আধুনিক ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতিতে ৫ রূপরেখায় তাপসের ইশতেহার ঘোষণা

আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস পাঁচটি রূপরেখার মাধ্যমে ঢাকাকে বাসযোগ্য ও পরিকল্পিত আধুনিক মহানগর হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন।

বুধবার গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কার্যলায়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন তাপস।

‘আমাদের ঢাকা, আমাদের ঐতিহ্য ‘ এই স্লোগানে জনকল্যাণমুখী ও সুসমন্বিত কার্মকান্ডের মাধ্যমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।

তাপস বলেন, ত্রিশ বছরের মহাপরিকল্পনার মধ্যে কিছু প্রকল্প হবে স্বল্প মেয়াদি, কিছু প্রকল্প হবে দীর্ঘ মেয়াদি। সনাতন প্রদ্ধতির ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে দৈনন্দিন পদ্ধতিতে করা হবে।

তিনি বলেন, সুন্দর-সচল-সুশাসিত-উন্নত ঢাকার পথে নতুন করে আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে। অনেক অবহেলা, গাফিলতিতে ঢাকা অপরিকল্পিত ও দূষণে আক্রান্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে।

নৌকার এই মেয়র প্রার্থী বলেন, ‘ঢাকায় ক্রমবর্ধমান মানুষের চাপ, যুগের চাহিদা, মানুষের স্বপ্নের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রয়েছে কিছু সমস্যা, তৈরি হয়েছে নতুন নতুন চাহিদা। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি বিবেচনায় ঢাকা দক্ষিণের সম্ভাবনার দিগন্ত আজ অবারিত। সব সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করে এগিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ বর্তমান সরকার গ্রহণ করেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অগ্রসর হওয়া আমাদের জন্য কঠিন কিছু নয়। প্রত্যাশিত ঢাকার নব সূচনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে।’

ইশতেহারে পাঁচটি রূপরেখার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে-

১. ঐতিহ্যের ঢাকা: ভোটে মেয়র নির্বাচিত হলে ঐতিহ্যের ঢাকা ফিরিয়ে আনার কথা জানিয়ে তাপস বলেন, চারশত বছরের পুরনো আমাদের এই ঢাকার রয়েছে নিজস্ব ইতিহাসের উজ্জ্বল ছবি, ঐতিহ্যের গভীর শেকড় ও প্রত্নতাত্বিক গুরুত্ব। পর্যটনের জন্যও হতে পারে অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র। এখানে ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদও অনন্য। সাংস্কৃতিক ধারায় রয়েছে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আয্হা, পহেলা বৈশাখ, ঘুড়ি উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তিসহ অজস্র উৎসব।

‘আমি নির্বাচিত হলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকাকে ঐতিহ্য প্রাঙ্গণ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। সবাইকে নিয়ে সমন্বিত প্রয়াসে জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারি নির্মাণ ও প্রদর্শনীসহ নগরীর ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্থাপনা সংরক্ষণে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করে ঢাকাকে স্ব-গৌরবে সাজিয়ে তুলে ধরবো বিশ্ব দরবারে।

২.সুন্দর ঢাকা: সুন্দর ঢাকা গড়ে তোলার কথা জানিয়ে তাপস বলেন, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা দুই নদীর অববাহিকায় পত্তন হওয়া আমাদের এই ঢাকা, এমন শহর পৃথিবীতে বিরল! সুন্দর ঢাকা গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উদ্যান নির্মাণ, সবুজায়ন, ছাদবাগানে উৎসাহ, পরিবেশ বান্ধব স্থাপনা বৃদ্ধি, বায়ু ও শব্দ দূষণ রোধ করা। এছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ, শরীর চর্চা কেন্দ্র এবং নারী-শিশু ও প্রবীণদের জন্য হাঁটার উন্মুক্ত স্থান, আধুনিক মানের কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থা করা হবে। সর্বসাধারণের সুবিধার্থে সাধারণ ও ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের ব্যবস্থা, দু:স্থ-অসহায়দের কল্যাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বস্তি উন্নয়নকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অন্তর্ভূক্ত করা হবে।

‘নির্মাণাধীন পরিচ্ছন্ন কর্মী নিবাসগুলোর নির্মাণকাজ দ্রুত সম্পন্ন, নতুন পরিচ্ছন্নকর্মী নিবাস নির্মাণ ও তাদের নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হবে। খালগুলোর অবৈধ দখল উচ্ছেদ, খনন ও সৌন্দর্য বর্ধন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় সংখ্যক নর্দমা নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ, ও জলাধার সংরক্ষণ এবং জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দৈনন্দিন ভিত্তিতে সড়কের উপর উন্মুক্ত আবর্জনার স্তুপ অপসারণ করা হবে। সড়ক থাকবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় সবুজায়ন, শিশুপার্ক, থিয়েটার হলসহ পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। র্দীঘ মেয়াদি পরিকল্পনায় বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পাড় ঘিরে বনায়ন, বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনসহ ব্যাপক সৌন্দর্য বর্ধনের মাধ্যেমে সুন্দর ঢাকা গড়ে তুলবো।’

৩.সচল ঢাকা: যানজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপের কথা জানিয়ে তাপস বলেন, যানজটের কারণে রাস্তায় চলাচল হয়ে উঠেছে দূর্বিসহ। সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো ও ফিরে আসতে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়, বিশেষ করে কর্মজীবী নারীদের বিড়ম্বনা অপরিসীম। গণপরিবহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কিছু রাস্তায় দ্রুত গতির যানবাহন, কিছু রাস্তায় ধীর গতির যানবাহন, আবার কিছু রাস্তায় শুধু হাঁটার ব্যবস্থা করবো। নদীর পাড়ে থাকবে সুপ্রশস্ত রাস্তা, যেখানে হেঁটে চলা যাবে, চালানো যাবে সাইকেল, চলবে রিকশা ও ঘোড়ার গাড়ি। দ্রুতগামী যানবাহনের জন্য থাকবে আলাদা পথ, থাকবে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা। রাস্তা পারাপারের সুব্যবস্থাসহ নগর ঘুরে দেখার জন্য থাকবে বাস সেবা। থাকবে প্রয়োজনীয় সড়ক বাতি ও উন্নত প্রক্ষালন কক্ষ। হকারদের তথ্যভান্ডার গঠন করে তাদের পূনর্বাসনের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ফুটপাত দখলমুক্ত করা হবে। এভাবে গড়ে তুলবো আমাদের সচল ঢাকা।

৪.সুশাসিত ঢাকা: সুশাসিত ঢাকা গড়ে তুলার কথা জানিয়ে তাপস বলেন, ঢাকায় একসময় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল। মাদক নির্মূল, জুয়া, কিশোর অপরাধসহ নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়জনিত বিভিন্ন অপরাধ রোধসহ এলাকাভিত্তিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কার্যকর ও সংশোধন কেন্দ্র নির্মাণ করবো। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন হবে বাংলাদেশে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম দুর্নীতি মুক্ত সংস্থা। বছরের ৩৬৫ দিন, সপ্তাহের ৭ দিন, ২৪ ঘন্টা নাগরিক সেবা প্রদানের জন্য খোলা থাকবে। মশকের প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস, মশক নিধনে দৈনন্দিন ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহন। প্রয়োজনীয় সংখ্যক হাসপাতাল-ডিসপেনসারী ও প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রাথমিক হাসপাতাল-ডিসপেনসারী ও প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র্র স্থাপনসহ মাতৃসদন, পরিবার পরিকল্পনা, জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। শিক্ষার মানোন্নয়ন ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নেয়া হবে।

৫. উন্নত ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঘোষিত সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ-এর রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নে উন্নত রাজধানী গড়ে তোলার বিকল্প নাই। দেশি-বিদেশি নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ত্রিশ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে ঢাকাকে গড়ে তোলা হবে।

‘ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, কর্মজীবী মহিলাদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক হোস্টেল গড়ে তোলা হবে। জনগণকে প্রদেয় কর্পোরেশনের সেবা যথা- বাণিজ্য লাইসেন্স, জন্ম নিবন্ধনপত্র, প্রত্যয়নপত্র, গৃহকর, পৌরকরসহ অন্যান্য সেবা প্রযুক্তির আওতায় আনা হবে। সব ক্ষেত্রে অনলাইন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে । ঘরে বসেই কর এবং নির্ধারিত ক্ষেত্রে ফি পরিশোধ করতে পারবেন।’

‘কর্পোরেশন পরিচালনায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা এবং প্রতিটি ওয়ার্ডকে এর আওতাভুক্ত করা হবে। ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইনে নাগরিক সেবা ও সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় তথ্যসমৃদ্ধ নগর অ্যাপ চালু করা হবে। সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় ই-লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা। নগর ভবনে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ রেখে বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা ও ফ্রি ওয়াইফাই জোন স্থাপন করা হবে। সর্বোপরি সিটি কর্পোরেশনের কার্যপরিধির আওতায় সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সমন্বিত প্রয়াসে উন্নত ঢাকা গড়ে তুলবো ইনশাআল্লাহ।’

তাপস বলেন, আমাদের এই ঢাকা ঐতিহ্যে মণ্ডিত। এই ঢাকাতে জন্মেছি, বড় হয়েছি সান্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়েও স্বপ্ন দেখি এই ঢাকাকে ঘিরে। ঢাকা বলতে আমার বেড়ে ওঠা এই ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকাকেই বুঝি। এখানেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাত্রিতে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে হারিয়েছি আমার বাবা-মাকে। কিন্তু বিগত দিনে এখানে পেয়েছি স্নেহ-ভালোবাসা-বন্ধন। এই ভালোবাসাকে পুঁজি করেই, স্বপ্নের উন্নত ঢাকার পথ চলায় আপনাদের আস্থা ও সমর্থনই আমার পাথেয়।

ইশতেহার ঘোষণার সময় তার সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু এমপি, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল, আফজাল হোসেন, ত্রাণ ও দুর্যোগ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আব্দুস সবুর, উপ প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, কেন্দ্রীয় সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, কামরুল ইসলাম এমপি, রিয়াজুল কবির কাউসার, গোলাম রাব্বানী চিনু, পারভীন জামান কল্পনা, সাহাবউদ্দিন ফরাজী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফি, সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ও যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ।

আজকের বাজার/এমএইচ