কুশল মেন্ডিসকে আউট করে যেভাবে তেড়ে গেলেন মাশরাফি তাতেই বোঝা গিয়েছিলো একটা শিরোপা জিততে কতোটা মরিয়া টাইগাররা। শিরোপাটা এবার যে চাই-ই চাই। কিন্তু ভাগ্যটাই শেষ পর্যন্ত থাকল না টাইগারদের সাথে। তা না হলে কি দলের সেরা তারকাই এমন মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ইনজুরিতে পড়েন! দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন বিশ্ব সেরা অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসান। বোলাররা জয়ের মঞ্চ গড়ে দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষকে ২২১ রানে অল আউট করে। কিন্তু ভাগ্যকেই কি দুষবেন শুধু? পুরো ম্যাচে একই চিত্র। মুশফিকুর রহীম একবার রিভিউ নিয়ে বাঁচলেন, ওইটুকুই। ফলে আরও একটি স্বপ্নভঙ্গের গাঁথাই রচিত হয় মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে। সঙ্গীদের ব্যর্থতায় বৃথা গেল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের লড়াই। চন্ডিকা হাথুরুসিংহের শ্রীলঙ্কার কাছে আবারও বড় ব্যবধানে হারতে হলো টাইগারদের। অধরা শিরোপাটি চোখের সামনেই উদযাপন করতে দেখলেন লঙ্কানদের। ত্রিদেশীয় সিরিজে শনিবার বাংলাদেশের হার ৭৯ রানে।
টুর্নামেন্টের শুরু থেকে বাংলাদেশ ফেভারিট ছিল। কিন্তু শেষটায় চরম ব্যাটিং ব্যর্থতার নির্লজ্জ প্রকাশ। দুই ম্যাচ খেলেই ফাইনালে উঠে শিরোপায় হাত দিয়ে রেখেছিল মাশরাফির দল। তাদের সেই হাত সরিয়ে দিয়ে নিজেদের হাতে শিরোপাটা তুলে নিয়ে তাতে চুমু খেলেন শেষে লঙ্কানরা। আরেকবার বিয়োগব্যথায় নীল টাইগার দল। সাথে কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমী।
বোলাররা তাদের কাজটা খুব ভালোভাবেই করেছিলেন এই মহারণে। ঠিক ৫০ ওভারে তারা ২২১ রানে অল আউট করে দেয় লঙ্কানদের। এরপর সাড়ে চার রানরেটে রান দরকার ওভারপ্রতি। একজন ব্যাটসম্যান এবং তার নাম সাকিব বলেই ২২২ অসম্ভব? শুরু থেকে বাজে ব্যাটিং আর শীর্ষ ব্যাটারদের যাওয়া আসার মিছিল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লড়াইয়ের ম্যাচে প্রতিদ্বন্দিতাও গড়তে দিল না! ৪১.১ ওভারে ১৪২ রানে অল আউট টাইগাররা। টুর্নামেন্টের ফেভারিট হয়েও শেষ পর্যন্ত এমন হার!
লঙ্কান ইনিংসের ৪২তম ওভারের প্রথম বলে ইনজুরিতে পড়লেন সাকিব। এক্সট্রা কাভার থেকে দৌড়ে গিয়ে বল ধরতে ঝাঁপিয়েছিলেন রান আউট করার জন্য। বিপত্তি ঘটলো সেখানেই। বলটা ধরতে পারলে হয়তো রান আউটের সম্ভবনা থাকতো। শতভাগ নিশ্চিত নয়। তবে সেটা ধরতে গিয়েই কাল হলো সাকিব আল হাসানের। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেলেন। তখন মাটিতে লেগে বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে আঘাত পান। যন্ত্রণায় মাঠেই পড়ে রইলেন অনেকটা সময়। মাথা নিচু করে শুয়ে রইলেন। অনেকক্ষন পর মাথা তুললেন। পাশে দৌড়ে গেলেন মোস্তাফিজুর রহমান। তারপর সবাই। গিয়ে বুঝতে পারলেন বড় আঘাতই পেয়েছেন সাকিব। মাথায় হাত বাংলাদেশ দলের। তখনো তাঁর ৫ ওভার বাকি। আর ব্যাটিংয়ে তো শীর্ষে বড় নির্ভরতা। এরপরও অল আউট করা গেল লঙ্কানদের। কিন্তু ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের জন্য প্রতীকী চিত্র হয়ে রইলো যেন সাকিবের ওই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকার ছবিটিই।
২২২ রানের মাঝারী লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ধীর গতিতে শুরু করেছিল বাংলাদেশ। প্রথম রানটি আসে ৯ বল পর আর প্রথম বাউন্ডারি পঞ্চম ওভারে। ৫ ওভারে দলের রান মাত্র ১১। রানের গতিতে বাড়াতেই কিনা পরের ওভারে একটু খোলস ভাঙতে চেয়েছিলেন তামিম। দ্বিতীয় বলে জীবন পেলেন। তবে পরের বলে রক্ষা পাননি। মিস হিটে দুশমন্ত চামিরাকে উইকেট উপহার দিয়ে সাজঘরে ফেরেন। ১৮ বলে ৩ রান! এরপর রান আউটে কাটা যান টুর্নামেন্টে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামা মোহাম্মদ মিঠুন (১০)। ১৭ রানে দুই ওপেনারকে হারিয়ে বড় চাপে বাংলাদেশ। সে চাপ আরও বাড়িয়ে তোলেন সাকিবের জায়গায় তিন নম্বরে আবার সুযোগ পেয়ে সাব্বির রহমান (২)। দলীয় ২২ রানে বিলাসী শট খেলতে গিয়ে আউট হন তিনিও। টপ অর্ডারের সেরা ৩ উইকেট হারিয়ে দিশেহারা অবস্থা তখন টাইগারদের।
এরপর মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে চাপ সামলে নেওয়ার লড়াইয়ে নেমেছিলেন দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহীম। ৫৮ রানের জুটিতে লড়াইয়ের আভাসও দিয়েছিলেন। মাঝে অবশ্য দুই ব্যাটসম্যানই বেঁচে গেছেন আউট থেকে। শ্রীলঙ্কার নেওয়া রিভিউ থেকে বাঁচলেন মাহমুদউল্লাহ। এরপর রিভিউ নিয়ে আউট থেকে বাঁচলেন মুশফিক। কিন্তু খুব একটা লাভ হয়নি তাতে। উইকেট বিলিয়ে দেওয়ার জন্য যেন তিনি উঠেপড়ে লেগেছিলেন। আউট হলেন থারাঙ্গার হাতে সহজ ক্যাচ দিয়ে।
এরপর মেহেদী হাসান মিরাজও (৫) আউট লঙ্কানদের ক্যাচিং অনুশীলন করিয়ে। লেজ বের হওয়ার আগে টাইগারদের আশা হয়ে ছিলেন সাইফ উদ্দিন (৮)। কিন্তু তাকে আউট হতে হয় মাহমুদউল্লার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির খেসারত দিতে গিয়ে নিজের উইকেট বিসর্জন দেন তিনি। এরপর লেজের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় কি? পারেননি মাশরাফি (৫)। পারেননি রুবেলও (০)। হতাশার গল্প লিখে সাজঘরমুখী হয়েছেন, হার তখন নিশ্চিত। দিনের শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে মাহমুদউল্লার বিদায়েই নিশ্চিত হয় ৭৯ রানের বিশাল হারটি। ৫৩ বল বাকি থাকতেই ১৪২ রানে অল আউট।
পুরো ম্যাচে একাই বুক চিতিয়ে লড়াই করে গেছেন মাহমুদউল্লা। ২০১৪ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষেও শেষ ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। যন্ত্রণার কাঁটাটা তার চেয়ে কে বেশি বোঝে? চেয়েছিলেন এদিন দারুণ কিছু করতে। কিন্তু হলো আর কই? সঙ্গীদের সাজঘরের ফেরার তাড়ায় বৃথা যায় তার ৭৬ রানের ইনিংস। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২২ রান আসে মুশফিকুরের ব্যাট থেকে। এ দুই ব্যাটসম্যান ছাড়া দুই অঙ্কের কোটা ছুঁতে পেরেছেন কেবল মিঠুনই। অভিষেক ম্যাচ খেলতে নেমেই হ্যাটট্রিক করেছেন পেসার শিহান মাদুশানকা। ২৬ রানের খরচায় ৩টি উইকেট তার। ২টি করে উইকেট দুশমন্তচামিরা ও আকিলা ধনঞ্জয়ের।
আগে ব্যাট করতে নেমে থারাঙ্গা আউট হওয়ার পর টাইগারদের উপর সে অর্থে চড়াও হতে পারেননি আর কোন ব্যাটসম্যান। চান্দিমাল ৪৫ রানের ইনিংস খেলে রুবেল হোসেনের বলে বোল্ড হন। এরপর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট তুলে লঙ্কানদের রানের গতিতে লাগামটা আরো শক্তভাবে টেনে রাখেন বোলাররা। ফলে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ২২১ রানের বেশি করতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
শ্রীলঙ্কা : ২২১ (গুনাথিলাকা ৬, থারাঙ্গা ৫৬, মেন্ডিস ২৮, ডিকভেলা ৪২, চান্দিমাল ৪৫, থিসারা ২, গুনারাতেœ ৬, ধনঞ্জয়া ১৭, মাদুসানকা ৭, লাকমাল ২, ১*; মিরাজ ১/৫৩, মাশরাফি ১/৩৫, মোস্তাাফিজ ২/২৯, সাইফ উদ্দিন ১/১৫, সাকিব ০/২০, রুবেল ৪/৪৬)।
বাংলাদেশ : ১৪২ (তামিম ৩, মিঠুন ১০, সাব্বির ২, মুশফিক ২২, মাহমুদউল্লা ৭৬, মিরাজ ৫, সাইফ উদ্দিন ৮, মাশরাফি ৫, রুবেল ০, মোস্তাফিজ ০*; লাকমাল ০/২৯, চামিরা ২/১৭, থিসারা ০/৩১, মাদুসানকা ৩/২৬, ধনঞ্জয়া ২/৩০, গুনাথিলাকা ০/৪।)
ফলাফল : শ্রীলঙ্কা ৭৯ রানে জয়ী।
ম্যান অব দ্যা ম্যাচ : উপুল থারাঙ্গা।
ম্যান অব দ্যা টুর্নামেন্ট : থিসারা পেরেরা।
আজকের বাজার: সালি / ৩১ জানুয়ারি ২০১৮