‘কৃষি আইন ও বিধিতে সংস্কার আনতে হবে’ – কৃষিবিদ মোস্তাফিজ

বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাব:
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বলতে হয়, গত ১০ বছরে একটানা দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেভাবে হয়েছে আমাদের দেশে, পৃথিবীর খুব কম সংখ্যক দেশেই এমন নজীর আছে। ২০১৯ সালে বিশ্ব ব্যাংক বলেছিল, পৃথিবীর পঞ্চম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক দেশের মধ্যে অন্যতম প্রধান দেশ ‘বাংলাদেশ’। সে বিবেচনায় কোভিডের আগ পর্যন্ত আমাদের অর্থনৈতিক সূচকের সবকিছুই পজিটিভ ছিল। দক্ষিণ এশিয়া এমনকি সারা বিশ্বের অর্থনীতি নিয়ে যারা জরিপ করে, তারা প্রত্যেকেই বলেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অসাধারণ হয়েছে। কোভিডের সময়ে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে গেছে। চায়না ছাড়া জি-৭-এর সকল দেশের অর্থনীতি কোভিডের সময় কমেছে। অথচ বাংলাদেশের অর্থনীতি বেড়েছে। পৃথিবীর বৃহৎ অর্থনীতির যে দেশগুলো আছে পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়া, আমেরিকা, জার্মানি, ইউকে, জাপান এসব দেশের অর্থনীতির আয়তন অনেক বড়। চায়না ছাড়া প্রত্যেকটি দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে। জিডিপি নেগেটিভে চলে আসছে। অথচ বাংলাদেশে তখনো জিডিপি পাঁচের উপরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সেদিক বিবেচনায় কোভিড নিয়ন্ত্রণে আমরা অনেক বড় দেশের তুলনায় ভালো করেছি। অর্থনীতিও ওইভাবে সংকুচিত হয়নি। কোভিড পূর্ব সময় আমরা খুবই ভালো করেছিলাম। কোভিডের মধ্যেও আমাদের অর্থনৈতিক ঝুঁকিটা অন্যান্য দেশের তুলনায় কম ছিল।

ইউক্রেনের যুদ্ধ ও কোভিডের সময়ে সারা পৃথিবীতে স্টিমুলাস দেবার ফলে অর্থনীতিতে অর্থ সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় এবং অর্থের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। ফলে সারা পৃথিবীতেই দ্রব্যমূল্যর দাম বেড়ে গেছে। এতেকরে ১০০ টাকার গায়ে ১০০ টাকা লেখা আছে ঠিকই কিন্তু এখন আর সেটাকায় আগের পণ্যটি কেনা যাচ্ছে না। তারমানে টাকার পারচেজিং পাওয়ার আগে যেটা ছিল তার চেয়ে অনেক কমে গেছে। এক বছর আগে বাজারের লিস্ট নিয়ে যখন বাজারে গিয়েছেন ওই একই পণ্য কিনতে যে পরিমাণ টাকা লেগেছে, বর্তমানে ওই লিস্ট নিয়ে বাজারে গেলে আমাদের পকেট থেকে আগের চেয়ে বেশি টাকা চলে যাচ্ছে। এটাই হচ্ছে আমাদের মুদ্রাস্ফীতি। আমাদের মুদ্রা ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এটা শুধু বাংলাদেশে না তুরস্ক, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আমেরিকা সব দেশেই একই অবস্থা বিরাজ করছে। আমেরিকার গত ৫০ বছরে ইনফ্লাশন কখনোই ১-২% এর উপরে যায়নি। এখন ইনফ্লাশন ৯% অর্থাৎ টাকার ক্রয় ক্ষমতা হারিয়েছে নয় শতাংশ। সেই তুলনায় আমরা ভালো আছি। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলারের বাজারে অস্থিতিশীলতা শুরু হয়েছে। ইনফ্লাশনতো আমাদের আগে থেকেই ছিল। কিন্তু এখন সমস্যাটা একটু ভিন্নরকম। যেমন, আমরা পোশাক রপ্তানি করি ইউরোপ ও আমেরিকাতে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি- গ্যাসের মূল্য প্রায় ৮০ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো জ্বালানি সংকট মোকাবেলা করা। এটা করতে গিয়ে তাদের খাদ্য, বস্ত্রসহ বিলাস পণ্যগুলোতে তারা বাজেট সংকুচিত করেছে। আমরা যখন বিদেশ থেকে কোন পণ্য ক্রয়ের জন্য এলসি করি। তখন উৎপাদনকারী কোম্পানি আমাদের ১৮০ দিনের ডেফার্ট পেমেন্ট অর্থাৎ পণ্যের মূল্য পরিশোধের সময় টা ১৮০ দিন পরে দিলেও হয়, এই সুযোগ দিয়ে থাকে।

একই রকম ভাবে ইউরোপিয়ান বায়ার যারা বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস প্রোডাক্ট আমদানি করেন, তাদেরকেও পোশাক শিল্পের মালিকরা ৯০, ১২০ বা ১৮০ দিনের বকেয়া দেয় বা ডেফার্ট পেমেন্টের সুযোগ দেয়। এখন যেহেতু কারেন্সির ডিভ্যালুয়েশন, প্লাস তাদের ঝুঁকি ও কনজামশনের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এই সমস্ত মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রেও ডেফার্ট পেমেন্ট আরো প্রলম্বিত হতে পারে। আমাদের রপ্তানির বিপরীতে যে পরিমাণ ডলার ইনকাম হওয়ার কথা, সেটা সঠিক সময় আমাদের হাতে নাও আসতে পারে। তাই ডলারের বাজারের যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, এটা থেকে উত্তরণ পাওয়া আমাদের সরকারের জন্য এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আনন্দের বিষয় হচ্ছে, আমরা ডলার ছাড়া অন্যান্য কারেন্সিতে পণ্য ক্রয় করতে পারি। এর জন্য সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ডলারের উপর যাতে চাপ সৃষ্টি না হয়, সে কারণে অপ্রয়োজনীয় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বিধি-নিষেধ দিচ্ছে ও আগামীতেও দিবে। অপ্রয়োজনীয় বিলাস পণ্য এগুলোর আমদানি ব্যায় কমিয়ে ডলার সাশ্রয় করার উদ্যোগ সরকার নিয়েছে। বিভিন্ন সরকারি ব্যয় যেখানে যেটা জাস্টিফাইড করা যায় সেই জায়গা গুলোতে আমাদের সরকার হাত দিয়েছে। ফলে ইউরোপের বাজার থেকে যদি ডলার আসতে বিলম্ব হয়, তাতেও আমাদের সমস্যা হবে না। যদি আমাদের এই সমস্ত কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করা যায়, ডলারের পরিবর্তে অন্য কারেন্সিতে আমরা আমদানি করার সুযোগ পাই তাহলে ডলারের মূল্য অটোমেটিক্যালি ধীরে ধীরে কমে যাবে। একটি পূর্বাভাস করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী যে মন্দা চলছে, তার ঢেউ বাংলাদেশেও আসবে, আসার কথা। তার পূর্ব প্রস্তুতি সেটা আমাদের সরকার ও ব্যবসায়ী মহল নিয়ে রেখেছে।

কৃষি খাতে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাব:
কৃষি ক্ষেত্রে আরো অনেক উন্নত প্রযুক্তি আছে। আইনি বাঁধা ও বিধি-বিধানের কারণে আমাদের দেশে এসব প্রযুক্তি আসতে পারে না। এগুলোকে উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে। পশ্চিমা দেশে এমনও প্রযুক্তি এসেছে। যেখানে ফার্টিলাইজারের ডোজ তারা অনেকটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ন্যানোটেকনোলজি, ফার্মেন্টেশন বেজ ফার্টিলাইজার, মাইক্রোপ এগুলো নতুন নতুন শব্দ। যেগুলো কৃষি বিজ্ঞানে আমরা আগে পাইনি। আমি নিজেও একজন কৃষি বিজ্ঞানী। আমাদের পাঠ্যক্রমে আমরা এই নতুন শব্দগুলো পড়ে আসিনি। এখন কৃষি বিজ্ঞানের গবেষণাতে এই সমস্ত বিষয় ডিসকভার বা ইনভেনশন করেছে। এইসব প্রযুক্তি আমাদের দেশের বিধি-বিধান ও সরকারের বুরোক্রেসির কারণে আসতে বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে। তাহলে এসব প্রযুক্তি আসতে যত বিলম্ব হবে, আমাদের কৃষিতে উৎপাদনশীলতা তত কমে যাবে। এই জায়গাগুলোতে সরকারের নজর দেবার দরকার আছে।

কৃষকের ন্যায্য মূল্য:
কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য যা হবার কথা সেই পরিমাণ মূল্য হচ্ছে না। এখানে ভর্তুকি দেবার কারণে যে ফার্টিলাইজার কৃষকের ১০০ টাকা প্রতি কেজি ক্রয় করার কথা, সেখানে কৃষক ২০ টাকায় ক্রয় করতে পারছে। ফলে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের মূল্য বাজারে আপনি ৫০ টাকা কেজিতে খাচ্ছেন। এর উৎপাদন খরচ আরো বেশি। সরকার এখানে ভর্তুকি দেবার কারণে কৃষি পণ্যের বর্তমান মূল্য আরো বেশি হবার কথা ছিল। কৃষকের উৎপাদন খরচ যদি আরও বেশি হতো তাহলে কৃষকের পকেটে আরো কম টাকা যেত। কৃষি ফসলগুলো একসাথে পাকে। যখন ধান কাঁটার সময় হয় তখন সমস্ত ধান একসাথে কাটা হয়। আমের সময় সব আম একসাথে বাজারে আসে। কৃষি পণ্যের উৎপাদন যদি বেশি হয়, তখন উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ বাজারে বেশি হবার কারণে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কমে যায়। এই কারণে পোস্ট হার্ভেস্ট ম্যানেজমেন্ট নামে একটি শব্দ আছে। অর্থাৎ উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণ করা। বিজ্ঞানভিত্তিক সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে একসাথে সব পণ্য বাজারে না যাবার কারণে ওই পণ্যের নির্দিষ্ট মূল্য সাপ্লাই বেড়ে যাওয়ার কারণে যা হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি হবে। ফলে কৃষক আগের চেয়ে ভালো মূল্য পাবে। এছাড়াও উৎপাদিত কৃষি পণ্য শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। বিদেশে রপ্তানি করা যেতে পারে, প্রক্রিয়াজাতকরণ হতে পারে। এই সমস্ত কর্মকার্যের উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষি মনে হয় সহজ। কৃষিতে অনেকগুলো সংযোজন বা ইন্টিগ্রেশন ছাড়া এর উৎকর্ষ লাভ করা সম্ভব নয়। কৃষিকে টেকসই করতে হলে কৃষির উপকরণ যেগুলো আমরা আমদানি করি সেই উপকরণগুলোর মধ্যে যেগুলো আমাদের দেশে উৎপাদন করার সুযোগ রয়েছে, সেই খাতগুলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে চিহ্নিত করতে হবে। এর প্রকৃত কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একই পাঠ্য কারিকুলাম তারা পড়ছে। ভারতের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আর বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ব্রিটিশ আমলে প্রায় একই সময় হয়েছে। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৮ সালে এবং লাহোর ও ভারতের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একই সময়ে হয়েছে। ভারতের কৃষি বিজ্ঞানীরা তাদের সমস্ত কৃষি উপকরণ তাদের দেশেই উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। আমরা শুধু কৃষি ও ধান গবেষণায় কিছু জাত উদ্ভাবন করতে পেরেছি। ফার্টিলাইজার, পেস্টিসাইড, অর্গানিক ফার্টিলাইজার আমাদের দেশে উৎপাদন করতে পারি নাই। ন্যানো টেকনোলজি কী তা আমরা জানিনা। এটা স্বাভাবিক কথা নয়। আমাদের বিধিবিধান আইন এবং প্রযুক্তি গবেষণা এই জায়গাগুলোতে আমরা নজর দেইনি।

শুধুমাত্র প্রচলিত কৃষি গবেষণা, ধান, পাট, আখ, চা এগুলোতে আমরা উৎকর্ষ লাভ করেছি। এর বাইরে উন্নত বিশ্বে আরো টেকনোলজি আছে। এই জায়গায় আমাদের ডেভলপ করা বাকি রয়ে গেছে।

ওষুধ শিল্পের অর্জন:
বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে ওষুধ অনেক কম মূল্যে আমরা উৎপাদন করতে পারি। আমাদের দেশের ওষুধের গুণগতমান ভাল বলেই আমেরিকা, ইউরোপ, জার্মান, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে সংবেদনশীল জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ক্রয় করছে। এটা বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়। আমরা ওষুধ রপ্তানি করতে পারি। দুঃখের বিষয় হলো, আমরা কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি উপকরণ আমাদের দেশে আমদানি করতে হয়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়। বর্তমান সরকার নীতিমালায় এমন পরিবর্তন এনেছে যার মধ্যে দিয়ে ওষুধ শিল্প বিকশিত হয়েছে। কৃষির আইন বিধি-বিধানগুলো যারা প্রণয়ন করেছে, তাদের এর গভীরে যাওয়ার মতন হয়তোবা সময় হয়নি। অথবা এর সাথে সংশ্লিষ্ট যারা তাদের সম্পৃক্ত করা হয় নাই। ফলে ৫০ বছর পরে এসেও আমাদের দেশে অতি সাধারণ জিনিস কীটনাশক তৈরি করতে পারে না। এটা তৈরি করতে তেমন কিছু লাগে না। সাধারণ প্রযুক্তির একটি জিনিস আমরা শতভাগ আমদানি করি। এটা আমাদের দেশের জন্য দুঃখের, অপমানের এবং লজ্জার বিষয়। বাংলাদেশের প্রাচীনতম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষিবিদ আছে। যাদের সফলতা দিয়ে বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ থেকে আজ খাদ্য উৎবৃত্তের দেশে উন্নীত হয়েছে। কৃষিতে আমরা বাস্তবসম্মত এতো সফলতা নিয়ে এসেছি, কিন্তু কৃষির প্রধান উপকরণগুলো আমাদের আমদানি করতে হয়। আমি একজন কৃষিবিদ হিসেবে অনুশোচনা বোধ করি। সরকারের বিধি-বিধান যে সংস্থাগুলো বাস্তবায়ন করে, সেই সমস্ত সংস্থার প্রধান যারা, তাদের এগিয়ে আসতে হবে। এটা খুব কঠিন কাজ নয়। আমরা আশা করি, খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই বিষয়গুলো সমাধান হয়ে যাবে।

কৃষিবিদ কে এস এম মোস্তাফিজুর রহমান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক,
ওয়ান ফার্মা ও ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ার গ্রুপ
আহ্বায়ক, বাংলাদেশ এগ্রোকেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন।