অর্থনৈতিক উন্নয়নে পুঁজিবাজারকে কাজে লাগানো যায়নিঃ মির্জা আজিজ

গত দুই দশকে দেশের অর্থনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। টানা উচ্চ প্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের অর্থনীতি। ২০০২-২০০৭ পর্যন্ত সময়ে এশিয়ায় প্রবৃদ্ধির হারে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল আটটি দেশ। ২০০৮-২০১৩ সময়ে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকা দেশের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ছয়ে। ২০১৩-২০১৫ সময়ে মাত্র তিনটি দেশ প্রবৃদ্ধির হারে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল।

দূর্ভাগ্য, বাংলাদেশের অর্থনীতির এই অসাধারণ অর্জনে পুঁজিবাজার তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। এই বাজারকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজে লাগাতে পারিনি আমরা। এটি করতে পারলে প্রবৃদ্ধির হার আরও বেশি হতো।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড.এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম এসব কথা বলেছেন। সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আইডিএলসি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রথম মিউচুয়াল ফান্ড আইডিএলসি ব্যালেন্সড ফান্ডের রোড শো’তে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে দেশের পুঁজিবাজার বাড়েনি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ওপর হলেও পুঁজিবাজারে প্রবৃদ্ধির হার ৩ শতাংশের বেশি নয়। এখানে পুঁজিবাজার প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারেনি। আর তাতে আস্থার সংকট পরিলক্ষিত হয়েছে।
মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে এখনও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বড় ভূমিকা পালন করে। সেই তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা একটু পিছিয়ে। তবে নিরাপদ পোর্টফোলিও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারে পোর্টফোলিও ম্যানেজাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

একটি নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য কোম্পানির মৌলভিত্তি, পরিচালনা পর্ষদ, প্রবৃদ্ধি, ভবিষ্যৎ, অ্যাকাউন্টস, ব্যবসায়ের ধরনসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিতে হয়। এসব কিছু ঠিক থাকলে সেই কোম্পানিতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, আইডিএলসিতে পেশাদারিত্ব, দক্ষ জনবল ও সুশাসন আছে। তাই এদের মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োকারীরা আস্থার সাথে বিনিয়োগ করতে পারবেন এমন আশা করা যায়।

অনুষ্ঠানে ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় বিভাগের সাবেক ডিন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মুসা বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারে নেগেটিভ ইক্যুইটি একটা বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এগুলোর সমাধান তো দূরের কথা, খোঁজখবর নেওয়ারও যেন কেউ নেই।

অনুষ্ঠানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, নানা কারণে আমাদের পুঁজিবাজারে মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর ওপর বিনিয়োগকারীরা আস্থা রাখতে পারছে না। তিনি বলেন, কয়েক ভারতের পুঁজিবাজার অনেক এগিয়ে গেছে। সেখানে প্রচুর পরিমাণে মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও পোর্টফোলিও বিনিয়োগ হয়। তাদের ফান্ড ম্যানেজারদের কঠোর পরিশ্রম থাকে। ভারতের মিউচুয়াল ফান্ড শিল্প বিকশিত বলে তাদের বাজার অনেক স্থিতিশীল। রকিবুর রহমান বলেন, স্বল্প মেয়াদে আমানত নিয়ে ব্যাংকগুলো দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দিচ্ছে। এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বড় বড় ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ খেলাপী হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, শুধু সরকারের উদ্যোগ আর ব্যাংক ঋণে উন্নয়ন ও শিল্পায়ন হবে না। টেকসই উন্নয়নের জন্য পুঁজিবাজারকে কাজে লাগাতে হবে। রকিবুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে মাত্র ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ আয় করমুক্ত। অথচ ভারতে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ-আয়ে কোনো কর দিতে হয় না। পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে তারা এই প্রণোদনা দিয়ে থাকে। আমাদের এখানেও প্রণোদনার হার বাড়াতে হবে।

আইডিএলসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আরিফ খান বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অর্থনীতিগুলোর একটি। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে পুঁজিবাজারকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। তিনি বলেন, বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যে দেশের পুঁজিবাজার যত বড়, সেই দেশের অর্থনীতিও তত বড়। আরিফ খান বলেন, আমাদের দেশে মিউচ্যুয়াল ফান্ডকে কেউ বিশ্বাস করে না। যার জন্যে বাজারমূলধনে এর অবদান মাত্র ৪ শতাংশ। অন্যান্য দেশে এর হার বেশি হওয়ার কারণে সে দেশের পুঁজিবাজার অনেক শক্তিশালী।তিনি বলেন, অনেক সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি ১০০ কোটি টাকার ফান্ড গঠন করতে গিয়ে তিন কোটি টাকা খরচ দেখিয়ে দুই কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছে। এতে শুরুতেই ক্ষতির মুখে পড়েছেন ওই ফান্ডের বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু আইডিএলসি স্বল্পতম ব্যয়ে ফান্ড গঠন করেছে। দেশের পুঁজিবাজারের সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি বলেন, অর্থনীতিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। মাথাপিছু আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। তাই দেশের পুঁজিবাজারও নিশ্চিতভাবেই বড় হবে।

বিনিয়োগের বিকল্প খাতগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ায় পুঁজিবাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, প্রায় ৪০ বছর ধরে বিনিয়োগের একটি নিরাপদ ক্ষেত্র ছিল জমি। এ সময়ে প্রতি বছরই জমির দাম বেড়েছে। তাই নিশ্চিত লাভের কথা চিন্তা করে বেশিরভাগ মানুষ বিনিয়োগের জন্য জমিকেই বেছে নিতেন। কিন্তু এটি যে চিরন্তন নয়, তা প্রমাণ হয়ে গেছে। গত তিন বছরে জমির দাম প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। টানা ২৫ বছরের উর্ধগতির পর স্বর্ণের দামও প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ব্যাংকে মেয়াদী আমানতের সুদের হার এখন ৫/৬ শতাংশের কাছাকাছি। তাই পুঁজিবাজারই হতে পারে বিনিয়োগের উপযুক্ত বিকল্প। তবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে বলে তাদের উচিত মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা।

এছাড়া অনুষ্ঠানে ডিএসই পরিচালক শাকিল রিজভী ও ভ্যানগার্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াকার এ চৌধুরী বক্তব্য রাখেন।

আইডিএলসি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজিব কুমার দে দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, পুঁজিবাজার ও আইডিএলসি ব্যালেন্স ফান্ডের উপর একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দেন।

আজকের বাজার:এলকে/ ২২ মে ২০১৭