আনিসুল হক দেখিয়েছেন নগরপিতা কি?

আনিসুল হকের কথা মনে হলেই চোখের কোনে ভেসে উঠে হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণপ্রাচুর্যে্য ভরা স্বপ্নবাজ এক মানুষের মুখচ্ছবি। কিন্তু সেই মানুষটি এখন নিরব, নিথর। সবকিছু থেকেও যেন কোন কিছু নেই। চারদিকে শূণ্যতার এক হাহাকার ধ্বনি। সত্যিকার একজন অভিভাবকে যেন হারাল নগরবাসী।

মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন সেগুলো বাংলাদেশের বাস্তবতায় শুধু কঠিনই ছিল না, অসম্ভবও ছিল। কিন্তু সে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন তিনি। এ জন্য নানা বাধার মুখেও পড়তে হয়েছিল তাকে। কিন্তু থেমে যাওয়া বা দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না তিনি। দুর্নীতি, দখলবাজির বিরুদ্ধে রীতিমতো ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করে নগরজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি।

সিটি করপোরেশনকেন্দ্রিক টেন্ডার বাণিজ্য বন্ধ করে ক্রয়খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, সিটি করপোরেশন এলাকায় নানা রং-বেরঙের অবৈধ বিলবোর্ড অপসারণ, তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ, গাবতলীতে অবৈধ পার্কিং বন্ধ, দূতাবাসপাড়ায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের মতো কাজ করেছেন আনিসুল হক।

আরও কিছু পদক্ষেপও নিয়েছিলেন তিনি।এগুলোর মধ্যে রয়েছে-নগরীর সৌন্দর্যবর্ধন ও সবুজায়ন; উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ ও কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ; সড়কবাতি স্থাপন, সড়ক ও ফুটপাত নির্মাণ, সংস্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখা, জলাবদ্ধতা নিরসনে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা।

গত দুই বছরে দুটি চলন্ত সিঁড়িসহ ৫৫টি ফুট ওভারব্রিজ, দুটি আন্ডারপাস এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক জেব্রা ক্রসিং নির্মাণ করা হয়েছে। ১০টি উন্নতমানের আধুনিক পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে, যা সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ব্যবহার করতে পারবে।

উন্নত নাগরিকসেবার জন্য ‘নগর’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ চালু হয়েছে তার সময়ই। নিরাপদ ঢাকা গড়ার প্রত্যয়ে এরই মধ্যে ৬৪২টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। এতে জননিরাপত্তা বেড়েছে বহুগুণ। নগরবাসীর দুর্ভোগ কমাতে তার এলাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশেষ বাস সার্ভিস ‘ঢাকা চাকা’ চালু করেন। উত্তরায় ৩২ হাজার গাছের চারা রোপণ করেন। আরও ১০ লাখ গাছের চারা লাগানোর পরিকল্পনা চলছে।
এমন হাজারো স্বপ্ন নিয়ে মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন হাস্যময়ী আনিসুল হক।

বিদায় বেলায় আনিসুল হকের পরিচয়টা একজন মেয়র হিসাবে বড় করে দেখা হলেও তিনি ছিলেন এক সময়ের জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপকও। মূলত আনিসুল হকের খ্যাতিটা ছড়িয়ে পড়ে উপস্থাপনার মাধ্যমেই।

প্রায় দুই যুগ আগের কথা, সেসময় তিনি ছিলেন একজন ভীষণ জনপ্রিয় উপস্থাপক। তখন একমাত্র বিটিভিই ছিল গ্রাম-শহর নির্বিশেষে তৎকালীন মানুষের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। ওই সময় তরুণ আনিসুল হক উপস্থাপক হিসাবে ছিলেন দর্শকপ্রিয়তার শীর্ষে। ঈদসহ বিভিন্ন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক বলতেই যে ক’জনার নাম উঠে আসতো তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন আনিসুল হক। সুদর্শন সেই যুবকের বাচনভঙ্গি, ভরাট কণ্ঠস্বর ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উপস্থাপনা সকলের মন কেড়ে নিতো।

সেই সফল গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব পরবর্তীতে ব্যবসায় নেমেও সফলতা পান। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ একাধিক সংগঠনের শীর্ষ কর্মকর্তা ও সর্বশেষ ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচিত হন। উপস্থাপনা ছেড়ে দিলেও যেকোনো অনুষ্ঠানে মঞ্চে উঠে বক্তব্য শুরু করলেই মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার বক্তব্য শুনতেন।

আর সেই মানুষটি হারিয়ে গেছেন চিরতরে। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন তার কর্মের দ্বারা।

আজকের বাজার:এলকে/এলকে ২ ডিসেম্বর ২০১৭