অগ্রহায়ণ শেষে পৌষের আগমন। প্রকৃতিতে ইতোমধ্যে শীতের দাপট। আমন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের মৌসুম শেষ। এখন চলছে নানা ধরনের শাক-সবজি আর শস্য চাষ ও ঘরে তোলার সময়। আর এসব কাজে চলনবিলসহ এর আশপাশের কৃষিপ্রধান জেলাগুলোয় চলছে নারী-পুরুষের ব্যস্ততা। কেউ মরিচ বা সবজি ক্ষেতে কাজ করছেন, অনেকেই আলু তোলায় ব্যস্ত। কেউ বা ব্যস্ত অন্যান্য শস্য ঘরে তোলা কিংবা গাছ পরিচর্চায়।
সম্প্রতি চলনবিল সমৃদ্ধ নাটোর, সিরাজগঞ্জ ছাড়াও বগুড়াসহ আশপাশের উত্তরের জেলাগুলো ঘুরে এমনটাই চোখে পড়েছে। স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমন ধান কাটা মৌসুমে কৃষিপ্রধান এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই কৃষি শ্রমিকদের চাহিদা অনেক বেশি থাকে। ফলে অন্যান্য ফসল আবাদের জন্য শ্রমিক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। দেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষিপ্রধান এলাকাগুলোতে এই সংকট নিরসনে নারী কৃষি শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বাড়ে।
চলন বিল ছাড়াও বগুড়াসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলায় নারী কৃষি শ্রমিকরাও সমানভাবে কাজ করছেন। এই মৌসুমে যেমন এখন বগুড়ার আলু ক্ষেতগুলোতে গেলেই চোখে পড়ছে দলবেঁধে কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা।
বগুড়ার শেরপুরের বাসিন্দা মো. রতন মিয়া নামে কৃষক জানান, আলু ক্ষেতে গত কয়েক বছর ধরেই নারী কৃষি শ্রমিকদের উপস্থিতি বাড়ছে। এতে ধান কাটার মৌসুমে আলু ক্ষেতে শ্রমিক সংকট কেটে গেছে। অন্যদিকে আগে থেকেই ধান মাড়াই ও সংরক্ষণে নারীদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। এখন ধান ক্ষেতে ধান আবাদের অন্যান ধাপেও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। সব মিলিয়ে কৃষিশ্রমের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠছেন উত্তরের নারী শ্রমিকরা।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বগুড়াসহ উত্তরের নারী শ্রমিকদের আগে শুধু ধান কাটার মৌসুমে মাড়াই বা সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত দেখা গেলেও এখন তাদের ব্যস্ততা চোখে পড়বে ধান বা আলু ক্ষেত থেকে শুরু করে অন্যান্য শস্য ও সবজিসহ বিভিন্ন ফসল আবাদের নানা পর্যায়ে। ফসল আবাদের প্রায় সব প্রক্রিয়াতেই এখন নারী কৃষি শ্রমিকদের রয়েছে সরব উপস্থিতি। আলুর জমিতেও ক্ষেত পরিচর্যা থেকে শুরু করে বীজ বপন ও ফলন তোলার সময় নারী শ্রমিকদের দল বেঁধে কাজ করেন।
জানা যায়, পৃথিবীর ইতিহাসে খাদ্যশস্য আবাদের সূচনাই নারীদের হাত ধরে। কালক্রমে বিবর্তনের পথ ধরে সেই কৃষি পুরুষদের হাতে চলে যায়। তবে বিভিন্ন দেশে সবসময়ই কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছেন নারীরা। দেশেও কৃষি, বিশেষ করে খাদ্যশস্য আবাদে নারীদের অংশগ্রহণ ঐতিহ্যগতভাবেই দৃশ্যমান। তবে শস্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ধাপেই গত কয়েক দশকে নারী কৃষি শ্রমিকদের উপস্থিতি বেশি দৃশ্যমান ছিল। ধানের ক্ষেত্রে যেমন মাড়াই ও সংরক্ষণ ধাপে কাজ করতে দেখা যেত নারীদের।
নারী শ্রমিকদের কৃষিতে সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে এসেছে জাতিসংঘের খ্যাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএওর এক প্রতিবেদনেও। সংস্থাটির গত বছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের কৃষি শ্রমে নারীদের অংশগ্রহণের হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। ২০০৫ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে কৃষি ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা ৯ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
বগুড়া জেলা কৃষি কর্মকর্তা ইসমত জাহান এই প্রতিবেদককে বলেন, বগুড়াসহ উত্তরের জেলাগুলোতে ধান ক্ষেতেও এখন পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা চোখে পড়বে। আর আলুসহ অন্য সবজি আবাদে ক্ষেত্রেও জমি তৈরি থেকে শুরু করে পরিচর্যা, বীজ বপন, অঙ্কুরোদ্গম, ফসল উত্তোলন ও সংরক্ষণের প্রতিটি ধাপে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বাড়ছে।
তবে সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্যের মতো কৃষি শ্রমিকদের মধ্যেও নারীদের কম মজুরি পাওয়ার অভিযোগ করেছেন মোছা. শরিফ নামে এক নারী।
তিনি বলেন, ক্ষেতে সারা দিন কাজ করার জন্য একজন পুরুষ শ্রমিক যেখানে ন্যূনতম ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পেয়ে থাকেন, সেখানে আমরা পাই ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।
বগুড়ার শাখারিয়া এলাকার তিলের পাড়া গ্রামের শিফা বেগম কৃষি জমিতে কাজ করেন। তিন সন্তানের জননী শিফার স্বামী সেলুনে কাজ করেন। সন্তানদের শিক্ষা ও সংসারের ব্যয় সামলাতে এখন তিনি আলুর ক্ষেতে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ৩০০ টাকা দিন হাজিরায় জমিতে আলু তুলছি।
শিফা বেগমের সঙ্গেই মাঠে কাজ করছিলেন আরও তিন নারী। তাদেরও অভিযোগ, তারা দিনে ৩০০ টাকা মজুরিতে কাজ করলেও পুরুষ শ্রমিকরা মজুরি বেশি পান। অথচ নারী ও পুরুষ কৃষি শ্রমিকরা ক্ষেতে সমান কাজই করে থাকেন। বৈষম্য থাকলেও উপার্জনের মাধ্যমে পরিবারে স্বচ্ছলতা ফেরানোর জন্য তারা কাজ বন্ধ করছেন না।
নারী শ্রমিক সাথী বেগমের স্বামী আব্দুস সামদ নির্মাণ শ্রমিক। সাথী বেগম বলেন, ‘আমাদের পাঁচজনের সংসার। স্বামীর একার আয়ে সংসার চলে না। তাই মাঠে কাজ করি।
এখন দুজনের আয়ে মোটামুটি সংসার চলে যায়।’ সবজির মৌসুম শেষ হলে বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করবেন বলে জানান তিনি।
নারী শ্রমিকরা জানালেন, তাদের আশপাশের গ্রামগুলোতে দুই শতাধিক নারী শ্রমিক রয়েছেন, যারা সরাসরি ক্ষেতে কাজ করেন। আগের তুলনায় নারী শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে।
কেবল বগুড়া নয়, উত্তরের অন্য জেলাগুলোতেও আলুর জমিতে নারী শ্রমিকদের কাজ চোখে পড়ার মতো। দিনাজপুরের বীরগঞ্জের আলু বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী মো. পারভেজ রশীদও জানালেন সে কথা।
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের আওতায় যেসব জমিতে আলু আবাদ হয়, সেখানে অনেক নারী শ্রমিক কাজ করেন। জমিতে যত ধরনের কাজ রয়েছে, সব কাজই নারী শ্রমিকরা করে থাকেন। ধান কাটার মৌসুমে আলুর ক্ষেতের জন্য শ্রমিক সংকট তৈরি হতো। নারী শ্রমিকরা এগিয়ে আসায় সেই সংকট এখন কেটে যাচ্ছে। নারী শ্রমিকরা না থাকলে আমাদের আবাদ অব্যাহত রাখা কষ্ট হয়ে যেত।’ তবে পারভেজের দাবি, তারা মজুরিতে নারী-পুরুষ বৈষম্য করেন না।
কৃষিশ্রমে নারীদের সম্পৃক্ততা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহাকরী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান বলেন, ‘বগুড়ায় মরিচের ক্ষেতে ৮০ শতাংশ, আলুতে ৬০ শতাংশ এবং মূলা, গাজর ও ঢেড়স আবাদে ৩০ শতাংশ নারী শ্রমিক সম্পৃক্ত রয়েছেন। জমিতে কায়িক শ্রমেও এখন পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করছেন নারীরা। তারা নিজেরা উপার্জন করছেন, পরিবারের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।’
সূত্র জানায়, আলু উৎপাদনে উদ্বৃত্ত জেলা বগুড়া। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলার অভ্যন্তরীণ আলুর চাহিদা আড়াই লাখ মেট্রিক টন। সেখানে এ বছর সাড়ে ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ১২ লাখ মেট্রিক টন।
কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার জেলায় বৃষ্টিজনিত কারণে দেরিতে বপন হওয়ায় আগাম জাতের আলুও একটু দেরিতে উঠছে। তবে মূল আলু আবাদের ভর মৌসুমে ফলন ভালো হয়েছে। এভাবে শুধু উত্তরের জেলাগুলোই নয়, কৃষিতে নারীর শ্রমে সাফল্য আসছে ফসলে। আরও চওড়া হচ্ছে কৃষকের মুখের হাসি। (বাসস)