পুঁজিবাজারে এজিএম-পার্টির দৌরাত্ম্য বন্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) হস্তক্ষেপ চেয়েছেন ভুক্তভুগীরা। গত ১৮ জুন বিএসইসি চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
চিঠিতে তারা হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, এজিএম-পার্টি নামের সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি,অত্যাচার ও নিপীড়ন দিন দিন যেভাবে বাড়ছে, কোম্পানির ব্যবস্থাপনার সাথে যারা জড়িত কর্মকর্তাদের চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। এছাড়া একসময় পরিচালকরাও বাধ্য হবেন নিজ নিজ কোম্পানি গুটিয়ে নিতে।
চিঠির পরতে পরতে সংশ্লিষ্টদের অসহায়ত্ব, ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ পেয়েছে। এতে অভিযোগ করা হয়, এজিএম-পার্টির সদস্যরা যে বছরের পর বছর ধরে এজিএমের নামে চাঁদাবাজি করছে, তা জেনেও বিএসইসি নির্বিকার। তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
চিঠিতে এজিএম-পার্টির অপতৎপরতা বন্ধের উদ্যোগ নিতে বিএসইসি চেয়ারম্যানের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়ে ভুক্তভুগীরা বলেন, এদের অত্যাচার থেকে আমাদের রক্ষা করেন, নইলে দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন।
উল্লেখ, গত দুই দশক ধরে পুঁজিবাজারে এজিএম-পার্টি নামে পরিচিত কিছু ব্যক্তি তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে বেপরোয়া চাঁদাবাজি করে চলছে। এরা কোম্পানিগুলোকে এজিএম ম্যানেজ করে দেওয়ার বিনিময়ে চাঁদা দাবি করে। তাদের প্রস্তাবে রাজি না হলে এজিএমে গন্ডগোল করা, কোম্পানির চেয়ারম্যান-এমডিকে অপদস্ত করার হুমকি দেয়। উটকো ঝামেলা এড়াতে কোম্পানিগুলো এদের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয়।
বছরের পর বছর ধরে পুঁজিবাজারে এই অনাচার চললেও তা বন্ধে বিএসইসি কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং তারা কোম্পানি আইনের কথা বলে দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের ভাষ্য, কোম্পানি আইন অনুসারে কোম্পানির এজিএমে যোগ দেওয়া ও কথা বলার বিষয়ে প্রত্যেক শেয়ারহোল্ডারের অধিকার আছে। কথিত এজিএম-পার্টির সদস্যরা এই সুযোগটির অপব্যবহার করছে।
তবে কোম্পানিগুলো বিএসইসির এই বক্তব্যের সঙ্গে পুরো একমত নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কোম্পানির দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, আজ পর্যন্ত বিএসইসি এজিএম-পার্টির দৌরাত্ম্য বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এজিএম-পার্টির উৎপাত বন্ধে কী করা যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেটলি লিস্টেড কোম্পানিজ বা অন্য কোনো স্টেকহোল্ডারের কাছ থেকে মতামতও চায়নি।
বিএসইসি চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মন ও ক্ষোভের সাথে আপনার নিকট আকুল আবেদন এই যে, আমরা পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানিসমূহ তথাকথিত এজিএম পার্টির অত্যাচার ও চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ। এজিএম পার্টি নামক সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি,অত্যাচার ও নিপীড়ন দিন দিন যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে ব্যবস্থাপনার সাথে যারা জড়িত তারা চাকরি ছাড়ার ও পরিচালকদের পুঁজিবাজার থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
এজিএম-পার্টির তৎপরতা বন্ধ করা না গেলে কোম্পানি সুশাসনে নেওয়া বিএসইসির বিভিন্ন উদ্যোগ ভেস্তে যাবে মনে করেন ভুক্তভুগীরা।
এ বিষয়ে চিঠিতে লিখা হয়, চাঁদাবাজি ও অত্যাচার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে পুঁজিবাজার সঙ্কটে পড়বে।
বিএসইসির চেয়ারম্যানের উদ্দেশ্যে বলা হয়, আপনারা বিভিন্ন আইন কানুন করে যাচ্ছেন, কর্পোরেট সুশাসনের কথা বলছেন। কিন্তু একটি কোম্পানিকে যদি তার বার্ষিক সাধারণ সভা আয়োজন করার জন্য এজিএম-পার্টিকে বিপুল অংকের টাকা দিতে হয়, তাহলে কোম্পানিতে কিসের সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। এই খরচ লাভ-ক্ষতি হিসাবের কোথায় দেখাবে?
চিঠিতে লিখা হয়, আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে সব কোম্পানি কী টাকা দেয়? আমাদের উত্তর-হ্যাঁ, দেয়। কেউ কেউ সরাসরি টাকা দেয়, কেউ কেউ এজিএম-পার্টির পছন্দের কুরিয়ারকে কাজ দেওয়ার মাধ্যমে টাকা দেয়, আবার কেউ কেউ নাম সর্বস্ব পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে চড়া মূল্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে টাকা দেয়। দেশের কোনো কুরিয়ারে বই পাঠাতে ১০ থেকে ১২ টাকার বেশি লাগে না, অথচ অনেক বেশি মূল্যে তাদের কুরিয়ারকে কাজ দিতে হয়। সরাসরি টাকা নিতে না পারলে নামসর্বস্ব পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে চড়া মূল্যে বিজ্ঞাপনের বিপরীতে তারা টাকা নিয়ে যায়।
আপনাদের প্রশ্ন জাগতে পারে এদের টাকা না দিলে কি হবে? এর উত্তর জানার জন্য আপনাদের অনুরোধ করব- নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সচিবদের সাথে আলাদা আলাদা কথা বলেন; তাহলেই এর উত্তর পেয়ে যাবেন। এদেরকে টাকা না দিলে এরা অফিসে এসে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলে ফোন, মোবাইলে হুমকি দেয়, অফিসে হিজড়া পাঠিয়ে অত্যাচার করে। আর এজিএমে বুঝে না বুঝে ব্যক্তিগতভাবে চেয়ারম্যান, পরিচালক,ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সচিবদের আক্রমণ করে। এজিএমের ভিডিও দেখলেই বুঝা যাবে।
আপনি বলতে পারেন, কেউ তো কখনও অভিযোগ দেয় নাই। দেবে কি করে? বছরের পর বছর যে চাঁদাবাজি চলছে তা জেনেও আপনারা কোনো ব্যবস্থা নেন না। আমাদের অনুরোধ সেক্টরের অভিভাবক হিসেবে স্বঃপ্রণোদিত হয়ে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেন। আমাদের এই চাঁদাবাজদের হাত থেকে রক্ষা করেন।
কারা এই চাঁদাবাজ আপনারা তা অবশ্যই জানেন। অল্প কিছু শেয়ার কিনে এরা নিজেদের মালিক পরিচয় দেয় আর চাঁদাবাজি করে। এরা আর কেউ নয় এরা অতি পরিচিত- সেলিম রেজা, শাহ আলম বাবু, লুৎফুল গনি টিটু, বাদল, আবু সুফিয়ান টিটু, জানে আলম, মতিন শহীদ ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা।
আপনাদের কাছে আমরা হাতজোর করে অনুরোধ করছি, আমাদেরকে এই অত্যাচার থেকে রক্ষা করেন নতুবা পদত্যাগ করেন। বার্ষিক সাধারণ সভা একটি বার্ষিক উৎসব। এতে কোম্পানির প্রকৃত বিনিয়োগকারীদেরকে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিন। সভাটি গঠনমূলক করার সুযোগ করে দিন। এই চিঠির কপি আমরা বিভিন্ন জায়গায় দিচ্ছি যাতে সবাই সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করে কোম্পানিগুলোকে এই বিপর্যয়ের হাত থেকে মুক্তি দিতে পারে।
চিঠিতে এজিএম-পার্টির সদস্য হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের সবার সঙ্গে কলা বলেছে অর্থসূচক। এদের সবাই তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করছেন।
আজকের বাজার: এলকে/এলকে ৫ জুলাই ২০১৭