ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার এখন উপকূলীয় অঞ্চলের বাতিঘর

প্রত্যন্ত এলাকায় জীবিকার পথ দেখাচ্ছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি)। তথ্য আদান-প্রদান আর সেবামূলক কার্যক্রমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে তরুণ সমাজ দুনিয়া জোড়া নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। সামাজিক নেটওয়ার্ক প্রত্যন্ত তরুণ সমাজের কাছেও দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে।

যেখানে কয়েক বছর আগেও এখানকার মানুষকে খবর দেখতে বাজারের দোকানে রাত ৮টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। তখন চা দোকানগুলোতেই কেবলমাত্র টেলিভিশন রাখা হতো। খবর শুনতে হলে দোকানে খরচ করতে হতো ৫-১০ টাকা। খবরের কাগজের খবর পড়তে অপেক্ষা করতে হতো দিনের পর দিন। সেই উপকূলের চিত্র আমূল বদলে গেছে। প্রশিক্ষণ পেয়ে এবং ইউডিসি’র সহযোগিতায় সহজলভ্য হয়েছে ইন্টারনেট আর স্মার্ট ফোনের ব্যবহার। মিলছে দেশ-দুনিয়ার সব খবর, মুহূর্তেই।

ইন্টারনেট প্রতিনিয়তই সহজ করে দিচ্ছে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। একই সাথে বিভিন্ন সেবামূলক কাজে উদ্যোক্তাদের আয়-রোজগার বাড়ছে দিন দিন।

এক কথায় বলতে গেলে শূন্য থেকেই শুরু। সম্বল মাত্র একটি কম্পিউটার আর দু’খানা চেয়ার-টেবিল। এগুলো নিয়েই জেলার উপকূলীয় উপজেলা সুবর্ণচরের চরবাটা ইউনিয়নে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের কাজ শুরু করেছিলেন উদ্যোক্তা জোবায়ের ইসলাম। ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের বাইরে পুরোনো ভবনের একটি কক্ষে ইউডিসি’র কাজ চলে। সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ।

সুবর্ণচরের চরবাটায় তথ্য আদান-প্রদান আর প্রযুক্তি সেবার সব কাজই উদ্যোক্তা জোবায়ের ইসলামকে ঘিরে। শুধু চরবাটা ইউনিয়ন নয়, আশপাশের এলাকা থেকেও বহু লোকজন তার কাছেই ছুটে আসেন। প্রতিদিনের চাকরির বিজ্ঞাপন, ভর্তির তথ্যাবলী জানা, কোথাও অনলাইনে আবেদন পাঠানো, ছবি স্ক্যান করা, পাসপোর্টের আবেদন করা, এমনকি বিমানের টিকেট বুকিংয়ের জন্যও লোকজন এখানেই ছুটে আসেন। এই জনপদে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার যেন এলাকার বাতিঘর হয়ে উঠেছে।

ইউডিসি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ৮০ ভাগ সফল বলে দাবি করেন জোবায়ের ইসলাম। তিনি বলেন, এলাকার মানুষ যেসব কাজের জন্য আগে ৩৫ কিলোমিটার (ক্ষেত্র বিশেষে ৫০ কিলোমিটার) দূরের জেলা সদরে যেতেন, সে কাজ এখন এখানে বসেই সম্পন্ন করেন।

বিমানের টিকিটের জন্য এখানে লোকজন আসেন। কৃষি বিষয়ক তথ্যের জন্য কৃষকেরা আসেন। ছাত্ররা ভর্তির খোঁজ-খবরের জন্য অসেন। পরীক্ষার ফল জানা, বিসিএস পরীক্ষার আবেদন করার জন্যও এখানে অনেকেই আসেন। অনেক ক্ষেত্রে কোনো সেবা ব্যয় নেওয়া হয় না।

ইউডিসিতে সেবা নিতে আসা একজন জানালেন, এলাকায় জলদস্যুদের তৎপরতা সম্পর্কে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ মহলকে কিছুতেই জানাতে পারছিলাম না। অবশেষে ইউডিসিতে এসে ই-মেইলে আবেদন পাঠালাম। আবেদন পেয়েই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দস্যুদের তৎপরতাও কমেছে। তথ্য-প্রযুক্তির সেবা নিয়ে সফল হয়েছে এলাকাবাসী।

শুরুর প্রসঙ্গ তুলে উদ্যোক্তা ও মাস্টার ট্রেইনার জোবায়ের ইসলাম বললেন, এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। স্থানীয় পর্যায়ে ছোটোখাট কম্পিউটারের ব্যবসার অভিজ্ঞতা ছিল। একদিন চরবাটা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব তাকে প্রস্তাব দেন ইউডিসিটি পরিচালনার।

নিজের ব্যবসা সচল রেখেই জোবায়ের ইসলাম এখানে কাজ শুরু করেন। খুব বেশি দিন সময় লাগেনি। কঠোর পরিশ্রমে মাত্র এক মাসের মাথায় ইউডিসিতে ভালো ফল পাওয়ায় আগের ব্যবসাটি ছেড়ে দেন জোবায়ের। এখানেই দিনে দিনে তার রোজগার বাড়তে থাকে।

ইউডিসি’র কাজের সফলতা দেখে এটুআই থেকে জোবায়ের ইসলামকে কারিগরি বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করতে বলা হয়। আবেদন করা হলে বোর্ড থেকে পরিদর্শন করে অনুমোদন দেওয়া হয়।

কারিগরি বোর্ডের অনুমোদন পাওয়ার ফলে এই ইউডিসি ‘অফিস অ্যাপ্লিকেশন’ ও ‘ডাটাবেজ’ নামের দু’টি প্রোগ্রাম নিয়ে তিন ও ছয় মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ শুরু করে। এ সময়ে কম্পিউটার কেনার জন্য কিছু অর্থেরও প্রয়োজন পড়ে।

এনজিও থেকে ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এর সঙ্গে নিজের কিছু টাকা যোগ করে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ইউডিসি’র সঙ্গে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলেন জোবায়ের। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফল করছেন।

প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রথম সেশনে ‘অফিস অ্যাপ্লিকেশন’ প্রোগ্রামে পরীক্ষা দেন ২৬ জন শিক্ষার্থী। এরমধ্যে ১৮ জন জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। দ্বিতীয় সেশনে ৩০ জন পরীক্ষা দিয়ে ২৬ জন জিপিএ-৫ এবং চারজন জিপিএ ৪ পেয়েছেন। জুলাই-ডিসেম্বর সেশনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৮১ জন।

ইউডিসি’র খরচ বাদে মাসিক আয় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। কাজের সুবিধার্থে জোবায়ের ইসলাম এই ইউডিসিতে বেশ ক’জন উদ্যোক্তা তৈরি করেছেন। উদ্যোক্তা হিসেবে আছেন জোবায়ের ইসলাম ও সালমা খানম এবং বিকল্প উদ্যোক্তা হিসেবে আছেন রাশেদা আক্তার সুরাইয়া ও বিশ্বজিৎ চন্দ্র দাস। তারা এই ইউডিসিতেই কাজ শিখেছেন। তারাও এখন মাসে গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করছেন।

এরই মধ্যে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে চরবাটা ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র বেশ কটি পুরস্কার অর্জন করেছে। ২০১১ সালে বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা উদ্যোক্তা নির্বাচিত হয়েছেন জোবায়ের ইসলাম। একই বছর উপজেলা ও জেলা পর্যায়েও শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কার পান। ছয় মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণে ভালো ফল করায় ২০১২ সালে পেয়েছেন কারিগরি বোর্ডের পুরস্কার।

উদ্যোক্তা জোবায়ের ইসলাম জানান, বিদ্যুতের সংকট, ইন্টারনেটে ধীরগতি আর স্থান সংকটই এখানকার প্রধান সমস্যা। চরবাটা ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব ভবন না থাকায় ইউডিসির কাজ চলছে চরবাটার খাসেরহাট বাজারের একটি ভবনের কক্ষে। বেশি লোকজন এলে বসারও জায়গা হয় না। প্রশিক্ষণার্থীদেরও বসতে অসুবিধা হয়।

এসব সমস্যা সত্বেও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা করেছেন উদ্যোক্তা জোবায়ের। নেটওয়ার্ক ভালো পেলে ৫০০ ছেলেমেয়ের বেকারত্ব দূর করার পরিকল্পনা আছে তার। স্থান সংকট দূর হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেবেন। ইন্টারনেট সুবিধা আরও ছড়িয়ে দিতে একটি সাইবার ক্যাফে তৈরির পরিকল্পনাও আছে তার।

জোবায়ের ইসলাম বলেন, বর্তমান মহামারী করোনার কারণে তথ্য সেবায় অনেকটাই ধীরগতি। উপকারভোগীরা খুব জরুরী প্রয়োজন ছাড়া এখানে আসেন না। তাই অনেকটা কর্মহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। তথ‌্য-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান