আবগারী শুল্ক ও ভ্যাট বাজেটের আলোচিত বিষয়: শাখাওয়াত হোসেন মামুন

এবারের বাজেট আমার মনে হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে খুব বেশি আলোচিত। বিশেষ করে ভ্যাটের বিষয়টা। আরও ৪ বছর আগে অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেছেন। কিন্তু এবারই এর প্রয়োগ হচ্ছে । আমরা ব্যবসায়ী কেউ বুঝে আবার কেউ না বুঝে এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি। বুঝে এবং না বুঝে বলাটার উদ্দেশ্য হলো ভ্যাট কিন্তু আমাদের ছিলোই, এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু না তবে কিছু কিছু সেক্টরে ৮ পার্সেন্ট পর্যন্ত ছিলো। কিন্তু সাধারণভাবে ৫০ভাগ ছিলো । সরকার যেটা করছে এটা পুরোপুরি ৫০পার্সেন্ট করে দিয়েছে। সরকার চাইছে রাজস্ব বাড়াতে এবং চাইছে একটি ইউনিফর্মড ব্যবস্থা । আর ব্যবসায়ীদের সমস্যা হচ্ছে, হুট করে যেখানে ৪ ভাগ ভ্যাট ছিলো তাদেরকে একটানেই ১৫ পার্সেন্টে এনে ফেলেছে । ডিফারেন্সটা অনেক বড় । যারা ১৫ভাগে আগে থেকেই আছেন তারা কিন্তু কিছু বলছেন না। বলছেন, যারা চার-পাঁচ-আট পার্সেন্টে ছিলেন তারা । আমরা যারা রিটেল শপে যাই তারা কিন্তু ৪ ভাগ ভ্যাট দিই। কিন্তু এটাকে ডাইভার্ট করে ১৫-তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সরকার বলছে একাউন্টের মাধ্যমে বাড়তি ভ্যাট আপনি ফেরত পাবেন। কিন্তু ফেরত পাওয়ার যে ব্যবস্থাপনা সেটা কি উন্নত হয়েছে? এটাই প্রধান সমস্যা । আপনি এখন বলছেন ভ্যাট রিফান্ড করে দিবেন, ভ্যাট এডিশন যতটুকু থাকবে আপনি পাবেন। যতটুকু কেনাকাটা করেছেন তার কাগজপত্র যদি সরকারের কাছে জমা দেন সরকার আপনাকে বাকিটা ফেরত দিয়ে দিবে। এটা একটা অংকের মতো। ধরুন, আমি যদি বিস্কিট কোম্পানির ব্যবসা করি তখন আমাকে পারচেজ করতে হবে ময়দা। এখন কয়টা ময়দার মিল আছে যারা ভ্যাটের কাগজপত্র সংরক্ষণ করে ? সে যদি আমাকে ইনভয়েস না দেয় আমি ভ্যাটের জন্য রিফান্ড করতে পারব না। বাংলাদেশে এখনো অনেক ব্যবসা আছে যারা আর্থিক লেনদেনের কাগজপত্র সংরক্ষণ করে না। এ প্রসেসটাকে আগে অটোমেশন করার দরকার ছিলো। সরকার যদি বলতো এখন যে ভ্যাট আদায়ের ব্যবস্থা আছে সেটা আগে অটোমেশন করি। এভাবে অন্তত এক বছর ট্রায়ালে রেখে রান করি। এ উদ্যোগটা ভালো, এটা অস্বীকার করবো না। তবে আমার মনে হয় আরেকটু বেশি হোমওর্য়াক করার দরকার ছিলো।

প্রসঙ্গ ইনকাম ট্যাক্স
ইনকাম ট্যাক্স নিয়ে আমার কিছু কথা আছে। বাংলাদেশে সেক্টর অনুযায়ি ৪০ পার্সেন্ট পর্যন্ত ট্যাক্স দিতে হয়। যেমন বীমা খাতে যদি ধরি, এখানে ১০০ টাকা লাভ করলে আপনাকে ৪৫ টাকা ট্যাক্স দিতে হবে। আবার যখন অন্যান্য সেক্টরের কথা বলবো, কোথাও কোথাও ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ পর্যন্ত ট্যাক্স আছে । এখন যারা ইনভেস্টমেন্টেও টাকা দিবেন বিক্রির সময় তাদের আবার আরও ১৫ থেকে থেকে ২৫ভাগ পর্যন্ত ট্যাক্স দিতে হতে পারে। তাহলে ট্যাক্সের ফিগারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো? সমস্যা হলো অন্য জায়গায়, ট্যাক্স না দিলে সরকার চলবেই বা কিভাবে ? এটা একটা প্রশ্ন ? কিন্তু আমাদের যুক্তি হচ্ছে, এত বড় একটি একটি অর্থনীতি ট্যাক্স পেয়ার আছে কয়জন ? যে ট্যাক্স দিচ্ছে তাকেই যদি আপনি আবার ট্যাক্স দেয়ার জন্য চাপিয়ে দিচ্ছেন যে আরও দাও, আরও দাও। আর যারা দিচ্ছে না তারা কিন্তু বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে । ঢাকার শহরে কি অ্যাপার্টমেন্ট বিজনেস কম আছে ? যে দিচ্ছে তাকেই যদি আপনি আরও দেয়ার জন্য প্রেসার দেন সে কিন্তু একটা সময়ে ভেঙে পড়বে। যাদের অল্প আয় তাদের থেকে আপনি অল্প নেন । বাংলাদেশে ৮ লক্ষ ট্যক্স পেয়ার আছে , রেজিস্ট্রেশন করা আছে আরও বেশি সংখ্যকের। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ৮ লক্ষ মানুষ ট্যাক্স দেয়, আমার মতে এ সংখ্যাটা এক কোটি হওয়া উচিৎ।

এক কোটি মানুষ যদি ১০ হাজার টাকা করেও কর দেয় তাহলে মোট পরিমাণটা কত দাঁড়াবে চিন্তা করা যায়? এখন একজন ভ্যাট দেওয়া শুরু করলে সরকার তাকেই পেয়ে বসে, দাও, আরও দাও তার কাছ থেকেই আরও নিতে হবে। ভ্যাট অফিসের কর্মচারিরা কেবল যারা ভ্যাট জমা দেন তাদের জমা দেওয়া ভ্যাটের অডিট নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। আমি মনে করি এ ধরনের অডিট করা থেকে নতুন নতুন কারা কারা ট্যাক্স দিচ্ছে না তাদের খোঁজে বের করা দরকার। এবং এটা খোঁজা খুবই সহজ। কারা এয়ারপোর্ট দিয়ে বিদেশ যাচ্ছেন ? পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছেন? ঢাকা শহরের অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে ঘুরতে পারেন ভ্যাট অফিসের লোকজনেরা। এতো এতো অ্যাপার্টমেন্ট, এগুলোর মালিক কারা ? গুলশান বনানীতে কোনো অ্যাপার্টমেন্টর ভাড়া ৫০ হাজারের নিচে নেই । তাহলে তার মাসে ইনকাম আছে ৬ লাখ টাকা । সে কি ট্যাক্স দিচ্ছে ? আপনি সে জায়গায় না গিয়ে যারা ট্যাক্স দিচ্ছে তাকেই অডিটে ফেলে হয়রানি করছেন । এভাবে চলতে থাকলে একসময় কিন্তু সে নাই হয়ে যাবে। এ দুটো জিনিসের সমন্বয় করা দরকার।

পাশের দেশের উদাহরণ
আমরা যদি পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকাই কী দেখবো? তারা কিন্তু অলমোস্ট পেপারলেস হয়ে যাচ্ছে। যেকোনো শপিং মল কিংবা ছোট ছোট দোকানেও পাঞ্চ মেশিন আছে। সবাইকে ক্রেডিট কাডর্, ডেবিট কার্ড সরকারের পক্ষ থেকেই দেওয়া হয়েছে। কেনাকাটায় তারা এই কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন। কার্ডটা যখন ব্যবহার করবেন তখন কিন্তু দোকানি ব্যাংকে ট্যাক্স দিতে বাধ্য। আপনি ইচ্ছে করলেও ফাঁকি দিতে পারবেন না। এ মেশিনের দামও কিন্তু বেশি না। আপনি যখন পেপারলেস ব্যবস্থায় চলে আসবেন তখন কিন্তু অটোমেটিকলি এটা হবে। আমাদের ছেলেরাই কিন্তু বিদেশে অটোমেশনের কাজ করছে। আমেরিকায়,অস্ট্রেলিয়ায় অটোমেশনের কাজ করছে তারা। আমাদের দেশেও সরকারকে অটোশেনের উদ্যোগ নিতে হবে । এটা কঠিন কোনো কাজ নয় ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনা
বাংলাদেশ ব্যাংকে যা ঘটলো। বড় একটা এমাউন্ট পাচার হয়ে গেলো, এটাকে মনিটর করেছে আরেকটা দেশ । আমি দেশের নাম বলতে চাচ্ছি না। আমি কিন্তু কাউকে ধরতে পারলাম না যে কাদের মাধ্যমে টাকা হ্যাক করা হলো? কিন্তু আমাদের দেশের কোনো কোম্পানি করলে কিন্তু ভয় পেতো যে একাজটা আমি করলে কিন্তু ধরা পড়বো । এখানে আমার পরিবার আছে, বাড়িঘর আছে । সুতরাং যদি দেশি সফটওয়ার ব্যবহার করা হয় তাহলে কিন্তু অনেকগুলো সুবিধা আছে ।

আবগারি শুল্ক ও আয় কর
একটা জিনিস নিয়ে বেশি কথা হচ্ছে তা হলো আবগারি শুল্ক । আবগারি শুল্কের কারণে বড় বড় জিনিসগুলোও চাপা পড়ে গেছে। এটা একটা ছোট জিনিস, বড় হলো ভ্যাট বা কর । আবগারি শুল্ক আগেও ছিলো । এটা আগে ছিলো ২০ হাজার থেকে ১ লাখের মধ্যে। এটা বন্ধ করে দিয়েছে । ১ লাখ টাকায় আবগারি শুল্ক ছিলো ৫শ টাকা সরকার তা ৩শ’ টাকা বাড়িয়ে ৮ শ’ করেছে । তো আপনি ৫শ’ দিচ্ছিলেনই ওটা ৩শ’ বেড়ে ৮শ’ হয়েছে । এটা কিন্তু বড় কোনও ইস্যু নয়। বরং এর কারণে বড় বড় ইস্যুগুলো হারিয়ে যাচ্ছে । আমরা সাধারণ মানুষ এটা চিন্তা করে ভ্যাটের চিন্তা থেকে দূরে চলে গেছি। আবগারি শুল্ক নিয়ে বড় কোনো ইফেক্ট আসবে। না বছরে ৩শ টাকার প্রভাব তেমন বড় কিছু না ।

আয় কর হলো যে বেশি আয় করবে তাকে বেশি টাকা দিতে হবে। আয় কর হবে ধনীদের জন্য বেশি গরিবদের জন্য কম। আমার মতে সরকারের আয় করটা আরো বাড়ানো দরকার । আমাদের দেশে এখনো ৭০ ভাগ মানুষ নিম্ন মধ্যবিত্ত বা এর নিচে । তো আপনি যদি ভ্যাট কিংবা অবগারি শুল্ক বাড়ান তাহলে কিন্তু পুরো পণ্যের দাম বেড়ে যাবে । আমি যদি দুই টাকা আয়ের মানুষও হই আমাকে যেমন ৭০ টাকা দামে চাল কিনতে হবে একজন ধনীমানুষকেও ৭০ টাকা দাম ধরে চাল কিনতে হবে । এটা কিন্তু সবার উপরেই প্রভাব ফেলছে। কিন্তু যখন আপনি ইনকাম ট্যাক্সের উপর নির্ভর করবেন বেশি করে, তখন আমার আয় বেশি হলে আমাকে কর বেশি দিতে হবে আয় কম হলে করও কম দিতে হবে । এটা কিন্তু অর্থনীতির সূত্র । সরকারে উচিত আয় করের আওতা আরও বাড়ানো ।

বাজেট হতে হবে গরিবদের জন্য
বাজেট প্রথমত হবে দরিদ্রদের জন্য। আপনি যাই করেন না কেন মধ্যবিত্তদেরও বাঁচিয়ে রাখতে হবে, দেখতে হবে বাজেটের বড় একটা সুবিধা যেন তারা পায়। দ্বিতীয়ত আমি বলবো, আমাদের বাজেটে তরুণদের নিয়েও ভাবতে হবে। এবারের বাজেটে তরুণদের নিয়ে কোনও আলোচনা নেই। একজন তরুণ উদ্যোক্তা,তার মেধা আছে যোগ্যতা আছে কিন্তু তার ফান্ড নেই। এই তরুণদের জন্য কম সুদে ঋণ দিতে হবে। সরকারই পারে তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি করতে। যদিও সরকার বলছে ইএফ আছে আসলে এই ইএফট শুধুা তরুণদের জন্য নয়। এটা সবার জন্য। তরুণদের নিয়ে বিশেষ বরাদ্দ থাকলে একটা চাপ থাকবে যে তরুণরা ঋণটা নিয়েছে কি না ? তখন ওই বরাদ্দটা কতটুকু ব্যবহার হলো জানা যাবে? যখন আপনি ইএফের কথা বলছেন, তখন কিন্তু ১০০ কোটি বরাদ্দ ছিলো তার থেকে ৮০ কোটি চলে গেছে। খুব ভালো। কিন্তু কে নিলো সেটা আপনি জানতে পারছেন না । আর সব শেষে আমি বলব, আপনারা খুব বড় একটি বাজেট দিয়েছেন, প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকার। আমরা খুশি। বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করবেন না । যে ব্যবসায়ীর দেয়ার আছে কাছ থেকে নিবেন কিন্তু হয়রানি করে নিবেন না । তাদের মনোবল ভাঙবেন না। এটা আমার অনুরোধ রইলো । আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যত বড় বাজেট দিয়েছেন যদি ইনকাম ট্যাক্স সেলে এর বাস্তবায়নের টার্গেট দিয়ে দেন তারা কিন্তু ব্যবসায়ীদের হয়রানি করবেই ।

শাখাওয়াত হোসেন মামুন
ভাইস চেয়ারম্যান
ভাইয়া গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ