ডায়াবেটিস বাংলাদেশেতো বটেই, পৃথিবীর সকল দেশের মানুষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রোগ। উচ্চ রক্তচাপও কোটি কোটি মানুষের রোগ-চিকিৎসার তালিকার উপরের দিকে অবস্থানকারী একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। আবার, যাদের ডায়াবেটিস নেই তাদের তুলনায় যাদের ডায়াবেটিস তাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ দেখা যায় বেশি। এমন দেখা যায় পূর্ণবয়স্ক তিন জন ডায়াবেটিকের মধ্যে দুই জনের থাকে উচ্চ রক্তচাপ। ডায়াবেটিস থাকলে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকিও দ্বিগুণ। চিকিৎসা না হলে উচ্চ রক্তচাপ থেকে হতে পারে হার্ট এ্যাটাক ও স্ট্রোক।
ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে দৈহিক স্থ’লতা, নিয়মিত অতিরিক্ত চর্বি-লবনযুক্ত খাদ্য গ্রহণ, শারীরিক শ্রমহীন জীবন যাপন এবং দীর্ঘ দিনের প্রদাহ সংযুক্ত থাকতে পারে।
বস্তুত: যে ব্যক্তির ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ দুটোই আছে, ডায়াবেটিস নেই এমন লোকের তুলনায় হৃদরোগ, প্রধানত হার্ট অ্যাটাক ও রক্ত নালীর সরু হয়ে যাওয়া জনিত সমস্যা; স্ট্রোক ইত্যাদির ঝুঁকি প্রায় চারগুণ। এদের চোখ ও কিডনি সমস্যার ঝুঁকিও থাকে বহুগুন।
প্রাপ্তবয়স্ক ডায়াবেটিক রোগীর ৭৩% শতাংশের রক্তচাপ ১৪০/৯০ এর বেশি এবং উচ্চ রক্তচাপের জন্য ব্যবহার করেন ওষুধ।
ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপের এমন ঝুঁকি থাকার জন্য, আমেরিকান ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেল্থ সাধারণ লোকের লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে নিচে রেখেছেন রক্তচাপের লক্ষ্যমাত্রা। ১৩০/৯০ মিলি মিটার পারদ চাপের নিচে।
ডায়াবেটিসের রোগীর যে কোন চিকিৎসার ক্ষেত্রেই রক্তের গ্লুকোজের আদর্শ মাত্রা বজায় রাখার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। রক্তের গ্লুকোজের আদর্শ মাত্রা রোগীর বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক শ্রম, ডায়াবেটিসের জটিলতা ও অন্য রোগের উপস্থিতির উপর নিভর্র করে নিরোপিত হয়। ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ দুটোই লাইফ স্টাইল সম্পৃক্ত রোগ; তাই এ দুটি রোগের চিকিৎসাতেই জীবন যাপন পদ্দতির উন্নতি অত্যাবশ্যক। এর কেন্দ্রে থাকবে আদর্শ খাদ্য গ্রহণ পদ্ধতি এবং নিয়মিত-পরিমিত শারীরিক শ্রম। এরপর রোগের চাহিদা ও দীর্ঘস্থায়ী জটিলতার ঝুঁকি কমাবার লক্ষ্য নিয়ে প্রয়োজন মাফিক ওষুধ সেবন। কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা ও তা বজায় আছে কিনা
তা ফলো-আপ করা জরুরী। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ক্ষেত্রে ফলো-আপ করতে বাড়িতে নির্দিষ্ট সময়ে চিকিৎসকের পরার্মশ মোতাবেক রক্তচাপ মাপা ও প্রয়োজন ভিত্তিক চিকিৎসকের পরার্মশ নেওয়া উচিত।
উচ্চ রক্তচাপ অনেক সময় নি:শব্দ সমস্যা। ডাক্তার রক্তচাপ চেক্ না করলে তা জানাও যায় না। আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশনের পরামর্শ; প্রতিবার ডাক্তারের ভিজিটের সময় রক্তচাপ মেপে দেখা উচিত বা বছরে অন্তত: ৩-৪ বার মাপানো উচিত। কারো কারো রক্তচাপ বেশ উচুতে উঠলে কিছু উপসর্গ হতে পারে। যেমন- মাধা ধরা, মাথা ঝিম ঝিম করা, ঝাপসা দেখা।
উচ্চ রক্তচাপ কি প্রতিরোধ করা যায়
আমেরিকান ডায়াবেটিস এসোসিয়েশনের পরামর্শ হলো- নুন খাওয়া কমানো, মানসিক চাপ কমানোর কাজ কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা, মদ্যপান কমানো (আমার পরামর্শ; বর্জন করা), ধূমপান করে থাকলে বন্ধ করা এবং অন্যের ধূমপানের ধোয়া থেকে দূরে থাকা এবং রক্তচাপ মনিটর করা।
কিভাবে হয় চিকিৎসা
জীবন-যাত্রার ধরন পরিবর্তন এবং ওষুধ দুটোই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। ব্যক্তিভেদে চিকিৎসা হয় ভিন্ন ভিন্ন। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা নিজের জন্য যথাযথ চিকিৎসা পরিকল্পনা ঠিক করে নিতে হবে।
জীবন-যাত্রার ধরন পরিবর্তন
জীবন-যাত্রার ধরনে পরিবর্তন আনলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ হয়, নিয়ন্ত্রণে আসে রক্তের গøুকোজ ও রক্তের লিপিড কোলেস্টেরল মান।
আদর্শ খাদ্য পদ্ধতি
প্রয়োজনে ওষুধ
নানা রকমের ওষুধ রয়েছে। প্রত্যেকের জন্য একই রকম রক্তচাপের ওষুধ লাগবে তা নয়, অনেকের লাগে একাধিক ধরণের ওষুধ। রক্তচাপের মান, অন্যান্য সহযুক্ত উপাদান, ওষুধের মূল্য নানা বিবেচনায় ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দিতে হয় ডাক্তারকে।
এসিই ইনহিবিটারস (এনজাইম ইনবিহিটারস)
এনজিওটেনসিনোজেন কনভারটিং এই ওষুধ রক্তনালীকে শিথিল করার মাধ্যমে কমায় রক্তচাপ। শরীরে এনজিওটেনসিন নামে হরমোন উৎপাদন রোধ করে এবং রক্তনালী সংকুচিত করার এই হরমোনের ক্রিয়া রোধ করে কাজ করে এই ওষুধ। এই ওষুধ সে সঙ্গে কিডনিরও সুরক্ষা করে এবং হার্ট এ্যাটাক ও স্ট্রোক প্রতিরোধ করে।
এ.আর.বি (এনাজিওটেনসিন রিসেপটার ব্লকার)
এই ওষুধগুলোও রক্তনালীকে উম্মুক্ত করে এবং শিথিল করে, এভাবে হ্রাস করে রক্তচাপ। কিডনিও সুরক্ষা করে।
বিটা ব্লকারস
হূদপিন্ডকে ধীরে সুন্দিত করার মাধ্যমে এবং কমজোরে সন্দিত করার মাধ্যমে এই ওষুধগুলো কমিয়ে আনে রক্তচাপ ও শিথিল করে হূদযন্ত্র। বিটাব্লকারস, হার্ট এ্যাটাক ও স্ট্রোকও প্রতিরোধ করে।
ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকারস
ক্যালসিয়ামকে রক্তনালী ও হৃদযন্ত্র থেকে বাহির করে দিয়ে শিথিল করে রক্তনালীদের। এভাবে কমে রক্তচাপ।
ডাইইউরেটিকস্
মূত্রবর্ধক ওষুধ, অনেক সময় বলা হয় ওয়াটার পিল। মূত্রের মাধ্যমে শরীরের বাড়তি পানি ও সোডিয়াম বের করে দেয়। এসব ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও আছে। এজন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ নির্বাচন প্রয়োজন হয়।
ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ