নতুন কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান করতে যান তাহলে চাইলেও আপনি কোন লজিস্টিক সাপোর্ট পাবেন না। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি একসাথে পাবেন না। ব্যাংকে যখন প্রজেক্ট সাবমিট করবেন ব্যাংক সময়মতো টাকা দিবে না। ব্যাংকের ক্রাইটেরিয়াগুলো আলাদা। এজন্য এ সেক্টরকে এগিয়ে নিতে সরকারকে তরুণ উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বসে সমাধান করতে হবে। এজন্য আমার পরামর্শ হলো- তরুণদের জন্য আলাদা করে একটা সেক্টর তৈরি করা। তাহলে তাদের কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

পুঁজিবাজার নিয়ে ২০১০ সালে আমি শ্রীলংকায় একটা রোড-শোতে অংশ নিয়েছিলাম। ওখানে স্থানীয়রা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- বাংলাদেশে পুঁজিবাজার আছে কিনা। আমি তার কথায় অবাক হলাম। আসলে আমাদের দেশে একেকজন একেকভাবে মন্তব্য করেন। তারা পূরোবাজারকে ঘোলাটে করে রাখেন। আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি একটা দেশের মেরুদন্ড যদি অর্থনীতি হয়, তাহলে এর দু’টা অংশ রয়েছে। একটা হলো মানি মার্কেট। অন্যটা ক্যাপিটাল মার্কেট বা পুঁজিবাজার। ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধ্বসের পর এখন পর্যন্ত কিছু অর্গানোগ্রাম পরিবর্তন করা হয়েছে। কিছু অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হয়েছে। কিন্ত আমার মনে হয় যারা নিয়ন্ত্রক আছেন, তাদের কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে। কোন ঘটনা ঘটলেই বলা হয় গেমলাররা এটা করেছে। বা কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমন করা হয়। এই ব্যাপারগুলো ঠিক না। একটা সঠিক ও সুনির্দিষ্ট অর্গানোগ্রাম করতে হবে।

এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এমন একটা জায়গা থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। যেন সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গাটা থাকে। পুঁজিবাজারকে মানুষ যেন জুয়াড়িদের জায়গা না বলে। আস্থা অর্জন করার জন্য সিকিউরিটিজ এন্ড একচেঞ্জ কমিশনকে কাজ করতে হবে। সচেতনতার জায়গায় আরো কাজ করার আছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে হতাশাটা কাজ করে তা দূর করেত হবে। দেখা যায় মার্কেট সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নাই এমন কাউকে এনে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় বসিয়ে দেওয়া হয়। তিনি মার্কেট বুঝতে বুঝতে হয়তো পাঁচ বছর চলে যায়।
আগে আমরা ১৮, ১৯ বা ২০% ইন্টারেস্টে ব্যবসা করেছি। এখন ব্যাংক ইন্টারেস্ট সিঙ্গেল ডিজিটে চলে এসেছে। তারপরও ব্যবসা নাই। এটা কেন? আবার কিছু কিছু শেয়ার ওভার প্রাইস হয়ে বসে আছে।

আমাদের দেশে আরেকটা সমস্যা হচ্ছে- ভাল স্কিপ নাই। আমরা একসময় দেখেছি সবাই শুধু গার্মেন্টেস ব্যবসার পেছনে ছুটে বেড়িয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও অনেক ব্যবসা বাংলাদেশে আছে। অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। তাদেরকে ইনভাইট করতে হবে। তাদেরকে সরকারের রুলস এন্ড রেগুলেশনের মধ্যে ফেলতে হবে। মানুষকে বুঝাবে হবে যে, বিনেয়োগ করার জন্য পুঁজিবাজার একটা সেক্টর। মানি মার্কেটের সঙ্গে ক্যাপিটাল মার্কেট একদম প্যারালাল।
ইনভেস্টরদের পক্ষে একটা কথা বলে নিই। এখানে মার্চেন্ট ব্যাংক আছে। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী আছে। ব্রোকারেজ হাউস আছে। ব্যাংক এসোসিয়েশন আছে। ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউট এসোসিয়েশন আছে। ক্ষুদ্র বিনোয়েগকারী বলি বা ইনভেস্টর যাই বলিনা কেন- তাদের কোনো এসোসিয়েশন নাই। তাদের কথা কে বলবে? তাদের প্রতিনিধিত্ব কে করবে? তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সরকারি পর্যায় থেকে হোক বা প্রাইভেট সেক্টর থেকে হউক একটা উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। যে বিনিয়োগকারীরা আজ রাস্তায় নেমেছে, আন্দোলন করেছে- তাদের কোনো লাইসেন্স নাই। তবে তারা একটা ঐক্য পরিষদের মাধ্যমে এক্টিভিটিজ দেখিয়েছে। তাদের একটা এসোসিয়েশন করা উচিত বলে আমি মনে করি।

বিনিয়োগ করার আগে আমরা অনেকে চিন্তা করি যে, অমুক শেয়ারটা কত দিয়ে কিনব? কতদিনের মধ্যে কত টাকায় দর উঠবে? বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এভাবে চিন্তা করা ঠিক না। ট্রেডিং না করে ইনভেস্টমেন্টে যেতে হবে। বিনিয়োগের আগে আপনি একটা কোম্পানির ব্যাকগ্রাউন্ড দেখবেন। এনালাইসিস করবেন। দেখেশুনে বিনিয়োগ করবেন। এটা প্রত্যেক সেক্টরের জন্য প্রজোয্য।

কিছু কিছু সেক্টর আছে ওভার প্রাইস। কিছু সেক্টর লো প্রাইসে আছে। আমি দেখি ছোট পেইড আপের কিছু কিছু কোম্পানীর অস্তিত্ব নাই। অথচ ১০ টাকার শেয়ার হয়ে গেছে ১০০ টাকা- দেড়শ টাকা। কেন এটা হল? ব্যাকগ্রাউন্ড কি? এটা হোমোজ্যাকিলি হচ্ছে।

প্রত্যেকটা ইনভেস্টরকে আমি ইনডিভিজুয়ালি বলতে চাই যে, আপনি দেখেশুনে বিনিয়োগ করেন। অনেকেই আছে, যারা সফল কাউকে ফলো করে শেয়ার কিনে। এটাও সত্য যে, আমরা লাভের জন্য শেয়ার ব্যবসায় আসি। জাংক শেয়ার দিয়ে মার্কেট টিকিয়ে রাখা যাবে না। মার্কেট সাসটেইন করতে হলে ভাল ভাল কোম্পানীগুলোকে মার্কেটে আসতে হবে।

সুলাইমান রুবেল
চেয়ারম্যান
রেয়ার গ্রুপ ও ইউরো বাংলা সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড