অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যাংকিং খাতের অল্টারনেটিভ ডেলিভারি চ্যানেল ডিজিটাইজেশন জরুরি

সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও মনোযোগে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ চলছে। এই কর্মযজ্ঞে ব্যাংকিং সেক্টর ডিজিটাইজেশন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জে নিজের সবটুকু সামর্থ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন ফরিদপুরের সন্তান যশোদা জীবন দেবনাথ। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টেকনো মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। দেশের ব্যাংকিং খাতের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা, নিজের জীবনের চমকপ্রদ ঘটনা প্রবাহসহ নানা বিষয়ে আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন, এবি টিভির সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। তাঁর সঙ্গে কথপোকথনের চুম্বক অংশ তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো

ব্যাংকিং খাতের লেনদেন ব্যবস্থার সার্বিক অবস্থা এখন কেমন? এ ব্যাপারে বলতে হয়, বাংলাদেশে এখন ডিজিটালাইজেশনের বড় ধরনের কাজ হচ্ছে । এর জন্য আমি ধন্যবাদ দিতে চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ধন্যবাদ দিতে চাই প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কেও যিনি বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এই ডিজিটালাইজেশনের এই কর্মযজ্ঞে আমি ব্যাংকিং খাতে কাজ করছি। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে এখনও অনেক সীমাবদ্ধতা কাজ করছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ব্রাঞ্চভিত্তিক সমস্যা। আমরা জানি বাংলাদেশ ঘনবসতির একটা দেশ। দেশের বেশিরভাগ মানুষকে যদি ব্যাংকিং সেক্টরের আওতায় নিয়ে আসা যায় তাহলে ব্যাংকিং খাত অনেক এগিয়ে যাবে। একটি নতুন শাখা চালু করতে গেলে যেকোনো ব্যাংককে বেশ টাকা খরচ করতে হয়। সেই ব্রাঞ্চে যদি ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করে এটিএম বুথ, কার্ড ও লেনদেন ব্যবস্থা যদি জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া যেত তাহলে দেশ অনেকটাই এগিয়ে যেত। এর মধ্য দিয়ে দেশ সত্যিকার অর্থে ডিজিটালাইজেশনের সুফল পেতে পারত। এখন ইউনিয়ন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে আমাদের ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থা। কিন্ত ব্যাংকিং সেবাটা ইউনিয়ন পর্যায়ে যায়নি। যদি উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে এই সেবা নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের এই সেবা চলে যাবে। এখনও দেশের পঞ্চাশভাগ মানুষ ব্যাংকিং সেবা ব্যাবহার করছে না। তারা যদি এ সেবার আওতায় আসে তাহলে তারা যেমন উপকৃত হবে পাশাপাশি সরকারও এখান থেকে বড় অংকের রাজস্ব পাবে। তারা যদি ব্যাংক একাউন্ট করতে যায় তাহলে তাদের একটা টিআইএন লাগবে, তখন তাকে রিটার্ণ জমা দিতে হবে। আর তখন সরকার তার প্রয়োজন অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে পারবে। এ জন্য এ সেবাকে গ্রামীণ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। আর তখনই বাকি অর্ধেক জনগণকে এ সেক্টরের সেবা দিয়ে সরকারের ভালো রাজস্ব সংগ্রহ সম্ভব হবে।

শাখা ব্যবস্থায় অনেক সমস্যা আছে এবং তা ব্যয়বহুল। আর তাই ব্যাংকিং সেবাকে যদি তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হয়, সহজলভ্য করতে হয় তবে বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। এটিএম ব্যবস্থা হতে পারে এর চমৎকার একটি মাধ্যম। এ ব্যবস্থায় আপনি ব্যাংকিং সেবাকে একেবারে জনগণের দরজায় পৌঁছে দিতে পারবেন। প্রতিদিন ব্যাংকগুলো সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত তাদের সেবা দিচ্ছে। কিন্ত এটিএম ব্যবস্থায় ২৪ ঘন্টা সেবা দেয়া সম্ভব। সাধারণ মানুষকে যদি ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে হয় তা হলে অবশ্যই ডিজিটাল মাধ্যমে আসতে হবে। এবং ব্যাংকিং সেবার সবরকম সুযোগ সুবিধা তাকে দিতে হবে। মোট জনগণের অনুপাতে ১০০০ এটিএম কিছুই না। শতকরা ১০ ভাগও না। আমাদের দেশে এক লাখ মানুষের জন্য মাত্র একটা এটিএম বুথ থাকে । তাও ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারে না। অন্যদিকে পাশের রাষ্ট্র ভারতে সে অনুপাতে ১৫ টি এটিএম বুথ রয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে এই সংখ্যা ১৫০। তাহলে দেখুন, এদিক থেকে আমরা কতটা পিছিয়ে আছি। তাই এ সেবাকে সার্বিকভাবে নিশ্চিত করতে হলে ব্যাংগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি অবশ্যই ডিজিটাল সিস্টেমের আওতায় আসতে হবে। আশার কথা এরইমধ্যে অনেকেই এগিয়ে এসেছে, উদাহরণ হিসেবে ডাচবাংলা ব্যাংকের কথা বলা যায়। ২০০৭ সাল থেকে তারা এটিএম সেবা চালু করে। তখন তাদের একাউন্ট ছিল মাত্র ৫৪০০০। যা ডিজিটাল সিস্টেমে আসার পর দাড়িয়েছে ৫.৪ মিলিয়ন। মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট ৩ মিলিয়ন। এটা সম্ভব হয়েছে ডিজিটালাইজ করার মাধ্যমে। প্রতিদিন তাদের একটি এটিএম থেকে ১৬০টি একাউন্টে টাকা লেনদেন হয়। সারা দেশে তাদের মোট ৫০০০ এটিএম বুথ আছে। প্রতিটি এটিএম বুথে যদি ১৬০টি একাউন্টে লেনদেন হয় তাহলে প্রতিদিন হাফ মিলিয়ন লেনদেন হয় যা তাদের সারা দেশের সব ব্রাঞ্চের মাধ্যমে দেয়া কখনই সম্ভব হয় না।

অন্যদিকে রয়েছে ব্রাক ব্যাংক, যারা বর্তমানে এটিএম সেবার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে। সারা দেশে তাদের ৫০০ এটিএম বুথ রয়েছে। এই ব্যাংকের প্রতিটি এটিএম বুথে ১৫০টি একাউন্টের লেনদেন হয়। এখন তো ন্যাশন্যাল পেমেন্ট সুইচ চালু হয়েছে। এ ব্যবস্থায় প্রতিটি ব্যাংকের এটিএম কার্ড দিয়ে অন্যান্য ব্যাংকের এটিএম ব্যবহার করে লেনদেন করা যায়।

আমি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি তারা প্রায় সবাই এ ব্যাপারে আগ্রহী । সবশেষে জনতা ব্যাংক আগ্রহ দেখিয়েছে। সারা দেশে প্রত্যন্ত এলাকায় তাদের শাখা রয়েছে । যেখানে এ সেবা খুব সহজেই তারা পৌঁছে দিতে পারে। ৯৫৬টি শাখায় একটা করে হলেও ৯০০ এটিএম বুথ তাদের দরকার হবে। গ্রাম অঞ্চলের ব্রাঞ্চগুলো তো বিকেল ৫ টার পর বন্ধ। তখন সেখানকার মানুষ কী করবে? একটা এটিএম হলে সহজেই তাদের প্রয়োজন মিটাতে পারতেন। সুতরাং শহরে যেভাবে একজন নাগরিক এ সুবিধা পাবে সেই একই সুবিধা তখন প্রত্যন্ত এলাকার জনগণও পাবে । ফলে দেশ তো এমনিতেই বদলে যাবে।

তাহলে সার্বিক ডিজিটালাইজেশন হচ্ছেনা কেন?
হচ্ছে তো, ধীরে ধীরে হচ্ছে । ব্যাংকগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। তারা মনে করে এতে করে তাদের ব্যয় বাড়বে। কিন্ত আয় করতে গেলে আপনাকে ইনভেস্ট করতে হবে। এটাকে ইনভেস্টমেন্টের অংশ হিসেবে ধরে নিতে হবে । উদাহরণ দিচ্ছি, ডাচ বাংলা ব্যাংক এখানে ৫০০ কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছে। সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে বলে তাদের ৫.৪ মিলিয়ন একাউন্ট। এখন একজন গ্রাহক যদি তার একাউন্টে ১০,০০০ টাকা করেও রাখেন তাহলে হিসাব করে দেখেন কত হয়? আরেকটা উদাহরণ দিই, আমি সিটি ব্যাংককে অনুরোধ করে আমার গ্রামের বাজারে একটা এটিএম বুথ বসাই । এখন সেখানে প্রায় ৫,০০০ একাউন্ট রয়েছে। যারা প্রয়োজনের সময় এটিএমের মাধ্যমে টাকা তুলতে পারে। তাহলে বোঝা যচ্ছে, গ্রাহকদের আগ্রহ রয়েছে এ ব্যাপারে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতিটি ব্যাংকের চেক বইয়ের সাইজ একই রকম করা হয়েছে। একসময় এক ব্যাংক তেকে টাকা অন্য ব্যাংকে ট্রান্সফার করতে গেলে ৩ দিন সময় লাগতো এখন আর তার দরকার হয় না। টাকা পোস্টিং দিলেই হলো আপনি একই সময়ে টাকার লেনদেন করতে পারছেন। আপনি টাকা যত তাড়াতাড়ি রোলিং করতে পারবেন ততই এর এডভান্টেজ । আর তাই দেশের প্রায় সব ব্যাংক ইতিমধ্যে এই সেবা চালু করেছে। শুধু প্রয়োজন সারা দেশে এ সেবা ছড়িয়ে দেওয়া। যদি তাই হয় তবে ব্যাংকগুলোকে এখন ডিজিটালাইজড হতে হবে। এতেই ডিজিটাল বাংলাদেশের সত্যিকারের রূপ ফুটে উঠবে।

এনবিআর এখন রাজস্ব আদায়ের জন্য অনেক চেষ্টা করছে। কিন্ত দেশের অর্ধেক মানুষ তা দিচ্ছে না। তাদের সে ভাবে ধরাও যাচ্ছে না। কারণ মানুষের টিআইএন, টিন বা ট্যাক্স আইডিন্টিফিকেশন নম্বর নেই । তাদের ব্যাংক একাউন্ট নেই । তাহলে কি করে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ হবে? এর জন্য তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাংকিং সেবা ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে।

ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশনের প্রতিবন্ধকতা
ব্যাংকগুলো এ ধরনের সেবাকে তাদের বাড়তি খরচ বলে মনে করে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এরকম মনমানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাদের আইটি খাতের সেবার বিষয়টিকে বিনিয়োগের আওতায় আনতে হবে। বেশিরভাগ ব্যাংকগুলো মনে করে যে এই খাতে এতো টাকা লগ্নি করা যাবে না। এমন ধারণার পরিবর্তন দরকার। একটা এটিএম বুথ স্থাপন করতে একটা ব্যাংক কত খরচ পড়বে? একটা এটিএম বুথ বসাতে মোট খরচ পড়বে ১০ লাখ টাকা। টাকা জমা দেয়া বা উঠাতে কিছু অলিখিত খরচ থাকে। ব্যাংকের একটি ব্রাঞ্চ থেকে টাকা তোলার সময় খরচ পড়বে ১২৫ টাকার কাছাকাছি । কিন্ত একটা এটিএম বুথ থেকে সে চার্জ আসে মাত্র ২০ টাকা। এখন ব্যাংকিং সেবার ধরণধারণ আর আগের মতো নাই, সহজ ও দ্রুততার সঙ্গে কাজ হচ্ছে। একটা ব্যাংক যত সহজে তার সেবার পরিমাণ বাড়াবে, গ্রাহকরাও তত দ্রুত তাদের কাজ করতে পারবে ফলে ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যাও বাড়বে। তাই যদি হয় এটা ব্যাংকের জন্য লাভ না লস?

ব্যাংকের ব্রাঞ্চের সংখ্যার অনুপাতে কতটা এটিএম বুথ প্রয়োজন
যদি সঠিকভাবে ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা দিতে চান, তাহলে সারাদেশে সব মিলিয়ে প্রায় ৫০,০০০ এটিএম বুথের প্রয়োজন। সেখানে আমাদের এখন আছে ১০০০০ বুথ। তুলনায় পাশের শহর কলকাতাতেই আছে ৫০,০০০ এটিএম বুথ। অথচ সারা কলকাতার আয়তন বাংলাদেশের অনেক কম।

অর্থনীতির জন্য সম্ভাবনাময় একটি খাত
যখনই একজন গ্রাহক ব্যাংকে একটি একাউন্ট খুলে টাকা লেনদেন করবেন সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জাতীয় অর্থনীতি-চক্রে যুক্ত হয়ে গেলেন। সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে বলতে চাই , দেশকে সত্যিকার অর্থে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে হলে ডিজিটালাইজেশনের বিকল্প নেই । আপনাকে এখন আর কেবল শহরে, বিভাগে বা জেলার গ্রাহকের উপর নির্ভর করলে চলবে না। আপনাকে যেতে হবে গ্রাম পর্যায়ে, কৃষক শ্রমিকের কাছে। সেখানে সহজ সেবা দিয়ে তাদের আকৃষ্ট করতে হবে। আর সেখানে পৌঁছতে হলে বর্তমান সময়ের চাহিদা ডিজিটাল সেবা লাগবেই।

টাকা তোলা ও জমা দেয়ার সুযোগ
আমাদের সিস্টেমে ডিপোজিটেরও সুবিধা রয়েছে। আরেকটা ব্যাপার, আমাদের দেশে টাকা স্ট্যাপল করা হয়। বিশে^র কোনও দেশে এমনটা করা হয় না। এর ফলে টাকা অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া বিভিন্নভাবে টাকা ময়লা হয়ে ছিঁড়ে যায়, নষ্ট হয়। সেটা আবার দ্রুত বদল করা হয় না। যার ফলে অনেকসময় মেশিনও রিড করতে পারে ন্ া। এটিএমের জন্য আপনাকে অবশ্যই ঝকঝকে নতুন নোট দেয়া প্রয়োজন। না হলে সমস্যা থেকেই যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগ নিতে হবে এ সমস্যার সমাধানে । স্ট্যাপল করতে হবে এমন কোনো ধরা বাঁধা নিয়ম নেই কিন্তু তার পরও আমরা করে এটা যাচ্ছি। আসলে নিয়মটা হচ্ছে ব্যান্ডিং করা । তাহলে টাকার মান দীর্ঘদিন ভালো থাকে। আইন আছে, নিয়ম আছে কিন্ত কোনও ব্যাংকই তা মানে না। নির্দেশনা থাকলেও মানা হচ্ছে না নিয়ম। ব্রাঞ্চে আসার সঙ্গে সঙ্গেই টাকার বান্ডিলে স্ট্যাপল করা হচ্ছে। ১০-১৫ বছরের পুরোনো নোটসহ এটা করা হচ্ছে। ফলে খোলার সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ওইসব টাকা। মেশিন পুরোনো টাকা নিতে পারে না। সরকারকেই নতুন টাকার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এখনকার নতুন ব্যান্ডের টাকা আর স্ট্যাপল করা টাকা দেখেন। রাত দিন পার্থক্য। অবশ্যই মেশিনের জন্য কোয়ালিটি টাকার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

সরকার কী করবে
সরকারকেই মূল উদ্যোগ নিতে হবে। বাজারে যত খারাপ, ছেঁড়া, নোংরা নোট আছে তা তুলে নিয়ে নতুন নোট ছাড়তে হবে। এর জন্য হয়তো তাদের বাড়তি কিছু খরচ হবে। কিন্ত কোয়ালিটি আর সঠিক সেবা দেওয়ার জন্য এটা মেনে নিতেই হবে। প্রতি ১০ বছর পর পর পুরোনো নোটগুলো তুলে নিয়ে নতুন টাকা বাজারে নিয়ে আসতে হবে । তাইলেই টাকার মান ভালো থাকবে । আর তা হলে ডিজিটেল সেবার মানও এগিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে আপনি যদি সম্পূর্ণ মানসম্পন্ন সেবা চান তাইলে কারেন্সির মান নিশ্চিত করতে হবে।

টেকনো মিডিয়া কী কাজ করছে
আমরা ব্যাংকিং সেবার এই ধারার জন্য টেকনিক্যাল সব সুবিধা দিয়ে যাচ্ছি। যেমন এটিএম, প্লাস্টিক কার্ড, ভিসা কার্ড ইত্যাদি। সারাদেশে প্রায়৭০ ভাগ এটিএম বুথে আমাদের শেয়ার রয়েছে। তাছাড়া অটোম্যাটেড চেক বইও আমরা দিচ্ছি। আজ পর্যন্ত এ সব নিয়ে কোনোরকম অভিযোগ আসেনি। সুনামের সঙ্গে আমরা আমাদের সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছি। আমি মনে করি দেশের এক মিলিয়ন গ্রাহকের মধ্য থেকে ৭,০০০,০০ গ্রাহক প্রতিদিন এই সেবা নিচ্ছে।

বিপরীত কোনো অভিজ্ঞতার কথা বলবেন? আসলে শুরুর সময় কাজ করতে গিয়ে যা দেখলাম তার অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো না। তবে এখন অবস্থা অনেকটা এগিয়েছে। মূলত: রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর কর্তারা ডিজিটালাইজেশনের বিষয়ে আগ্রহী নন, তারা এটি করতে চান না। আবার করতে গেলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ধীর গতিতে এগোন। তারা ঠিকমতো এগিয়ে আসছেন না। সোনালী ব্যাংক, রূপালি ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংকের ২০ থেকে ৩০টা করে এটিএম মেশিন আছে। যাদের ব্রাঞ্চের সংখ্যা ১২০০, কোনো ব্যাংকের ৯০০, কোনো ব্যাংকের ৮০০। সে তুলনায় তাদের এটিএম সংখ্যা কিন্তু কিছুই না। এ সব ব্যাংকের সঙ্গে অফিসটাইমের বাইরে কোনোরকম লেনদেন বা কিছু করতে পারবেন না। কিন্ত তাদের এটিএম থাকলে ২৪ ঘন্টাই সার্ভিস পাওয়া যেতো। তারা যদি সেটা না করে তাহলে কী করে হবে? অথচ আধুনিক চিন্তা থেকে ডিজিটালাইজ করার জন্য ডাচবাংলা ব্যাংক ইনভেস্ট করেছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। যা অন্য কোনও ব্যাংকই ইনভেস্ট করছে না। অন্য ব্যাংকগুলো ডাচবাংলার মতো এই সুবিধা দিতে পারছে না।

তবে মনে রাখতে হবে, এ ব্যবস্থার সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও রয়েছে। যেমন কার্ড জালিয়াতি। এই সমস্যা বিশ্বব্যাপি। টেকনোলজির ভালো দিক যেমন আছে তেমনি খারাপ দিকও রয়েছে। যারা ফ্রড তারা তো সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তাই বলে আপনাকে চুপ করে বসে থাকলে হবে না। আপনাকেও সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। দিন দিন টেকনোলজি পরিবর্তন হচ্ছে তার সঙ্গে আপনার পদ্ধতিরও পরিবর্তন করতে হবে নিরাপত্তার জন্য। উন্নত বিশ্বের মানুষ তো তাই করছে। আমরা কেন বসে থাকবো? এর জন্য এন্টি স্কিমিং প্রটেকশন নিতে হবে। যেহেতু এটা আইটি নির্ভর সেহেতু প্রতিনিয়ত হ্যাকার সৃষ্টি হচ্ছে। তারা সেই সিস্টেমকে হ্যাক করতে পারে। তা ঠেকাতে প্রটকশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রতিটি ব্যাংকে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস রাখতে হবে। শুধু রাখলে চলবে না প্রতিনিয়ত এর আপডেট দিতে হবে।

সতর্কতা প্রয়োজন
ইতিমধ্যে সার্কুলার জারি করা হয়েছে যে প্রত্যেকটি ব্যাংকে ইএমবি কার্ড চালু করতে হবে। কার্ডের মধ্যে চিপ থাকতে হবে। এতে দুই ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে । প্রথমত পিন সিস্টেম ও চিপ সিস্টেম; যাতে সব ধরনের তথ্য থাকবে। কিন্ত সব কিছুর পর সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে তার কার্ড সম্পর্কে, কার্ডের পিন নম্বর সম্পর্কে। না হলে অন্য কারো কাছে আপনার কার্ড চলে গেলে সে যদি পিন নম্বরও জেনে যায় তখন সে আপনার টাকা উঠিয়ে নিতে পারে। এটা দিয়ে এটিএম থেকে, ব্যাংক থেকে, ক্রেডিট কার্ড হিসেবে যে কোন দেশে ব্যবাবহার করা যাবে। তবে অনেক ব্যাংক এখনো ইএমবি করেনি । আমি বলবো তারা ঝুঁকির মধ্যে আছে। ইএমবি মেন্ডেটরি। সবাইকে এই সিস্টেমের মধ্যে আসতে হবে।

ব্যবসায়ী হিসেবে আমার শুরুর কথা
খুবই ড্রামাটিক, কষ্টের শুরু আমার। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাউন্টিংয়ে অনার্স ও মাস্টার্স করে আইবিএ থেকে এমবিএ করেছি । তার পর কয়েকটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। সরকারের কয়েকটা প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে অনেক লস করেছি। একসময় ২০০৭ থেকে ব্যাংকিং সেক্টরে কাজ শুরু করি। আমার সফলতা যেমন নাটকীয়, শুরুটাও তাই। ২০০৭’র শেষের দিকে এমন অবস্থা হয় তখন আমার কাছে কোনোরকম টাকা ছিল না।

একদিন গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের পুকুর পারে বসে আছি আমি । আমার হাতে ৫০০ টাকার দুইটা নোট। এই টাকায় আমার পরিবারের জন্য বাজার করে কিভাবে সংসার চালাব? অথৈ সাগরে একটা নৌকায় চড়ার মতো বিপদে পড়ে মানুষ, তখন সে বাঁচার জন্য মনের অন্তস্থল থেকে সৃষ্টিকর্তা বা সুপার পাওয়ারের কাছে প্রার্থনা করে। বিপদে পড়লে যা হয়। পকেটে টাকা না থাকলে বন্ধুরাও দূরে চলে যায়। তো আমি সেই সময় এমন একটা দীনদশায় আসলাম যে কি বলবো?

এমন অবস্থায় এক অমাবস্যার রাতে পুকুর পারের সেই ঘাটে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলাম। মন থেকে কাঁদতে কাঁদতে প্রার্থনা করলাম। কেউ নেই সেখানে। এমন সময় এক পাগল এসে বললো ‘এই আমাক কিছু দে’। তখনই আমি আমার পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে তাকে ৫০০ টাকার দু’টি নোটই দিয়ে দিলাম। সে আমাকে ময়লা একটা ১০ টাকার নোট ও সাদা পাথর দিয়ে নিমিষেই মিলিয়ে গেল। অবিশ্বাস্য এই কাহিনী এখনও কেউ বিশ্বাসই করতে পারে না।

পরে আমি শাহবাগ হয়ে রাতের অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে আসছিলাম। এমন সময় পেছন থেকে কে যেন নাম ধরে ডাকছে। অমাবস্যার রাত, রাস্তায় সোডিয়াম আলো। অন্ধকারে হেঁটে যাচ্ছি, সে আমাকে সামনে থেকে দেখছে না। পেছন থেকেই ডাকছে। একসময় কাছে এসে সে আমাকে ৪ টা ৫০০ টাকার নোটের বান্ডিল দিয়ে বললো ‘আমি চিটাগাং যাবো, টাকাগুলো তোমার কাছে রাখো’। বলেই হাতে টাকা দিয়ে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মৎস্য ভবনের দিকে চলে গেল। তার পরিচয় কী? সে কে তাও বলার সুযোগ দিল না। তার পর আমি বাসায় এলাম।
তখন ডায়ালআপ ইন্টারনেটের যুগ। আমি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মেইল চেক করতে গিয়ে দেখি জাঙ্ক ফাইলে এস সি আর কর্পোরেশন, আমেরিকা থেকে একটা মেইল এসেছে। সেখানে তারা জানায়, এটিএমের রোল পেপারের বিজনেস করে তারা। আমি তাদের হয়ে কাজ করলে লাভের অর্ধেক তাদের, অর্ধেক আমার। তখন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের এমন রোলের প্রয়োজন ছিলো । আমাকে তাদের হয়ে সেখানে ডিল করতে বলা হলো। আমি সেই কপি প্রিন্ট দিয়ে চলে গেলাম স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে। তাদের সেই প্রিন্ট করা মেইল দেখানোর পর তাদের অনেক টাকা সেইভ হচ্ছে দেখে তারা খুশি হয়ে আমার সাথে কাজ করতে আগ্রহী হলো।

তখন আমার কাছে টাকা নেই তারাও ভেন্ডর খুঁজছিলোা। টাকা নেই জেনে ব্যাংক কর্তা বললেন, কোনো সমস্যা নেই। যেহেতু আমাদের অনেক টাকা সেইভ হচ্ছে সেহেতু আপনাকে ওয়ার্ক অর্ডারের অগ্রিম টাকা দিতে সমস্যা নেই। তখন তিনি পণ্যের মোট মূল্যের সত্তরভাগ টাকা একঘন্টার মধ্যে অগ্রিম দিয়ে দিলেন। যার পরিমাণ ছিল ৮৭ লাখ টাকা। সেই থেকে আমার ব্যাংকিং সেক্টরে কাজের শুরু। সফলতারও শুরু।

অর্জন
২০০৭ থেকে ২০১৭। এখন আমার প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২০০০ লোকের কর্ম সংস্থান হয়েছে। এখন আমি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, সারা দেশে সবাই আমাকে এখন চেনে। আমি ডিজিটালাইজেশনের অবদানের জন্য আমেরিকাতে তিন তিনবার সম্মান সূচক পুরষ্কার পেয়েছি। তিনবার আমি দেশের সি আই পি হয়েছি। আমার এক ছেলে, এক মেয়ে । তারা এখন পড়ালেখা করছে।

যশোদা জীবন দেবনাথ
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
টেকনো মিডিয়া লিমিটেড