উন্নত খাবার ও ব্যবস্থাপনা মাছ চাষে সাফল্য আনতে পারে

আমাদের দেশে প্রচলিত প্রবাদ আছে, মাছে ভাতে বাঙালি। তার কারণ, আমাদের মাঠে ধান হতো। আর ধান কেটে এনে, ঢেঁকিতে ভেঙ্গে, চাল পাওয়া যেত। আর বিলে বা পুকুরে মাছ হতো । এটা ন্যাচারেলি হতো, কিছু করা লাগতো না। নদীতে মাছ পাওয়া যেতো। মাছ এনে রান্না করে খেতো। আর এদিকে ধান থেকে চাল হতো। তাই  মাছে ভাতে বাঙালি বলাটা বাস্তব সম্মত ছিল। এখন কিন্তু অবস্থাটা পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন হওয়ার পিছনে কারণ হলো, আগের সে খাল বিলের মাছ এখন আর পাওয়া যায় না। খাল-বিলে প্রায়ই পানি থাকে না। এই খাল বিলের পানি অনেক জায়গায় দূষণীয় হয়ে গেছে। আর এটাও ঠিক যে আগের মত ওভাবে ধান হয় না। কারণ ওভাবে ধান চাষ করলে লাভ হবে না। এখন উন্নত জাতের ধান আসছে।এগুলি পরিচর্যা করতে হয়, সার দিতে হয়, পানি দিতে হয়, কীটনাশক দিতে হয়। তারপর ধান কাটলে সেখানে লাভ হয়। যদিও কথা হচ্ছে, মাছে ভাতে বাঙালি কথাটার প্রচলন আছে, কিন্তু বাস্তবতা  সে অবস্থায় নেই। পরিবর্তন টা কি হয়েছে? আমরা এখন থেকে যদি ১০ বছর আগের হিসাব  দেখি, তখন কিন্তু খাল-বিলে ৬০ ভাগ মাছ পাওয়া যেত । এখন খাল বিলের মাছ কমে গেছে। আর বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় ৬০ ভাগ। এই মাছগুলো আগে যেসব পুকুর ছিল, সেগুলোকে সুন্দর করে কেটে পরিষ্কার করে সেখানে মাছ চাষ করা হচ্ছে। নতুন ক্ষেত কেটেও মাছ চাষ করা হচ্ছে। এই কাজগুলো আমাদের স্থানীয় যুবসমাজরা করছে। অথবা ঢাকা শহরে চাকরি বাকরি অথবা ব্যবসা করে, তারাও গ্রামে লোকজন  দিয়ে এ কাজগুলো করাচ্ছে।

যেহেতু মাছ চাষে বিনিয়োগ হয়েছে, অন্যের কাছ থেকে দেখে শিখেছে। বেশ লাভজনক ব্যবসা হিসেবে অনেকে করছে। তাই এখন পুকুরের মাছ অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে।  ছোট মাছ বলেন, মাঝারি বলেন, আর বড় বলেন, এই মাছগুলো বাণিজ্যিকভাবে তারা চাষ করছে। আপনারা শুনে অবাক হবেন, আগের যুগে একটা ছোট মাছের বাচ্চা ছেড়ে দেওয়ার এক বছর না হলে তিন-চার কেজি হতো না। এখন চার পাঁচ মাসেই রুই, কাতলা তিন থেকে চার কেজি হয়ে যাচ্ছে। এর পিছনে কারণ হলো, এসব মাছের পোনার কোয়ালিটি ভালো। পানির কোয়ালিটি মেইনটেইন করা হচ্ছে। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য যেভাবে ভাইব্রেটার করা প্রয়োজন, সেটা করা হচ্ছে। মাটিতে পানির ভিতরে কিছু কিছু জিওলাইট দেয়া হচ্ছে। যার ফলে নাইট্রোজেনের জায়গায় অক্সিজেন বেশি হচ্ছে। তাতে মাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকছে। যেহেতু পানিতে জঙ্গল বা অপরিষ্কার ঘাস নেই, তাই মাছ অনায়াসে বিচরন করতে পারছে। সূর্যের আলো ভালোমতো প্রবেশ করতে পারছে। সেজন্যে ন্যাচারাল যে প্লান্টন তৈরি হচ্ছে এবং সেটা মাছ খেয়ে কিন্তু যথেষ্ট বড় হচ্ছে। তারপরও সুষম খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব খাবার তিন রকমের হয়। এক রকমের খাবার আছে যেগুলো একেবারে পানির নিচে থাকে। আরেকটা আছে যেটা পানির মাঝামাঝি ভেসে থাকে। আরেক রকমের আছে যেগুলো পানির একেবারে উপরে ভাসে।  যেসব মাছ পানির উপরের খাবার খায়, তারা উপরে পানিতে ভাসা খাবারগুলো খায়। আর যেসব মাছ পানির মাঝামাঝি  অংশ থেকে খাবার খায়, তারা মাঝামাঝি অংশে যে খাবারগুলো থাকে, সেগুলো খেয়ে নেয় এবং যেগুলো একেবারে নিচের অংশে থাকে, তারা নিচের খাবারগুলো খেয়ে থাকে। যেমন রুই মাছ নিচের থেকে খাবার খায়। সে জন্য পানির নিচে থাকা খাবারই এরা খেয়ে থাকে। এভাবেই কিন্তু মাছের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। মাছকে কমার্শিয়ালাইজ করা হচ্ছে। এতে মাছের স্বাদ ও ভালো হচ্ছে। আর মাছ বিক্রি করেও লাভ হচ্ছে।

এখন লাভ হবে কি হবে না, এটা নির্ভর করছে সুষম খাবারের উপর। কারণ এক কেজি মাছ করতে কত কেজি খাবার দরকার, সেটার খুব জরুরি। কারণ খাবারেরতো দাম আছে। অনেক ক্ষেত্রে খাবারের দাম ৪৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা কেজি। মাছ চাষ করতে গিয়ে যদি দুই কেজি খাবার লাগে, তাহলে ১০০ টাকা তো খরচ হয়েই গেল। এরপর পরিচর্যা আছে, পানি আছে, মাছের মটালিটি আছে। খাবারের মান এত উন্নত হয়েছে যে তেরোশো বা চোদ্দোশো গাম খাবার দিলে এক কেজি সাইজের পাঙ্গাস হয়, তেলাপিয়া হয়। রুই কাতলা মাছের ক্ষেত্রে ষোলশো থেকে সতেরোশো গাম খাবার দিলেই এক কেজি হয়ে যায়। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, ১ কেজি কাতলা মাছ উৎপাদন করতে খাবারের দাম লাগছে ৮০ টাকা। অন্যান্য খরচ ২০ টাকা। মোট ১০০ টাকা খরচ হচ্ছে। সে মাছ ১৩০- ১৪০ টাকা বিক্রি করে লাভ হচ্ছে। পাঙ্গাসের ক্ষেত্রে একই রকম পাঙ্গাসের খাবারের দাম কম। এক কেজি পাঙ্গাস উৎপাদন করতে ১.২-৩ কেজি খাবার লাগে। সেখানে খাবারের দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। অন্যান্য খরচসহ ৮০ টাকা খরচ হয়। সেটা ১০০ টাকা বিক্রি করেও লাভ হবে। এভাবে তেলাপিয়ার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তাহলে ফুড কনভার্শন রেশিওটা গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে মাছের যে পোনা, সেটা ভালো মানের হতে হবে। ম্যানেজমেন্ট ভালো থাকতে হবে। মাছের স্বাস্থ্য যাতে ভালো থাকে সেজন্য অক্সিজেন দিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে পানির নিচে মাটিতে জিওলাইট দিতে হয়, যাতে নাইট্রোজেন কমে গিয়ে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে যায়।

আমি বিদেশে দেখেছি কেজ ফিশিং। এখন বাংলাদেশও এটা হচ্ছে। একটা ছোট পুকুরে মাছকে বড় করে কেজিতে দশ-বারোটা হয়ে যায় যখন, তখন ওটা একটা সুন্দর কেজ নেট দিয়ে তৈরি করে নদীর মোহনায় রেখে দিচ্ছে। নদীতে যেহেতু পানির প্রবাহ বেশি এবং সেখানে প্রচুর অক্সিজেন আছে। উপর থেকে যেহেতু প্রোটিন ফীড দিতে পারছে, সেহেতু মাছের গ্রোথও যথেষ্ট ভালো হয়। খাবারের গন্ধ থাকে না। মাছ খেতেও সুস্বাদু হয়। এবং মাছও যথেষ্ট বড় হয়। এভাবে মাছ চাষ করছে। এভাবেই কিন্তু মাছের ট্রানসফর্মেশন হচ্ছে এবং মাছ যথেষ্ট বড় হচ্ছে। মাছ চাষ করতে গেলে এখন আগের নিয়মের কথা ভুলে যেতে হবে। মাছ চাষ করতে গেলে ভালো পোনা লাগবে। মাছের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য পানির কোয়ালিটি ভালো রাখতে হবে। সূর্যের আলো ঠিকমতো পানিতে যেতে হবে। পানি যাতে গরম না হয়ে যায়, সে জন্য যথেষ্ট পরিমাণ গভীরতা থাকতে হবে।খাবারে কোয়ালিটি ভালো রাখতে হবে। তাহলে মাছ চাষ করে লাভবান হওয়া যাবে।

মাছের খাবারের প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হয়, মাছও জীব, মানুষও জীব।  মাছ এবং মানুষের মধ্যে পার্থক্য এতটুকুই মাছ এক ধরনের খাবার খায়।  মানুষ  আরেক ধরনের খাবার খায়। মাছের পাকস্থলী অনেক ছোট। তাই এমন খাবার দেওয়া হয়, যে খাবার অনেক সুষম। যেটা মাছ খাওয়ার পরপরই তাড়াতাড়ি ডাইজেস্ট করতে পারে। যেহেতু মাছের পাকস্থলী সমান, তাই এটা তাড়াতাড়ি মাছের মলদ্বার দিয়ে বেরিয়ে যাবে। সমস্যা হলে ওখানে এফসি আর ভালো হবে না। এই কারণে মাছের খাবারের মান অনেক ভালো হতে হয়। ডিসেন্ট ফুড দেয়া হয়, যেটা মাছ তাড়াতাড়ি হজম করতে পারে। যাতে প্রোটিন থাকে, ফ্যাট তৈরি হওয়ার জন্য সেখানে তৈলাক্ত জিনিস থাকে এবং অন্যান্য এলিমেন্ট থাকে। এই কারণে মাছের খাবার যথেষ্ট ভাল হয়। মাছের যে সমস্ত ফ্যাক্টরিতে খাবার উৎপাদন হয়, তার সবই বিদেশ থেকে আমদানি করা।

আমাদের ফ্যাক্টরি আছে রাজশাহীতে। একশো আশি কোটি টাকা দিয়ে আমরা ফ্যাক্টরি বানিয়েছি। আপনি যদি ফ্যাক্টরির মধ্যে যান, তাহলে আপনার মনে হবে, সেটা মানুষের খাবার উৎপাদন করার ফ্যাক্টরি। ফ্যাক্টরিতে যন্ত্রপাতি যথেষ্ট হাইজেন মেনটেন করা হয়। বাতাসের কোয়ালিটি মেইনটেইন করা হয় এবং ফুডের ফ্লো বিনগুলো হাইজেন রাখা হয়। কোনোরকম হাতের ছোঁয়া ছাড়াই একটি সুইচ দিয়ে এই  ফুডের রেশিও মেনটেইন করা হয়। যে সমস্ত নিউটিশনগুলো লাগবে, যেগুলোতে মাছের গ্রোথ হয়, ভালো মাইক্রো এলিমেন্ট লাগবে, সবগুলোই দেয়া হয়। তাহলে মোটামুটি ভাবে বলা যায়, মানুষের খাবারের যে গুণ, তার চেয়ে অনেক ভালো  গুণের খাবার মাছ কে দেয়া হয়। ফলে মাছ এটা তাড়াতাড়ি ডাইজেস্ট করতে পারে, ওয়েস্ট হয় কম এবং সর্বোপরি মাছের গ্রোথ ভালো হয়।

করোনার সময়ে অনেক মানুষ ঢাকা থেকে গ্রামে চলে গেছে। তারা অনেকে নিজেরাই মাছের চাষ শুরু করেছে। অথবা আত্মীয় স্বজনের সাথে কিছু পুজি দিয়ে চাষ করছে। বা কেউ মাছ চাষ করে, একটা পুকুর আছে, তারা আরও কয়েকটি পুকুর একসাথে নিয়ে চাষ করছে। তারা মাছ চাষ সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না, কারওটা দেখে শিখছে। অথবা ট্রেনিং নিচ্ছে। অথবা আমাদের যে সমস্ত রিপ্রেজেন্টেটিভ আছে বা মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা আছে, ওরা এদের ট্রেনিং দিয়ে দিচ্ছে।  ফলে এরা পুকুর সিলেকশন, পুকুরের পানির কোয়ালিটি মেইনটেইন, অক্সিজেন মেইনটেইন, হাইজেন, হেলথ মেইনটেইনের দিকে তাঁরা যথেষ্ট নজর দিচ্ছে। মাছের ভালো পোনা সংগ্রহ করছে। ভালো পোনা ছাড়া মাছের গ্রোথ ভালো হবে না। মাছের ভালো খাবারও দিচ্ছে। ফলে ওভারঅল মাছের গ্রোথ ভালো হচ্ছে। বিক্রি করেও তারা লাভবান হচ্ছে।

এটা যেহেতু নতুন একটা প্রফেশন অনেকের জন্য। তাই তারা সাবধানে বিনিয়োগ করছে। ধীরে ধীরে তারা শিখে ফেলবে। এটা কঠিন কোন কাজ না। অন্যের থেকে দেখে শিখবে, শুনে শিখবে অথবা পড়াশোনা করে শিখবে। আলটিমেটলি দেখা যাবে তারা গ্রাম থেকে শহরে আসতে চাইবে না। উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। নতুন উদ্যোক্তা মাছ চাষে অনেক বিনিয়োগ করছে।

আমাদের সারাদেশে প্রায় ৬০০ কর্মী আছে। এর মধ্যে যারা পড়াশোনা করে গ্রাজুয়েট  হয়েছে, এদের সংখ্যা অনেক বেশি এবং খাদ্য ও পুষ্টির ওপর পড়াশোনা করা লোকও আছে। তারা গ্রামে গঞ্জে কাজ করছে কাস্টমার সার্ভিস হিসেবে। তারা মাঝে মধ্যে ট্রেনিং দিচ্ছে। আমাদের যেসব ডিলারদেরকে আমরা ট্রেনিং দিয়েছি, তারা এ সমস্ত কাস্টমারদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে।প্রয়োজনীয় যে সমস্ত রসদ লাগে, মাছের ঔষধ, খাবার পিউরিটি মেইনটেইন করার জন্য, পানিতে প্রয়োগের যে সমস্ত মেটেরিয়াল লাগে হাইজেন মেইনটেইন করার জন্য, সেসব ডিলারদেরকে সরবরাহ করছে।

আমাদের যুব সমাজ যদি মাছের চাষ করতে যায় তাহলে নিজের পুঁজি দিয়ে শুরু করতে হচ্ছে। তারা যদি ভালো করে, আস্তে আস্তে যদি ব্যাংকের কাছে যায়, ব্যাংক যদি দেখে যে সে ব্যবসায় ভালো করছে, হয়তো সাপোর্ট দেবে।

আমি বরাবরই বলে এসেছি, কৃষি উদ্যোক্তা ফাউন্ডেশন করা দরকার। যার মাধ্যমে এরা সবাই মাছ চাষে ট্রেনিং পাবে। সাথে সাথে এদের ফান্ডিং করতে পারবে ফাউন্ডেশন থেকে। তাদের ইন্টারেস্ট খুব বেশি দেয়া লাগবে না। ইদানিংকালে কোনো ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির কাছ থেকে বা অন্য কোনো ফাউন্ডেশন থেকে সরাসরি ফান্ডিং পায় না অনেকেই। সেক্ষেত্রে তাদেরকে অনেক বেশি ইন্টারেস্ট দিতে হয়। কৃষি উদ্যোক্তা ফাউন্ডেশন থেকে কম ইন্টারেস্টে ফান্ডিং পাবেন। ‌এখান থেকে তারা ট্রেনিং পাবে ও সফলভাবে মাছের চাষ করতে পারবে।

আমি মনে করি একটা বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী কৃষি বা খামার উদ্যোক্তা ফাউন্ডেশন করতে পারেন। তাহলে ওভারঅল কৃষিতে, মাছে, মুরগিতে এবং গরুর খামার  সর্বক্ষেত্রে ভালো সফলতা পাওয়া যাবে।

ড. এফ এইচ আনসারী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী, এসিআই এগ্রিবিজনেসেস।