রাজস্ব আহরণে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে ঝুঁকি মোকাবেলায় অস্ত্র ও অস্ত্র পরিচালনা প্রশিক্ষণ অথবা আলাদা একটি রেভিনিউ ফোর্স গঠনের প্রস্তাব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড,এনবিআর।
১১ অক্টোবর মঙ্গলবার বিকেলে সেগুনবাগিচায় এনবিআর সম্মেলন কক্ষে এনবিআর আয়োজিত ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিরাপত্তা বিষয়ক অংশীদারিত্বমূলক সংলাপে’ এনবিআরের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব করা হয়েছে।
সংলাপে এনবিআরের পক্ষ থেকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বলেন, এনবিআরের কর্মকর্তারা চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি নিয়ে রাষ্ট্রের জন্য রাজস্ব আহরণ করছে। বিশেষ করে কাস্টমস হাউসে কর্মকর্তাদের ওপর হামলা ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সন্ত্রাসীরা কর্মকর্তাদের অস্ত্র প্রদর্শন করে হুমকি দিয়েছেন। চোরাচালান ঠেকাতে রাজস্ব কর্মকর্তারা নিজস্ব নিরাপত্তা না থাকায় অভিযান পরিচালনা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এনবিআর অভিযান পরিচালনায় সব বাহিনীর সহায়তা পাচ্ছে। তবে প্রত্যেক বাহিনীর একটি সীমাবদ্ধতা আছে। এছাড়া সময়মত অভিযান পরিচালনায় তাৎক্ষণিক ফোর্স পেতে সমস্যা হয়। আর বিভিন্ন সময়ে হামলার কারণে কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
মইনুল খান বলেন, এনবিআর কর্মকর্তারা যেসব অভিযান পরিচালনা করে তার অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র রয়েছে। কারণ যারা চোরাচালান করে তারা অনেক শক্তিশালী। তারা চোরাচালানে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। তাদের স্বার্থ হানি হওয়ার তাদের পক্ষে যে কোনো অশুভ কাজ করা সম্ভব।
তেলের ড্রামে কোকেন আটকের ঘটনার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, চট্টগ্রামে ড্রামের ভেতর থেকে যে কোকেন আটক করা হয়েছে তাতে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। যারা এতে বিনিয়োগ করেছেন তারা নিশ্চয় বসে না থেকে অপকৌশলের আশ্রয় নেবে। এছাড়া চোরাচালানের অভিযোগে আপন জুয়েলার্সের অভিযান চালিয়ে ১৫ মণ স্বর্ণ আটক করেছে। শুল্ক ফাঁকির ৬৮টি গাড়ি আটক করা হয়েছে। এরকম অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে থাকেন এনবিআর কর্মকর্তাদের।
রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে মইনুল খান বলেন, ইউএস কাস্টমস, কানাডা কাস্টমস, অস্ট্রেলিয়া কাস্টমস কর্মকর্তারা অস্ত্র প্রশিক্ষিত ও নিজেরা অস্ত্র বহন করে। আমাদের কিন্তু কাস্টমস কর্মকর্তারা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও তা নেই।
মইনুল খান বলেন, চোরাচালান ও রাজস্ব ফাঁকি রোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে এখন যে পার্টনারশীপ রয়েছে তা জোরদার করতে পারি। অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বা কর্মকর্তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ পদের কর্মকর্তাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র সরবরাহ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অস্ত্রের লাইন্সেস দেওয়া, অভিযানের সময় অস্ত্র বহনের অনুমতি দেওয়া।
তিনি বলেন, অন্যান্য সব বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে আলাদা ফোর্স গঠন করা যেতে পারে। যার নজির বিভিন্ন দেশে রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন সম্প্রতি পুলিশের একটি ফোর্স নিয়ে অভিযান পরিচালনা করছে। সাময়িকভাবে সে ধরনের একটি ফোর্স গঠন করা যেতে পারে। স্থায়ীভাবে এনবিআরের অরগানোগ্রামে পরিবর্তন করে রেভিনিউ ফোর্স গঠন করা যেতে পারে। এসব প্রস্তাবনা এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আলোচনার মাধ্যমে এসেছে।
বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, পুলিশ বাহিনী রাজস্ব আহরণে সব সময় সহযোগিতা করেছে, ভবিষ্যতেও করে যাবে। এনবিআর চাইলে সরকারের কাছে প্রস্তাবনা দিতে পারে দুদকের মতো পুলিশের একটি ইউনিটের। তা দিতে আমরা প্রস্তুত আছি। তবে রেভিনিউ ফোর্স গঠনের ক্ষেত্রে সব বাহিনীর সমন্বয় নয় একক ফোর্স গঠন করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেন, ফায়ার সার্ভিস থেকে রাজস্ব আহরণে সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। ফায়ার সার্ভিসের কিছু কর্মকর্তা বিদেশ থেকে কেমিক্যালের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে। এনবিআর চাইলে তাদের ব্যবহার করতে পারে। তবে ফোর্স গঠনের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের মাধ্যমে করতে হবে। না হয় অভিযান পরিচালনায় সমস্যা হতে পারে।
ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার বজলুর করীম চৌধুরী বলেন, ফোর্স গঠন নয় অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও অভিযানের সময় অস্ত্র দেওয়া যেতে পারে। ফোর্স গঠনের সমস্যা অনেক। হামলা সবার ওপর হয়। যদি রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে হামলা হয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, একটি বিশেষ ফোর্স গঠনের ক্ষেত্রে চিন্তা করতে হবে- আমাদের দেশে এখনও সেই প্রেক্ষাপট তৈরি হয়নি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে। আমাদের তো সশস্ত্র ইউনিট নেই।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অতিরিক্ত মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল হাসনাত বলেন, রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তায় ঢালাওভাবে অস্ত্র সরবরাহ করা ঠিক হবে না বলে মত দেন।
তিনি বলেন, এর আগে বিষয়টি নিয়ে বিশদ পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। তবে পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ে ‘এনবিআর পুলিশ’ নামে একটি বাহিনী গঠন করা যায়।
সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপ মহাপরিচালক দিলীপ কুমার বিশ্বাস ও বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের উপ মহাপরিচালক কমল অরিন্দা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
এতে সভাপতিত্ব করেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান।
আজকের বাজার:এলকে/এলকে ১১ অক্টোবর ২০১৭