আমার বাড়ি আমার খামার কুমিল্লার গ্রামীণ হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দেখাচ্ছে আলোর মুখ

‘শেখ হাসিনার উপহার, ‘আমার বাড়ি আমার খামার’, বদলাবে দিন তোমার আমার’ এ সেøাগানকে সামনে রেখে দারিদ্র্য নির্মূলে সরকার কুমিল্লায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। যার ফলে কুমিল্লার উপকার ভোগীদের আয় বৃদ্ধি পেয়ে দারিদ্র্যমুক্তি ঘটছে প্রায় ৭০ হাজার দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের। আমার বাড়ি আমার খামার, এ প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার এক দিকে কুমিল্লার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে যেমন সুসংগঠিত করছে, অন্যদিকে সঞ্চয়ের উৎসাহ প্রদান ও সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মকর্ম সংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করছেন। কুমিল্লার প্রতিটি বাড়িকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত কুমিল্লা গড়তে বহুমাত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, কুমিল্লায় এ প্রকল্পের আওতায় সরকার ৬৯ হাজার ৬৮২টি পারিবারিক খামার গড়ে তুলেছে। এর মাধ্যমে কুমিল্লার গ্রামীণ হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন মানের উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এ প্রসঙ্গে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের কুমিল্লার জেলা সমন্বয় কারী মোঃ নাজমুল হক জানান, ‘সরকার এ প্রকল্পের আওতায় তহবিল সংগ্রহ ও খামার গড়ে তোলার মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য কুমিল্লায় দরিদ্র মানুষের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তিনি জানান, এ পর্যন্ত কুমিল্লায় মোট ৩ হাজার ৫৬টি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ৭০ হাজার দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষ প্রকল্পের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে তাদের জীবন মান উন্নত করছে। তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মোট ২৩ কোটি ৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা সঞ্চয় করেছে এবং সরকার এ সঞ্চয়ের সঙ্গে ২১ কোটি ৭৮ লাখ ৮৭ হাজার টাকা সঞ্চয় বোনাস দিয়েছে। শুধু তাও নয় সরকার এছাড়াও আবর্তক ঋণ তহবিল হিসেবে ৬৭ কোটি ১২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। কুমিল্লার ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের আওতাধীন পল্লী সঞ্চয়ী ব্যাংক (পিএসবি) এর জেলা কার্যালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা মুনতাজের রাশেদী বলেন, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক (পিএসবি)’র ১৬টি শাখা থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে কুমিল্লার ১৬টি উপজেলায় মোট ৫০,৫১৯ জন দরিদ্র ও অতি দরিদ্র পরিবারকে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, জামানত-বিহীন আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে এবং তাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে একটি চক্রবৃদ্ধি ঋণ প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসছে। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে পিএসবি গ্রামীণ দরিদ্রদের জামানত-বিহীন ঋণ সরবরাহের মাধ্যমে সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের বিশেষত মহিলা উদ্যোক্তাদের আর্থিক সেবা সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার বেলঘর উত্তর ইউনিয়নের উন্দ্রানিয়া গ্রামের মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাড়ি, আমার খামার থেকে তিনি যে উপকার পেয়েছেন তা বলার মত নয়। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে বিভিন্ন কাগজপত্র, সুদ, ঘুষ দিতেহয়। আর সেখান থেকে তিনি সহজ শর্তে দুফায় ৪৫ হাজার ঋণ নিয়ে একটি গরু কিনেছেন। বর্তমানে গরুটির মূল্য ৮০ হাজার টাকা। সরকারের এ প্রকল্পটি কথা যদি আরও ৫ বছর আগে জানতম তাহলে আরো আগেই বেশি উপকৃত হতাম।’

কুমিল্লা আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১৬টি উপজেলায় এ প্রকল্প এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক কার্যক্রম চলছে। এর আওতায় প্রতিটি পরিবার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। তাদের নিজস্ব সঞ্চয় তহবিল রয়েছে ৬১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। সঞ্চয়ের বিপরীতে বোনাস রয়েছে ৫১ কোটি ৮৮ লাখ ২ হাজার টাকা। আর সরকার প্রদত্ত আবর্তক তহবিল আছে আরও ১১৭ কোটি ২১ লাখ ৪ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে সরকারের সঞ্চয় বোনাস জমা হয়েছে প্রায় ১৬৮ কোটি ৪২ লাখ ৬ হাজার টাকা। বর্তমানে কুমিল্লায় এ প্রকল্পে মোট তহবিল রয়েছে দুইশ ৫৬ কোটি ৩২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এ তহবিলের কোনও অর্থই সরকার কখনও ফেরত নেবেনা। মুন তাজের রাশেদীন আরও বলেন, পিএসবি গ্রামীণ মানুষদের স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করতে তাদের জন্য বিপুল সুযোগ তৈরি করছে। পিএসবি কৃষি-শিল্পসরঞ্জাম, গরু মোটা-তাজাকরণ, দুধের গাভী পালন এবং খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি, সবজি ও মশলা উৎপাদন এবং কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্রশিল্প, কুটিরশিল্প, ফিশারিজ ও নার্সারি প্রতিষ্ঠার জন্য ঋণ দিয়ে থাকে।

কুমিল্লার হোমনা উপজেলার দুলালপুর ইউনিয়নের গারচর গ্রামের মমতাজ উদ্দিন। তিনি জানান, স্বপ্ন ছিল বিদেশ গিয়ে পরিবারের দুঃখ-কষ্ট দূর করবো কিন্তু তা হলো না। বিদেশ গিয়ে আবার নিজ দেশে ফিরে আসি ২০১৪ সালে। তারপর কী করব ভেবে পাচ্ছি না। নিজ এলাকার অনেকের কাপড়ের ব্যবসা দেখে শখ হয় নিজেও ফেরি করে কাপড় ব্যবসা করা। কিন্তু তাতে তেমন লাভজনক না হওয়ায় তিন বছর পর পেশা বদলি করে নিজের ৩০ শতক জমির উপর সবজি বাগান ও গাভী পালন শুরু করি। এরপর ২০১৭ সালে আমার সাফল্য আসায় কিছু টাকা লোন করে নিজের জমির পাশে আরো ৪০ শতাংশ জমি ক্রয় করে পুকুর কেটে মৎস্য চাষ শুরু করি। এখন বছরে ১০-১২ লাখ টাকা আয় করছি। আমার নিজ খামারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান পরিদর্শন করে খুশি হয়েছেন। তারা আমার নিজে গড়া খামারকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। সরকারের আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের বিভিন্ন উঠান বৈঠক এখন আমার বাড়ির চত্বরে হয়ে থাকে। এ অনুষ্ঠানে আমার নিজ এলাকার কৃষকদের উঠান বৈঠকের মাধ্যমে সচেতন করা হয়। আমার খামার দেখে এলাকার অনেক কৃষক উদ্বুদ্ধ হয়ে খামার করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। হোমনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাপ্তি চাকমা বলেন, মমতাজ উদ্দিন একজন পরিশ্রমী কৃষক।

গ্রামীণ সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশে তার খামার। আমি তার খামার পরিদর্শন করে মুগ্ধ হয়েছে। সরকারের আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের মাধ্যমে আজ সে স্বাবলম্বী। আমরা চাই মমতাজের মতো জেলার আরো কৃষক খামার গড়ে স্বাবলম্বী হোক। জেলার দাউদকান্দি উপজেলার মারুকা ইউনিয়নের পালপারা গ্রামের নাজমা বেগম বলেন, অন্যের বাড়িতে কাজ করে তার সংসার চলতো। একদিন আমার বাড়ি, আমার খামার প্রকল্প আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে এসে সদস্য করে নেয়। সেখানে সঞ্চয় জমা করে এক সময় আমাকে ১০ হাজার টাকা ঋণ দেয়া হয়। সেই টাকায় আমি কুটির শিল্পের ব্যবসা শুরু করি। এর আগে আমি ব্যবসার উদ্দেশ্যে অনেক চেষ্টা করেও ২ হাজার টাকা ধার বা ঋণ পাইনি। যে কারণে চেষ্টা থাকার পরেও কোন ব্যবসা শুরু করা সম্ভব হয়নি। এক সময় আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের লোকজন আমার জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি নিয়ে আমাকে প্রথমে ১০ হাজার টাকা ঋণ দেয়। যে টাকায় আমার সংসার চলার পরেও বর্তমানে পুঁজি ৫০ হাজারেরও বেশি। এখন আমাকে তারা ১ লাখ টাকাও দিতে রাজি আছে। কিন্তু আমি তা নেইনি। পালপারা গ্রামের মমিনা বেগম, হোসনেয়ারা বেগম, চশুই গ্রামের সেকেন্দার আলী, মেস্তাক মিয়াসহ এ এলকার শত শত নিম্নবিত্তের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের কল্যাণে। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর জানান, সঠিক প্রকল্প গ্রহণ, অক্লান্ত প্রচেষ্টা, সঠিক উপকারভোগী নির্বাচন, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কারণে তেমন কোনও অনিয়ন ও দুর্নীতি না থাকায় প্রকল্পটি ভালো করেছে। এছাড়া যে ব্যক্তি যে কাজে উপযোগী তাদের সেই ধরনের কাজ দেওয়া এবং উৎসাহ দেওয়াসহ আয়বর্ধন কাজে নিয়োগ করার মাধ্যমে কুমিল্লায় আমার বাড়ি, আমার খামার প্রকল্পটি সফলতার মুখ দেখছে। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান