স্বপ্নে বিভোর পপি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নই প্রতিটি মুহূর্ত তার। এ স্বপ্ন থেকেই তিনি এখন রংপুরের স্বপ্নবাজ নারী। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, অন্যকেও প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন। ইতোমধ্যেই রংপুরের সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই অনলাইন থেকেই তিনি এখন সেরা উদ্যোক্তা।
প্রয়োজন পথ দেখায়। উম্মে কুলসুম পপিও প্রয়োজনের তাগিদে বেছে নিয়েছিলেন নিজের পথ। সে পথে সাফল্য ছিল, ব্যর্থতা ছিল, ছিল করোনার স্মৃতি। কিন্তু পপি পথ হারাননি। এখন ফেসবুকে তার নামে যে পেজ রয়েছে, তাতে অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ। পড়াশোনা শেষ করেই তিনি পরিচিতি পেয়েছেন অনলাইন উদ্যোক্তা হিসেবে।
পপি পড়াশোনা করতেন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিষয়ে। ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বড় ভাইদের কাছে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের কাজ শেখেন তিনি। এসময় পরিচয় হয় একই বিশ্ববিদ্যায়ের আরও কিছু সহপাঠীর সঙ্গে। তাদের কাছে শোনেন পরিবার ও জীবনযুদ্ধের গল্প। পপি নিজেও ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তাই এসব বিষয় সহজে উপলব্ধি করতে পারেন। এসময় মাথায় আসে এসব শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার কথা। যাতে তারা নিজেদের আয়ের অর্থ দিয়ে পড়ালেখার খরচ চালাতে পারেন।
প্রথম পদক্ষেপ:
নিজের আইডিয়া শুধু ভাবনায় সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি পপি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত বড় ভাইদের সঙ্গে তা নিয়ে কথা বলেন এবং পরামর্শ চান। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে চার বন্ধু মিলে ‘বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট’ নামে ফেসবুক পেজ খোলেন পপি। এসময় তারা টেকনিক্যাল হোম সার্ভিস নিয়ে কাজ করছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ড্রপআউট শিক্ষার্থী এবং এসএসসি ও এইচএসসিতে অকৃতকার্য ১৫-২০ জনকে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করেন তিনি। প্রথমে অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানের মাধ্যমে এসব শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অর্ডার সংগ্রহ করে গ্রাহকদের বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের টেকনিক্যাল সার্ভিস দিতে থাকে বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট। এটি ছিল পপি ও তার বন্ধুদের প্রথম পদক্ষেপ।
প্রতিযোগিতা ও নতুন অভিজ্ঞতা:
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ‘বিজনেস আইডিয়া’ নামক প্রতিযোগিতায় অংশ নেন পপি ও তার বন্ধুরা। তাদের বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট এ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়। প্রতিষ্ঠানটি বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং পপিদের ব্যবসার পলিসি জেনে ঋণ দিতে আগ্রহী হয়। সেই ঋণের অর্থে তাঁরা ২০১৯ সালে রংপুর শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে বিডি অ্যাসিস্ট্যান্টকে প্রতিষ্ঠানে রূপ দেন। পরে সেখান থেকে নিজেদের কাজ পরিচালনা করতে থাকেন।
করোনা ও হাঁড়িভাঙা আমের গল্প:
আমাদের কাছে ইতিহাসের ভয়ংকর স্মৃতি কোভিড-১৯। প্রচুর নতুন উদ্যোগের মতো ২০২০ সালে বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট নামের ছোট্ট প্রতিষ্ঠানটি আংশিক বন্ধ হয়ে যায়। পপির সঙ্গে থাকা দুই বন্ধু ব্যবসা ছেড়ে চলে যান; কিন্তু পপি হাল ছাড়েননি।
করোনা মহামারির মধ্যে পপির মাথায় নতুন আইডিয়া আসে। সে সময় আমের মৌসুম চলছিল। মানুষের কাছে মৌসুমী ফলের ব্যাপক চাহিদা। পপি তার আরেক সঙ্গী আবু সাঈদ আল সাগরকে নিয়ে অনলাইনে রংপুরের বিখ্যাত হাঁড়িভাঙা আম বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন।
ওই বছর তারা বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকায় থাকা পরিচিত লোকজনের কাছে আম সরবরাহ করেন। ভালো আম সরবরাহের জন্য সে সময় ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন পপি ও সাগর। পরের বছর দুজনে মিলে ফেসবুকে ‘প্রিমিয়াম ফ্রুটস’ নামে একটি পেজ খুলে পুরো দেশে বিভিন্ন মৌসুমী ফল সরবরাহ শুরু করেন। নিজেরা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে আমবাগান ইজারা নিয়ে বিষমুক্ত আম উৎপাদন করেন এবং বাগানের বিষমুক্ত আমের ভিডিও আপলোড করতে থাকেন নিজেদের পেজে।
সেসব ভিডিও দেখে গ্রাহকদের আস্থা বেড়ে যায়। পপি এখন শুধু হাঁড়িভাঙা আমই সরবরাহ করেন না, বিষমুক্ত বিভিন্ন মৌসুমী ফল সরবরাহ করেন পুরো দেশে।
রংপুর শহর:
পপি ও সাগর মিলে রংপুর শহরে নিজেদের অফিস তৈরি করেছেন। সেখান থেকে বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট ও প্রিমিয়াম ফ্রুটসের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এর পাশাপাশি পপি তার ফেসবুক পেজ থেকে বিভিন্ন কৃষিবিষয়ক কনটেন্ট তৈরি করেন। এসব কনটেন্ট এরই মধ্যে অনলাইনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্তমানে তার ফেসবুক ফলোয়ারের সংখ্যা ২২ লাখ। বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট ও প্রিমিয়াম ফ্রুটস নামের প্রতিষ্ঠান দুটিতে এখন কাজ করছেন প্রায় ৪০ তরুণ।
পপি জানিয়েছেন, শুধু বিষমুক্ত ফল নয়; তার প্রতিষ্ঠান বিষমুক্ত সবজিও সরবরাহ করবে গ্রাহকদের।
নতুন বছরে নতুন আশা। পপি জানেন, ইচ্ছা থাকলে আশা একসময় পূরণ হবেই। আপাতত সেই স্বপ্নে বিভোর পপি।
পপি বাসস কে বলেন, সমাজের তরুণদের পাল্টে দিতেই ও প্রতিষ্ঠিত করতেই তিনি মাঠে নেমেছেন। প্রতিদিনই তৈরি করতে চান নতুন উদ্যোক্তা। সমাজের বেকার যুবকদের পাশে থাকতে চান। মাদক ও কেসিনো ছেড়ে বেকার ও উদীয়মান যুবকরা যাতে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে চান তিনি। এজন্য দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, নানা প্রশিক্ষণ। উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করলে তিনিও পাশে থাকতে চান, সহযোগিতা করতে চান। তিনি চান সরকার এগিয়ে আসুক।
রংপুরের জেলা প্রশাসক রবিউল ফয়সাল বাসস কে বলেন, আমরা পপিকে সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত, পাশাপাশি তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে যারা কাজ করছেন তাদেরকেও আমরা সহায়তা করতে চাই। সরকার তাদের পাশে আছে এবং থাকবে। পপি আমাদের আইডল। অনলাইন থেকেই শিক্ষা নিয়ে অনলাইনের ব্যবসার মধ্য দিয়েই তিনি এখন রংপুরে সেরা উদ্যোক্তা। পপিকে দেখেই এগিয়ে আসুক তরুণ উদ্যোক্তারা, কাজ করুক নতুন উদ্যমে। (বাসস)