৭ এপ্রিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আজ। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়, এর কারণ হচ্ছে জাতিসংঘের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’-এর জন্মদিন ৭ এপ্রিল ১৯৪৮। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার ২ মাস পর ২৪ জুন ১৯৪৮ সালে এ সংস্থার প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল জেনেভায়।সেই সময় সারা বিশ্বের ৪৬টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সেই সম্মেলন থেকেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরিতে ১৯৫০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে প্রতি বছর নিয়মিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি বছর এমন একটি প্রতিপাদ্য বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসে, যা বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫০ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘নো ইউর হেলথ সার্ভিসেস’, যার অর্থ ‘নিজের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন হোন’। এভাবে ৭০ বছর ধরে ৭ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সুরক্ষিত বিশ্ব, নিশ্চিত স্বাস্থ্য’। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষ্যে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে।
বিশ্ব গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে কোভিড-১৯ নামক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে এবং বিশ্বজুড়ে সব সেক্টরেই কঠোরভাবে আঘাত করেছে এ প্রাণঘাতী ভাইরাস। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ৪৯ কোটি ৫০ লাখের বেশি মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রায় লাখের বেশি মানুষ এ প্রাণঘাতী ভাইরাসে মৃত্যুবরণ করেছেন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৯ লাখ ৫২ হাজার আক্রান্ত এবং মৃত্যুবরণ প্রায় ২৯ হাজার ২০০ জন।
আমরা বর্তমানে একটি অসম পৃথিবীতে বসবাস করছি। যেখানে কিছু লোক স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করছে, অন্যদের তুলনায় মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবায় বেশি সুযোগ পাচ্ছে, কাজের ক্ষেত্রে-বসবাসের ক্ষেত্রে অধিক পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। অপরদিকে সারা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ দৈনিক আয়ের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করছে জীবনের সঙ্গে।
আবাসন সংকট প্রকট এবং সুশিক্ষার ক্ষেত্রে সীমিত সুযোগ পাচ্ছে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সুযোগের অভাব, বৃহত্তর লিঙ্গবৈষম্য, নিরাপদ পরিবেশ, বিশুদ্ধ পানি-নির্মল বায়ু ও নিরাপদ খাদ্য সংকট এবং সংকটাপন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা। এসব বিষয় আমাদের সমাজ এবং অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ সমস্যাগুলোর প্রতিকার ও প্রতিরোধ সম্ভব। এজন্য আমাদের প্রত্যেকের জীবনযাত্রার মান উন্নতকরণে, সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশ্বনেতৃত্বকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বনেতাদের বদ্ধপরিকর হতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ বেশ ভালোভাবেই করোনাকে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছেন। করোনা মোকাবিলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তবে একথা সত্য, তার নিরলস পরিশ্রম ও অদম্য মনোবলের কারণে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের আগেই করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ ইতিবাচক সাফল্য অর্জন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা প্রায় ৩৪ কোটি, যেখানে বাংলাদেশে জনসংখ্যা মাত্র ১৭ কোটি। কোভিড-১৯-এর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত মারা গেছে প্রায় ৯ লাখ মানুষ, সেখানে বাংলাদেশে মারা গেছে ২৯ হাজার।
আয়তনের দিক দিয়েও বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক ছোট। সে তুলনায় করোনা মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক ভালো অবস্থানে আছে। জার্মানির আয়তন বাংলাদেশের প্রায় তিনগুণ আর জনসংখ্যা বাংলাদেশের অর্ধেক। অপরদিকে নিউজিল্যান্ডের আয়তন বাংলাদেশের দ্বিগুণ আর জনসংখ্যা বাংলাদেশের প্রায় পঁয়ত্রিশ ভাগের এক ভাগ। সে হিসাবে বলা যায়, করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের তুলনায় উল্লেখিত দেশ তিনটির কাজ সহজ ছিল।
মূলত সীমিত আয়তন ও বিপুল জনসংখ্যার বাংলাদেশের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তে তা মোকাবিলা করে চলেছেন। কিছুদিন আগে গণটিকা কর্মসূচিতে এক দিনে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে একদিনে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে একমাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। বিশ্বের ১১৭টি দেশের মধ্যে ৪২টি দেশে জনসংখ্যার পরিমাণ এক কোটি ২০ লাখ। যেখানে ৪২টি দেশে সর্বমোট জনসংখ্যাই এক কোটি ২০ লাখ, সেখানে আমরা একদিনে এক কোটি ২০ লাখ মানুষকে টিকা দিয়ে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম দেশ হিসাবে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছি।
গত ২৯ মার্চ ২০২১ তারিখে উপাচার্য হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে বেশ কয়েকটি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমগুলো হলো-
Haematological Parameters and Antibody Titre After Vaccination Against SARS-COV-2 শীর্ষক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ, বিএসএমএমইউ-এর জেনোম সিকোয়েন্সিং রিসার্চ প্রজেক্ট-এর গবেষণা, কোভিড-১৯-এর ৭৬৯টি জেনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার ফলাফল, শহিদ ডা. মিল্টন হলে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে খাদ্যে ক্ষতিকারক উপাদানের উপস্থিতি (ফুড হ্যাজার্ড) নিয়ে তিনটি গবেষণার ফলাফল এবং বিশ্ব প্রবীণ দিবসে প্রবীণদের পুষ্টিসহ তিনটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সাধারণ জরুরি বিভাগ চালু, বেতার ভবনে ১০০ শয্যা করোনা ইউনিট এবং নন কোভিড রোগীদের জন্য ১০ বেডের নতুন আইসিইউ ইউনিট, ২০ হাজার লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন অক্সিজেন প্ল্যান্ট, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব ফিল্ড হাসপাতাল চালু, রোগীদের সুবিধার্থে বৈকালিক স্পেশালাইজড আউটডোর চালু, ফরেনসিক মেডিসিন ও টক্সিকোলজি বিভাগ চালু, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২৩ বছর পর প্রথমবারের মতো হেলথ কার্ড চালু, পেডিয়াট্রিক এন্ডোক্রাইনোলজি ক্লিনিক, পেডিয়াট্রিক থাইরয়েড ক্লিনিক ও গ্রোথ ক্লিনিক, রেটিনোপ্যাথি অফ প্রিমেচিউরিটি (আরওপি) ক্লিনিক, রিপ্রোডাকটিভ এন্ডোক্রাইনোলজি এন্ড ইনফার্টিলিটি বিভাগে ডিম্বাশয়ে স্টেমসেল থেরাপি প্রতিস্থাপনের মহতী কার্যক্রম, অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি এন্ড ইমিউনোলজি বিভাগে স্থাপিত স্বয়ংক্রিয় জীবাণু শনাক্তকরণ. অ্যান্টিবায়োটিকের সংবেদনশীলতার মাত্রা নির্ধারণের মেশিনের কার্যক্রম, শিশু সার্জারি বিভাগে স্কিল ল্যাব, ডিজিটাল লাইব্রেরি ও তিনটি ডিভিশন এবং হিজড়া নামে পরিচিত তৃতীয় লিঙ্গের শিশুদের চিকিৎসার জন্য ডিসঅর্ডার অফ সেক্স ডেভেলপমেন্ট বহির্বিভাগ ক্লিনিক, কলোরেক্টাল ক্যানসার স্ক্রিনিং টেস্ট (ফিকাল ইমিউনোকেমিকেল টেস্ট-ফিট)-এর উদ্বোধন, মেলনিউট্রিশন ক্লিনিক, অটোল্যারিংগোলজি হেড এন্ড নেক সার্জারি বিভাগের উদ্যোগে স্কিল ল্যাব, শিশুদের মেরুদণ্ডের বাঁকা হাড় সোজাকরণ ইউনিট, গাইনোকোলজিক্যাল-অনকোলজি ওপিডি স্পেশাল ক্লিনিক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ই-ব্লকে পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি এন্ড থ্যালাসেমিয়া ডে-কেয়ার সেন্টার ও শিশু পালমোলজি ওয়ার্ড এবং মুভমেন্ট ফর থ্যালাসেমিয়া ইরাডিকেশন ইন বাংলাদেশ-এর উদ্বোধন, প্যাথলজি বিভাগের সাইটোজেনেটিকস ল্যাব এ ফিস টেস্ট এবং ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগে ইমার্জেন্সি ল্যাবের উদ্বোধন করা ইত্যাদি।
এছাড়াও নন-রেসিডেন্ট ছাত্রছাত্রীদের ভাতা প্রদান, অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগে আরর্থ্রোস্কোপি ইউনিটে না কেটেই সফলভাবে শোল্ডার জয়েন্ট আরর্থ্রোস্কোপির মাধ্যমে ব্যাংকার্ট রিপেয়ার কার্যক্রম অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন, সফলভাবে ইনফার্টিলিটির চিকিৎসায় স্টেমসেল প্রয়োগ, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর, কোর্স আউটদের সুযোগ, রেসিডেন্ট, নন-রেসিডেন্টদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পন্ন করা হয়।
একসঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবার অসম্পূর্ণ দিকগুলো বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরতে হবে। সমাধানগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় এবং মানুষের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে নির্ভরযোগ্য তথ্য/ডেটা সংগ্রহ করা। সময়োপযোগী এবং নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য তথ্য এমনভাবে সংগ্রহ করতে হবে যেন লিঙ্গ, বয়স, উপার্জন, শিক্ষা, মাইগ্রেশনের স্থিতিশীলতা, অক্ষমতা, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জাতীয় প্রসঙ্গ ইত্যাদি পৃথকভাবে প্রাধান্য পায়। কেবল তখনই বিশ্ব জনসংখ্যার উপগোষ্ঠীগুলোতে অসম্পূর্ণতাগুলো মূল্যায়ন এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
অসমতার মূল কারণগুলো মোকাবিলায় এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ এবং আগামী দিনের স্থিতিশীলতা বাড়ানোর জন্য আজকের দিনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা খুবই জরুরি।
জাতীয় সীমানা ছাড়িয়ে স্বাস্থ্যসেবায় আইনের প্রয়োগ হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কেবল যখন আমরা দেশের সীমানা পেরিয়ে গোটা বিশ্বব্যাপী সুরক্ষা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারব, তখনই কেবল কোভিড-১৯ মহামারিকে শেষ করা সম্ভব হবে। ভ্যাকসিন, পরীক্ষা এবং চিকিৎসার ন্যায়সংগত সরবরাহের আশ্বাস প্রদানের পাশাপাশি আমাদের অবশ্যই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে হবে। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবায় সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত নিয়মিত মাস্ক পরাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলব। ‘করোনামুক্ত বিশ্ব, অসমতাবিহীন মানবিক সমাজ আমরা গড়ব’, এই হোক ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার। খবর-ডেইলি বাংলাদেশ
আজকের বাজার/আখনূর রহমান