কর্মমুখী শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াক সরকার : রিজওয়ান খান

আমাদের বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় বরাবরই কম থাকে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে শিক্ষাবিদেরা বলছেন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নতি হবেনা। আর মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার বিকল্প কিছু নেই। বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টরন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. রিজওয়ান খান দেশের শিক্ষা বরাদ্দ, শিক্ষার মান, কর্মমুখী শিক্ষায় যত্নবান হওয়া, কারিগরি শিক্ষা, উচ্চশিক্ষায় করণীয় ইত্যাদি নানা বিষয়ে আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন,এবি টিভির সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর কথপোকথনের বিশেষ বিশেষ অংশের অনুলিখন তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

বাজেট ও শিক্ষা খাত
আমাদের দেশে শিাখাতে বাজেট সবসময় কম থাকে। আমার ধারণা এবারও এ খাতে বাজেট বরাদ্দ কম। আবার শিাখাতের উচ্চশিা ও গবেষণার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এই খাতেরও উন্নয়ন হওয়া প্রয়োজন। আমি আশা করি এ ব্যাপারে সরকার ভবিষ্যতে আরো যতœবান হবেন, কারণ দ মানবসম্পদ দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি। পাশাপাশি কর্মমুখী শিার প্রতিও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ অর্থাৎ ম্যানপাওয়ার দেশের বাইরে রপ্তানি হয়। কাজেই তাদের জন্য টেকনিক্যাল এডুকেশনের দিকে নজর দিতে হবে। আর উচ্চ শিক্ষায় গবেষণা তো আছেই।

টেকনিক্যাল শিক্ষায় নজর দরকার
আমাদের এখানে টেকনিক্যাল বিষয় অনেক কম। ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স আছে দুটো। ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং আর কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং। প্রাইভেট ইউনির্ভাসিটিগুলো টেকনিক্যাল বিষয় খুলতে সাহস পায়না কারণ ছাত্ররা এতো খরচ করে এসব বিষয় পড়তে চায় না। এর বাজার এখনো অনেক বড় হয়নি । আর তা ছাড়া দুই একটার বেশি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট থাকে না কারণ তা অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতে পারে না।

ডিপ্লোমা কোর্স
আমাদের দেশে এ দুটোরই প্রয়োজন আছে। যারা ডিপ্লোমা করছেন তাদের আর যারা স্নাতক ডিগ্রিধারী তাদেরও প্রয়োজন আছে। ডিপ্লোমা কোর্স ও যারা হাতেকলমে শিক্ষা নিয়ে এয়ারকন্ডিশনিং,ওয়েল্ডিং,অটোমোবাইল এবং অটোশপে কাজ করেন তাদের আন্তজার্তিক পর্যায়ে বড় বাজার রয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার আরো কিছু দেশে তারা ভালো কাজ পায়। সবাই যে উচ্চ শিা গ্রহণ করবেন তা নয়। যে সেক্টরে যে ভালো করতে পারবে তাকে সেই সেক্টরেই সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন।

আমাদের টেকনিক্যাল শিক্ষা
যারা ডিপ্লোমা পড়তে আসে তারা বেশির ভাগ আসে কিছুটা অসচ্ছল পরিবার থেকে। এতে করে যা হয় টিউশন ফি কম রাখতে হয়। ভালোমানের ছাত্রও পাওয়া যায় না। এমন কিছু অসুবিধ তো আছেই। আমার কথা হচ্ছে,সমাজে যাদের অবস্থান ভালো তারাও কিন্তু ডিপ্লোমা করে ভালো উর্পাজন করতে পারেন। এ ব্যাপারে প্রচারণার প্রয়োজন। প্রয়োজন মানসিকতা বদলের।

শিক্ষার মান নিয়ে মতামত
যে সব ছাত্র ইউনির্ভাসিটিতে পড়তে আসে তারা এইচএসসি পাস করে আসে। তবে তারা যে ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে আসে তা ইউনির্ভাসিটিতে পড়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, গণিত ও ইংরেজিতে অনেক দুর্বল। এটি আমাদের জন্য আশংকাজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড দুর্বল হওয়ার ফলে ইউনির্ভাসিটি লেভেলের কোর্স পড়ানো কষ্টকর হয়ে যায়। শিক্ষার মান উন্নয়নে এখন শুধু ইউনির্ভাসিটি লেভেল পারবে না, একইসঙ্গে শিক্ষা বোর্ডকেও এগিয়ে আসতে হবে। এইচএসসি পর্যায়ে মান উন্নয়ন করা না গেলে বাংলাদেশের শিক্ষার মান উন্নত হবে না।

ডিগ্রীধারীদের দক্ষতায় ঘাটতি
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, গারবেজ ইন গারবেজ আউট-কাজেই ভালো ইনপুট যদি না আসে তাহলে যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, তাকে একটি নির্দিষ্ট লেভেলের চেয়ে বেশি কোয়ালিফাইড করা যাবে না। কাজেই এইচএসসি পর্যন্ত একটা প্রস্তুতির দরকার তো আছেই, এছাড়া যেহেতু সকল শিা প্রতিষ্ঠানের মান একরকম নয়। তাই মান উন্নয়নের কাজও করতে হবে। এ কাজে সরকার এডুকেশন বডি ফর্ম করছেন, পিআর রিভিউ করছেন। তাই আমি আশা করি আগামি ২-৩ বছরের মধ্যেই ইউনির্ভাসিটি লেভেলে মানগত পরিবর্তন দেখতে পাবো। তবে মান উন্নয়নের জন্য শুধুমাত্র ইউনির্ভাসিটি পর্যায়ে নির্ভরশীল হলেই হবে না, এর আগের কাসের মান উন্নয়নের দরকার আছে।

আমাদের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা
আমাদের দেশে শিক্ষকদের বেতন যথেষ্ট বাড়ানো হয়েছে। অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর সাথে তুলনা করলে হবেনা কারণ আমরা সে দেশের মতো এতটা অ্যাফোর্ড করতে পারবো না। এখন শিকদের বেতন অনেক বেড়েছে তবে আরও একটু বাড়ালে ভালো হয়। আর যদি সরকার সত্যি শিার মান উন্নত করতে চায় তবে শিক এবং শিার্থী উভয় ক্ষেত্রেই মান বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। প্রাইমারি থেকে ইউনির্ভাসিটি লেভেল পর্যন্ত মান ঠিক রাখতে হবে। এখন যেমনটি দেখা যায় যে বিভিন্ন ইউনির্ভাসিটিতে প্রফেসর পাওয়া না গেলে এমন কাউকে প্রফেসর বানানো হচ্ছে যার প্রফেসর হওয়ার যোগ্যতা নাই। শিায় আপোষ করলে কোয়ালিটি কমে যাবে। শিার মান উন্নয়নে অবশ্যই শিকদের উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

বর্তমান বাজেটে শিক্ষা নিয়ে প্রত্যাশা
আমি মনে করি, গবেষণা খাতকে আরও প্রণোদনা দেয়া উচিত এবং উচ্চ শিার জন্য সরকারের বেশি উৎসাহ থাকা উচিত । যারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চান তাদের জন্য সরকার চাইলে অন্যান্য দেশের সাথে চুক্তি করে টিউশন ফি কম করে নিতে পারেন। স্কলারশিপ যদি বাড়ানো যায় তাহলে উচ্চ শিতি লোকের পরিমাণ বাড়বে ফলে আমাদের দেশে মানসম্মত শিক্ষকের সংখ্যাও বাড়বে।

সোলারের উপরে ট্যাক্স
বাজেটে সোলার পিভির উপর যে ট্যাক্স বসানো হয়েছে তাকে অনেকেই অজুহাত হিসেবে দেখছেন। দেশে যে সোলার পিভি কারখানাগুলো আছে তাদের উৎসাহিত করা দরকার যাতে তারা আমদানি করা সোলার পিভির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে। কিন্তু আমার ধারণা হলো, এই ট্যাক্সের পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে গেছে। ট্যাক্সের পরিমাণ কমানো দরকার। দেশি শিল্পকে প্রণোদনা দেয়ার সাথে সাথে মান যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তার কারণ হচ্ছে, সকল প্রতিষ্ঠান যে ভালো সোলার পিভি ব্যবহার করে তা নয়। ফলে যা ২০ বছর টিকে থাকার কথা তা ১০ বছরে এসে নষ্ট হয়ে যায় এতে অনেক তি হচ্ছে। তাই বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হবে। আমরা যদি শুধু দেশি শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য বেশি ট্যাক্স আদায় করি তাহলে বিদেশি ভালো মানের পিভির দাম বেড়ে যাবে, পরে তা আর ব্যবহার করা যাবে না । আমি মনে করি, এখন যে ৩৭% ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয়েছে তা অনেক বেশি হয়ে গেছে, এটা ৫-৭% এর বেশি হওয়া উচিত নয়।

বিশ্বের অন্য দেশে গ্রিন এনার্জি
যদিও এই ব্যাপারে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অনেক কিছু পরিবর্তন করেছেন তারপরও ইউরোপ এবং চীন তাদের চুক্তির নীতি অনুযায়ী চলছে। একমাত্র আমেরিকার প্রেসিডেন্টই এই নিয়ে বিতর্ক করেছেন। তবে আমি মনে করি যে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নিয়মনীতি বাংলাদেশ না মানলেই ভালো।

গ্রিন এনার্জির উন্নয়নে আরও প্রত্যাশা
বাজেটে সরকার এবার গ্রিন এনার্জিবান্ধব আইন করেছেন । তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রিন এনার্জির জন্য অনুদান এবং ঋণ দিচ্ছে। ইডকলও এখাতে অনুদান দিচ্ছে। বাংলাদেশে কিন্তু সোলার ইরিগেশন, সোলার মিনি গ্রিড ও কাবিখার আওতায় সোলার নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে যদি পিভির মান বজায় না রাখা যায় তাহলে দেশের জন্য তিকর হবে। সরকার মান বজায় রাখার জন্য সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করতে পারে। এটা নিয়ে বুয়েট ও ইডকল কাজ করেত পারে। বিভিন্ন ধরনের টেস্ট করার পর এগুলো সার্টিফাইড করা হয়। এটা করা হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়ে।

আমদের ইউনিভার্সিটির বিশেষত্ব
আমদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বিশেষত্ব হলো গবেষণা। গবেষণা করার জন্য আমরা নিজেরা ফান্ড জেগাড় করছি ও দেশের বাইরে থেকেও জোগাড় করার ব্যবস্থা রেখেছি। সরকার যে কিউসির ব্যবস্থা করেছে এতে করে শিক্ষকদের মধ্যে সচেতনতা এসেছে। তারাও নিজেদের পরিবর্তন ও তৈরি করছেন যেন ছাত্রদের ভালোভাবে শিক্ষাটা দেওয়া যায়।

ছাত্ররা কেন ইউআইউ বেছে নিবে
প্রথমেই আমাদের শিক্ষার মান এবং স্কলারশিপের জন্য। আমদের এখানে কোনো ছাত্র’র সিজিপিএ যদি ৩.৫০ এর ওপরে থাকে তবে তাকে ৫০%-১০০% স্কলারশিপ দেয়া হয়। এমন কি কাউকে কাউকে বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। পিতা হিসেবে আপনি আপনার সন্তানকে ইউআইউ’র কোন বিষয়ে পড়াতে চাইবেন? একজন পিতা হিসেবে আমি আমার সন্তানদের পড়াশুনার ব্যাপারে স্বাধীনতা দিয়েছি। তারা যা পড়তে চায় আমি তাই পড়তে দিয়েছি। তবে আমদের ইউনিভার্সিটি অনেক হলেও এখানের প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টে সুদ শিক্ষকমন্ডলি রয়েছেন।

সেন্টার ফর রিসার্চ ও আমাদের ভিশন
২০০৮-২০০৯ সালে আমরা যখন দেখলাম এ দেশে সোলার প্যানেল ও গ্রিন এনার্জি নিয়ে কাজ করতে হলে দেশের বাইরে থেকে কনসালটেন্ট নিয়ে আসতে হয় তখন আমরা এই সেন্টার স্থাপনে উদ্যোগ নিলাম। ২০০৮ সালে একটি ফান্ড করলাম। এর উদ্দেশ্যই ছিলো এনজিওদের আমরা আমাদের টেকনিক্যাল সার্ভিস দিবো।

আমরা এখানে সফল হয়েছি, পুরষ্কার পেয়েছি। অ্যাকটিভলি কাজ করি। সরকারি- বেসরকারি পর্যায়ের সব ধরনের প্রকল্পে যুক্ত থাকি। বিভিন্ন মিটিংয়ে পরামর্শ দিই। সোলারের বিভিন্ন বিষয়ে রিসার্চ করি। সোলার পিভিআই দিয়ে রান্না করা যাবে কি না আমরা তা দেখছি। আমরা সোলার বোর্ড করেছি, সোলার কোল্ড স্টোরেজ করেছি, সোলার কুকারের উপর কাজ করেছি। আমরা যে ভিশন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম তাতে অনেকটা সফল হয়েছি । সবার সহযোগিতায় সোলার নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবো বলে আশা করি।

প্রফেসর ড. রিজওয়ান খান
ভাইস চ্যান্সেলর
ইউনাইউটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি