কুষ্টিয়ায় কোরবানির জন্য প্রস্তুত দুই লাখ পশু

আসন্ন কোরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে পশু মোটাতাজাকরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন খামারি ও কৃষকারা। লাভের আশায় নাওয়া-খাওয়া ভুলে তারা পশু পরিচর্যা করছেন। দেশীয় পদ্ধতিতে ঘাস, খড়, খৈল, কুঁড়া, ভুসি, ভাঁতের মাড় ও খুদের (ভাঙা চাল) ভাঁত খাইয়ে গরু, ছাগল ও ভেড়া হৃষ্টপুষ্ট করা হচ্ছে। কুষ্টিয়ার খামারিরা এ বছর কোরবানির জন্য প্রায় দুই লাখ পশু হৃষ্টপুষ্ট করে চলেছে। জেলার প্রাণীসম্পদ বিভাগ তথ্য জানিয়েছে, জেলার উর্বর মাটিতে ধান-গম, ডাল, তেলবীজসহ নানা জাতের ফসল যেমন হয় তেমনি খামার ও ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকে পালন করেন পশু-পাখিও।

জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা আশাদুল হক জানান, এ বছর জেলায় ৫৫৩টি বাণিজ্যিক খামারসহ ২০ সহস্রাধিক কৃষক তাদের বাড়িতে কোরবানির হাঁটে বিক্রির জন্য প্রায় ৯৩ হাজার গরু ও ৬৬ হাজার ছাগল প্রস্তুত করেছেন। অধিকাংশ খামারি প্রশিক্ষিত ও নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে সচেতন বলে তিনি জানান। যেকোনো সময় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা তারা নিজেরাই করে থাকেন। কোনো খামারি বা কৃষক সমস্যা নিয়ে আসলে তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভাব্য সব সহযোগিতা করা হয় প্রাণী সম্পদ বিভাগ থেকে।

সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে খামারি ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে তাদের প্রস্তুত ও কর্মকা- সম্পর্কে। দেখা গেছে, খামারগুলোর বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য পশু মোটাতাজা করা। সংঙ্করায়িত ফিজিয়ান, শাহিওয়াল, সিন্ধি, হরিয়ানা ও দেশি জাতের গরু পালন করা হয় এসব খামারে। কয়েক বছর ধরে তিনটি করে গরু পালন করেন সদর উপজেলার উজান গ্রামের কৃষক আব্দুর রব।

তিনি বলেন, এ এলাকায় অনাবাদি জমি নেই। সবুজ ঘাসও নেই। তবে এ অঞ্চলে বৃহৎ চাল উৎপাদনের মোকাম থাকায় সেখান থেকে খুদ-কুঁড়া এবং খড়-বিছালি, গমের ভুসি, ভুট্টা, আলু ইত্যাদি সংগ্রহ করে গরুর খাবার প্রস্তুত করি। গরু-ছাগল পালন করার প্রধান ক্ষেত্র প্রাকৃতিক চারণভুমি যা এ অঞ্চলে নেই।

সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর গ্রামের কৃষক সিরাজ শেখ বলেন, পদ্মায় জেগে ওঠা বিস্তীর্ণ চরে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করা সম্ভব হলে সেখানকার অনাবাদি জমি উল্লেখযোগ্য চারণভূমি হতে পারে।
গরুর খাবার হিসেবে ভেড়ামারা কাঁঠের পুলের গরুর খামারি মালিক মোমিনুল ইসলাম মামুন তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ১০০ কেজি ওজনের একটি গরু পালতে খড়-বিছালি ও পানি ছাড়াও প্রতিদিন গরুর ওজনের ৩ শতাংশ হারে পুষ্টিকর খাবার দিতে হয়, যা পাওয়া যায় খুদ-কুঁড়া, গমের ভুসি, ভুট্টা, আলু ইত্যাদি থেকে। এ জন্য দিনে ১৫০ থেকে ২০০টাকা খরচ হয়। বছর চুক্তিতে পশু চিকিৎসার কাজ করাতে হয়। প্রতিবছর একটি গরুর জন্য দুই থেকে চার হাজার টাকা খরচ করেন। জটিল কোনো সমস্যা দেখা দিলে ৮-১০ হাজার টাকাও খরচ হয়। সে রকম ঘটনা সচরাচর ঘটে না। তবে গৃহপর্যায়ে কৃষকরা যারা একটা-দুইটা গরু পালন করেন তারা ছোট খাটো কোনো বিষয়ে চিকিৎসা দেন না। বেশি সমস্যা হলে তারা সরকারি প্রাণীসম্পদ বিভাগে যান।

কোরবানির ঈদ উপলক্ষে খামারিদের স্বাস্থ্যহানিকর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানা যায়, পশুকে দ্রুত মোটাতাজা করতে কেউ কেউ নিষিদ্ধ হরমোন প্রয়োগ করে। অনেকে ইউরিয়া সার মেশানো খাবার দেয়। তবে এতে বিগত কয়েক বছরে পশুর মৃত্যুর ফলে এ বছর তেমন দেখা যাচ্ছে না।

কুষ্টিয়া জেলা পশুসম্পদ অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলার ছয় উপজেলায় ২০ হাজার ৫৮৬ খামার রয়েছে। এসব খামারে প্রায় ৯৩ হাজার গরু, ৬৬ হাজার ছাগল এবং তিন হাজারের মতো ভেড়া রয়েছে। সবেচেয়ে বেশি খামার ও পশু রয়েছে কুষ্টিয়া সদর উপজেলায়। এখানে গরুর সংখ্যা ১৬ হাজার ৪৬টি। এছাড়া দৌলতপুরে ১৪ হাজার ১৭৮, কুমারখালীতে ১৩ হাজার ২৫০, খোকসায় ৮ হাজার ১৬, মিরপুরে ১৩ হাজার ৭৩৯ এবং ভেড়ামারায় ৮ হাজার ৮৭৯টি গরু রয়েছে। বেসরকারি হিসাবে খামার ও গরুর সংখ্যা অনেক বেশি।

সদর উপজেলার পাটিকাবাড়ীর হারুরিয়া গ্রামের গ্রামীণ গো-খামারের স্বত্বাধিকারী ইলিয়াস হোসেন জানান, তার খামারের ১৫৪টির মতো গরু এরই মধ্যে ঢাকার এক ব্যবসায়ীর কাছে আশানুরূপ দামে বিক্রি করেছেন। আরও কয়েকটি গরু, মহিষ ও ভেড়া কোরবানির জন্য রেখেছেন। এগুলো ভালো দামে বিক্রি হবে বলে তিনি আশা করছেন। খোদ্দ আইলচারার মল্লা খামারের স্বত্বাধিকারী ছলিম জানান, তার খামারে ৯৮টি গরু রয়েছে। এর মধ্যে তিনি চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর কাছে ২০টি গরু আশানুরূপ দামে বিক্রি করেছেন। এবার আগেভাগে ভালো দামে গরু বিক্রি করে টেনশনমুক্ত হয়েছেন। তিনি আরও জানান, এবার জেলার কৃষক এবং খামারিরা ভালো দামে গরু বিক্রি করছেন। ব্যাপারিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পছন্দসই গরু কিনছেন।

কুষ্টিয়া জেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আশাদুল হক আরো জানান, এবারও জেলায় বিপুল পরিমান কোরবানির পশু রয়েছে। কৃষক ও খামারিরা যত্ন নিয়ে পশু লালন পালন করছেন। প্রতি উপজেলায় কোরবানির পশুর জন্য আমাদের কর্মীরা কাজ করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়েছি কোথাও এখন পর্যন্ত গরু মোটাজাতাকরণের জন্য ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়নি।

সদর উপজেলার কুমারগাড়া গ্রামের কাজী ফার্মের মালিক কাজী শওকত জানান, প্রতিবছর কোরবানির বাজারে বিক্রির জন্য ঈদের পর এক-দুই মাসের মধ্যে মোটাতাজা করার জন্য গরু কেনেন তিনি। আর বেচেন ঈদের এক-দুই সপ্তাহ আগে।

কাঁঠের পুলের মোমিনুল ইসলাম মামুন জানান, পরিচর্যার ওপরই নির্ভর করে রোগবালাই হওয়া বা না হওয়া। খামারের পরিবেশ খোলামেলা, পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সময়মতো গোসল করানোর ব্যবস্থা করতে হয়। আমার খামারের অধিকাংশ কাজ রাখালরা করলেও সার্বক্ষণিক সমস্ত বিষয়ে নিবিড়ভাবে লক্ষ রাখি আমি, যেন কোনো রকম ত্রুটি না থাকে। সামান্যতম অসতর্কতার কারণে গরু মুত্যু হতে পারে।

কুষ্টিয়া অঞ্চলে দুই লাখেরও বেশি কোরবানির পশু রয়েছে। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হবে। গত বছর গো-খামারি ও কৃষক গরুর ভালো দাম পেয়েছেন। এ কারণে এবারও তারা পশুর প্রতি বিশেষ যত্ন নিচ্ছেন। গ্রামে এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে দুই থেকে চারটি কোরবানির গরু পাওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, কোরবানিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার গো-খামার গড়ে উঠেছে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কোরবানির গরু লালনপালনে এখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে।
সূত্র: ফেমাসনিউজ

আজকের বাজার: আরআর/ ১৬ আগস্ট ২০১৭