কৃষি
ড. এফ এইচ আনসারী: বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় শতকরা ৭০ ভাগ জমিতে ধান চাষ হয়। যার পরিমান প্রায় ১১ মিলিওন হেক্টর। যেখানে এতো ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা, সেখানে দিন দিন আমাদের কর্মীর সংখা কমে যাচ্ছে। যখন ধান কাটা শুরু হয়, তখন দেখা যায় ৩৭ থেকে ৪০ ভাগ শ্রমিক পাওয়া যায় না। এর ফলে সময় মতো ধান কাটতে দেরি হয়। এ সময় পাকা ধান যদি জমিতে পড়ে থাকে, তাহলে ধান ঝড়ে পড়ে, ইদুরে নিয়ে যায় বা গুনাগুন নষ্ট হয়। একবিঘা জমিতে ২০ মন ধান হলে, যদি ৩ মনই নষ্ট হয়ে যায়, তার মানে তিন মনই ক্ষতি হলো কৃষকের। এতো শ্রম, খরচ করার পর যদি দেখা যায় ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাহলে তো শ্রমের আর মূল্য থাকলো না। এই ক্ষতি পুষিয়ে আনতেই কম্বাইন্ড হার্ভেস্ট প্রয়োজন। যার মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে আনা সম্ভব।
একবিঘা জমির ধান কাটতে ৩,৬০০ টাকা লাগে। এভাবে ব্যাপক হারে টাকা খরচ করা তো উচিত হবে না, প্রোডাক্টিভ হবে না, একজন খামারী বা কৃষকের জন্য। আর এজন্যই কম্বাইন্ড হার্ভেষ্টার। প্রশ্ন আসতে পারে, কম্বাইন্ড হার্ভেষ্টার চালু হলে তো শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়বে। আসলে ব্যাপারটা, তা নয়। দেখুন আসলে সময়মতো তিন ভাগের এক ভাগ ধান কাটতে অনেক দেরি হয়ে যায়। যা পর্যাপ্ত শ্রমিক না পাবার কারণেই হচ্ছে। তাছাড়া অন্য কোন ফসল চাষেও, দেরি হয়ে যায়। তাতে দেখা যায় উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সময়ের ব্যবধান ঘটে। ফলে সবারই ক্ষতি হয় কমবেশি। এর জন্য ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বা এর সমাধানের জন্য কম্বাইন্ড হর্ভেস্টার ব্যবহার করতে হবে। তার মানে এই প্রক্রিয়ায় সারে তিন মিলিয়ন জমিতে ধান কাটা যেতে পারে। তবে এক সাথে হবে না, ধাপে ধাপে হবে।
প্রযুক্তি নির্ভর কৃষিতে আমাদের যেতে হবে। বর্তমানে এক বিঘাতে ধান কাটতে খরচ পড়ে ৩,৬০০ টাকা, কিন্ত কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে ধান কাটলে ১৭০০-১৮০০ টাকা খরছ হবে। কেউ কেউ আবার ১,১০০টাকা দিয়েও এ সার্ভিসটা দিচ্ছেন, কারণ এটা সাশ্রয়ী। তাহলে দেখা গেল যায়, সনাতন পদ্ধতির চাইতে তিন ভাগের একভাগ খরচেই দ্রুততম সময় ধান কাটা হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে সময় মতোই ধান তুলতে পারছে কৃষক। শুধু তাই নয়, অল্প সময়ের ব্যবধানে অন্য ফসলও চাষ করতে পারছেন কৃষক। ফলে একাধারে খরচ বেঁচে যাচ্ছে, ফসল নষ্ট হচ্ছে না এবং দ্রুত অন্য কোন ফসল উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছে। অর্থাৎ একই জমিতে ২ থেকে ৪ বার ফসল তুলতে পারছেন কৃষক। এতোগুলো সুবিধার কারণেই কৃষি উন্নয়ণের স্বার্থে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ব্যবহারে কৃষককে উৎসাহিত করা উচিত।
ইতিপূর্বে দেশের অনেক কোম্পানী কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার নিয়ে আসে কিন্ত সেগুলো এতো বড় ছিল যে দেশীয় জমির আকারের চাইতেও বড়। যার কারণে সেগুলো খুব একটা কার্যকর হয়নি। আমরা রিসার্চ করে, সে অনুপাতে জমির মাপ অনুযায়ী কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার মেশিন নিয়ে এসেছি। যার মাধ্যমে ঘন্টায় একবিঘা জমির ধান কাটা সম্ভব। একসাথে ধান কাটা, মাড়াই এবং প্যাকেটজাত করাও যাবে। তাছাড়া ধানের খর, কৃষির জন্য বড় একটা উপাদান। এই খড়কে কোন ভাবে এবড়ো থ্যাবড়ো ভাবে নস্ট না করে, সমানভাবেই সুন্দর করে রাখবে এই হার্ভেস্টার। যার মাধ্যমে একজন কৃষক সুন্দরভাবে ধান ঘরে তুলতে পারবেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সরকার এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছে। প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে এ বিষয়ে। একটা কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের মূল্য প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা, সেখানে সরকার প্রায় সাড়ে তিন লাখের মতো ভর্তুকি দিচ্ছে। এর ফলে একজন কৃষক স্বল্প খরচে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার কিনতে পারবেন।
অনেকে ভাবতে পারেন, শুধু নিজের জমির জন্য এতো খরচ কেন করবেন? আসলে যে কিনবে, সে নিজের জমির পাশাপাশি ,অন্যের জমির ধানও কেটে দেয়ার কাজটি করে সহযোগিতা ও বাড়তি কিছু আয় উপার্জনও করতে পারবেন। তাছাড়া যেহেতু এটা জটিল মেশিন, এর জন্য সার্বক্ষনিক সার্ভিসের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
কেউ কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার কেনার সময় তাকে মেশিনটি চালানোর জন্য একজন চালক দিচ্ছি, যাতে করে কৃষক দ্রুত শিখতে পারে, কি করে এটা চালাতে হয়। স্থানীয় পর্যায়ে আমরা টেকনেশিয়ানকে ট্রেনিং দিচ্ছি, যাতে দূরে কোথাও সমস্যা হলে তাৎক্ষনিকভাবে মেরামত করতে পারে। তাছাড়া এর খুচরা পার্টস্ এর ব্যবস্থাও করছি, যাতে একজন কৃষককে কোন যন্ত্রাংশের জন্য বসে থাকতে না হয়। উদ্দেশ্য কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার যেন কখনই বসে না থাকে।
বর্ষায় পানি জমে থাকা জমিতে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ব্যবহার পদ্ধতি:
পরীক্ষা করে দেখা গেছে, জমিতে যদি এক ফুট পানিও থাকে, তাহলে এটা দিয়ে ধান কাটা সম্ভব। আর যেহেতু এর চাকাটা ট্যাংকের মতো তাই নরম মাটিতেও কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার চলতে সমস্যা হয় না। ফলে বর্ষা মৌসুমেও কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে ধান কাটা, মাড়াই ও প্যাকেটজাত করা সম্ভব।
মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সুতরাং কৃষিতে উন্নয়ন মধ্যম আয়ের দেশ হতে আমাদের কতটা সহযোগিতা করবে,তা সহজে অনুমেয়। বর্তমানে অন্যান্য সেক্টরের মতো কৃষিতে অনেকদূর এগিয়েছে দেশ। এক সময় কৃষক তার ফসল উৎপাদন করে মূল্য পেত না। বর্তমানে কৃষির প্রায় সব ক্ষেত্রে কৃষক তার ন্যায্য মূল্যের পাশাপাশি অতিরিক্ত লাভ করতে পারছেন। গত দু’বছর আগেও দেখেছি, ধান বিক্রি করে লোকসান হতো। যে দেশের অর্ধেক জনগন কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা যদি লাভবান হতে পারেন এবং রাজস্বে ভ’মিকা রাখতে পারেন, তাহলে তো জিডিপিতে বড় ধরনের সাপোর্ট পাওয়া যাবে।
আমাদের রপ্তানি বেড়েছে, কৃষি পণ্য বাইরে যাচ্ছে, গার্মেন্টস সেক্টর ব্যাপক এগিয়েছে, মৎস্য সম্পদও এগিয়েছে অনেক, পোল্ট্রি, ডেইরী সেক্টর উন্নতি করেছে। সুতরাং এখন দেশ মধ্যম আয়ের দেশে এগিয়ে যাচ্ছে বলাই যায়।
আমরা যদি আগের মতো আমদানী নির্ভর থাকতাম, তাহলে তো যা আয় করছি তা বাইরেই চলে যেত। এখন আর তেমনভাবে আমাদের খাদ্য পণ্য আমদানী করতে হয় না। ফলে আমাদের টাকা আমাদের কাছেই থেকে যাচ্ছে।
মধ্যম আয়ের দিকে দেশকে এগিয়ে নিতে কৃষি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা এখন চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলতে পারি। কিন্ত এ ছাড়া আরো কিছু পণ্যের উপর এখনও আমদানি নির্ভরতা রয়েছে।
এর মধ্যে আমাদের ডাল খেতে হয়। ভূট্টা আমদানি করতে হয় পোল্ট্রি শিল্পের জন্য, সয়াবিন আনতে হয়, মাছ মুরগি উৎপাদনের জন্য, তাদের খাবার তৈরির জন্য।
কিন্ত এইসব পণ্য যদি দেশে পর্যাপ্ত আকারে উৎপাদন সম্ভব হতো, তাহলে বাইরে থেকে এসব পণ্য আনতে হতো না। এর কারণও আছে, দেশের প্রায় ৭০ ভাগ জমিতে ধান চাষ করা হয়। কৃষকরা ধান চাষে অভ্যস্থ। তাছাড়া ধান বিক্রি করে লাভও হয়, স্টোরেজের সমস্যা নেই, যে কোনো সময় ধান বিক্রি করা যায়। যার কারণে অন্য ফসলের দিকে তাদের আগ্রহটাও কম।
ধানের উৎপাদন আমাদের যতটুকু দরকার ততটুকু হচ্ছে। যদি এমন হতো গড়ে ৪ টন করে ধান উৎপাদন হতো আর এ উৎপাদন যদি আরেকটু বাড়িয়ে ৬ টনে নেয়া যেতো ভিয়েতনমের মতো, তাহলে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ জমি অতিরিক্ত থাকতো। যেখানে ভূট্টা করা যেতো, সয়াবিন করা সম্ভব হতো, সানফ্লাওয়ার করা যেতো। তখন এগুলো বাইরে থেকে আর আনতে হতো না। যে সব খাদ্যশস্য এদেশে উৎপাদিত হয়, এগুলো কিন্ত রান্নার কাজে ব্যাবহার করা হয়। এগুলোর যদি উন্নত জাত করা যেত, যার দেশের বাইরে চাহিদা রয়েছে, তাহলে এগুলো রপ্তানিও করা সম্ভব হতো। তখন রাজস্ব আয় হয়,এমন উৎপাদনে যেতে পারতাম।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কান্ট্রি ব্রান্ডিং। বাংলাদেশকে যদি বিশে^ দেখাতে পারি যে, এখানে কোয়ালিটি পণ্য উৎপাদন হয়, এগুলো রপ্তানি করা হয়, কল-কারখানাগুলোতে শক্ত ভাবে মান নিয়ন্ত্রন হয় এবং যারা এগ্রোবেইজড প্রোডাক্ট উৎপাদন করে, তাদেরও কোয়ালিটি কন্ট্রোল রয়েছে। তাহলে সার্বিক ভাবে দেশিয় প্রচারটা হবে। তাতে করে বৃহৎ আকারে কৃষিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত পাবে বাংলাদেশ।
ড.এফ এইচ আনসারী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও
এসিআই এগ্রি বিজনেস